শ্রীকান্ত দেবনাথ: বাংলাদেশ জাতিসংঘ ঘোষিত একটি সল্পোন্নত দেশ। অসংখ্যা মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করে। আর্থিকভাবে যথেষ্ট স্বাবলম্বী না হওয়া বিচারপ্রার্থী সাধারণ জনগণ ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অর্থনৈতিক সংকটের কারণে ঠিকমতো আইনজীবী নিয়োগ করতে না পারায় বিচার পাচ্ছে না। অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে যখন মানুষ মৌলিক চাহিদা পূরণে হিমশিম খায় তখন মামলা মোকাদ্দমায় ব্যয় করার মতো সামর্থ্য সবার থাকে না। এমন পরিস্থিতি আর্থিকভাবে অসচ্ছল বিচারপ্রার্থী জনগণ জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা থেকে বিনামূল্যে আইনগত সহায়তা পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। আইনগত সহায়তা প্রদান নীতিমালা, ২০১৪- এ উল্লেখিত আর্থিকভাবে অসচ্ছল বিচারপ্রার্থী জনগণ আইনগত সহায়তা পেতে পারে। কিন্তু কিভাবে আইনগত সহায়তা পেতে হয়? কারা আইনগত সহায়তা পাবে সে বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা না থাকায় অনেকে আইনগত সহায়তা পাচ্ছে না বা আইনগত সহায়তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭নং অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী’। রাষ্ট্রে সকল জনগণের মধ্যে আইনের সমান অধিকার প্রদানের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ সরকার ২০০০ সালে কানাডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সির সহযোগীতায় ‘আইনগত সহায়তা প্রদান আইন, ২০০০’ পাস করে। উক্ত আইন কার্যকর করার জন্য সরকার ‘জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা (উপজেলা ও ইউনিয়ন কমিটি গঠন, দায়িত্ব, কার্যাবলী ইত্যাদি) প্রবিধানমালা, ২০১১, আইনগত সহায়তা প্রদান নীতিমালা, ২০১৪, আইনগত সহায়তা প্রদান (আইনী পরামর্শ ও বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি) বিধিমালা, ২০১৫, আইনগত সহায়তা প্রদান প্রবিধানমালা, ২০১৫, জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা (চৌকি আদালতের বিশেষ কমিটি গঠন, দায়িত্ব, কার্যাবলী ইত্যাদি) প্রবিধানমালা, ২০১৬, জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা (শ্রম আদালতের বিশেষ কমিটি গঠন, দায়িত্ব, কার্যাবলী, ইত্যাদি) প্রবিধানমালা, ২০১৬ পাস করে। কিন্তু আইনগত সহায়তা গ্রহণ বিষয়ে সাধারণ জনগণের সঠিক তথ্য জানা না থাকায় আইনগত সহায়তা পাচ্ছেন না।
আইনগত সহায়তা প্রদান আইন, ২০০০ এর ধারা ২ উপধারায় (ক) -এ বলা হয়েছে, আর্থিকভাবে অসচ্ছল, সহায় সম্বলহীন এবং নানাবিধ আর্থ সামাজিক কারণে বিচার প্রাপ্তিতে অসমর্থ বিচারপ্রার্থীকে আদালতে দায়েরযোগ্য, দায়েরকৃত বা বিচারাধীন মামলায় আইনগত পরামর্শ ও সহায়তা প্রদান করে।
যারা আইনগত সহায়তা পাবেন:
কোন মামলায় বাদী, বিবাদী বা আসামী যে কেউ আইনগত সহায়তা পেতে পারে। আইনগত সহায়তা প্রদান নীতিমালা, ২০১৪ এর ধারা ২- এ বলা হয়েছে কারা আইনগত সহায়তা পাবেন।
- আর্থিকভাবে অসচ্ছল ব্যক্তি, যার বাৎসরিক আয় ১,০০,০০০/- টাকার বেশি নয়। উচ্চ আদালতের ক্ষেত্রে যাহার বাৎসরিক আয় ১,৫০,০০০/- টাকার বেশি নয়।
- কর্মে অক্ষম, আংশিক কর্মক্ষম, কর্মহীন কোন ব্যক্তি। অর্থাৎ একজন বেকার ব্যক্তি আইনগত সহায়তা পেতে পারেন।
- বাৎসরিক ১,৫০,০০০/- টাকার বেশি আয় করতে অক্ষম কোনো মুক্তিযোদ্ধা।
- কোন শ্রমিক যার বাৎসরিক আয় ১,০০,০০০/- টাকার বেশি নয়।
- যে কোন শিশু।
- মানব পাচারের শিকার কোন ব্যক্তি।
- শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার কোন নারী ও শিশু।
- যার কোন আশ্রয় নেই বা নিরাশ্রয় ব্যক্তি।
- ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের কোন ব্যক্তি।
- পারিবারিক সহিংসতার শিকার অথবা সহিংসতার ঝুঁকিতে রয়েছে এমন কোন ব্যক্তি।
- বয়স্ক ভাতা পাচ্ছে এমন কোন ব্যক্তি।
- ভিজিডি কার্ডধারী কোন দুঃস্থ মাতা।
- দুর্বৃত্ত কর্তৃক এসিড দগ্ধ নারী বা শিশু।
- আদর্শ গ্রামে ভূমি বা গৃহ বরাদ্দপ্রাপ্ত কোন ব্যক্তি।
- অসচ্ছল বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা এবং দুঃস্থ মহিলা।
- প্রতিবন্ধী ব্যক্তি।
- আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে আদালতে অধিকার প্রতিষ্ঠা বা আত্মপক্ষ সমর্থন করিতে অসমর্থ ব্যক্তি।
- বিনা বিচারে আটক এমন কোন ব্যক্তি যিনি আত্মপক্ষ সমর্থনের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহনে আর্থিকভাবে অসচ্ছল।
- আদালত কর্তৃক আর্থিকভাবে অসহায় ও অসচ্ছল বলিয়া বিবেচিত কোন ব্যক্তি।
- জেল কর্তৃপক্ষ কর্তৃক আর্থিকভাবে অসহায় বা অসচ্ছল বলিয়া সুপারিশকৃত বা বিবেচিত কোন ব্যক্তি।
এছাড়াও আইনগত সহায়তা প্রদান আইন, ২০০০ এর উদ্দেশ্যে পূরণকল্পে, সংস্থা কর্তৃক সময় সময় চিহ্নিত আর্থিকভাবে অসচ্ছল, সহায় সম্বলহীন, নানাবিধ আর্থ সামাজিক এবং প্রাকৃতিক দূযোগের কারণে ক্ষতিগ্রস্থ কোন ব্যক্তি যিনি আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে স্বীয় অধিকার প্রতিষ্ঠা বা মামলা পরিচালনায় অসমর্থ তিনিও আইনগত সহায়তা পাবেন।
যেভাবে আইনগত সহায়তা পাবেন:
অনেকের মধ্যে এমন একটি ভুল ধারণা রয়েছে যে, মামলা করার প্রয়োজন হলেই হয়তো জাতীয় আইনগত সহায়তা সংস্থা থেকে সহযোগীতা পাওয়া যাবে। কিন্তু মামলা করার প্রয়োজন ছাড়াও যে কোন আইনগত পরামর্শের মাধ্যমে আইনগত সহায়তা পাওয়া যায়। কোন ব্যক্তি যখন কোন প্রকারের আইনগত সমস্যার সম্মুখীন হন তখন জাতীয় আইনগত সংস্থা থেকে আইনি পরামর্শ নিতে পারে। এক্ষেত্রে লিগ্যাল এইড অফিসার আইনগত পরামর্শ প্রদান করেন, আপোষ মীমাংসার উদ্যোগ গ্রহন করেন বা বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি করেন বা মামলায় সহযোগীতা করেন। যে কোন ব্যক্তি সুপ্রিম কোর্ট, জেলায় অবস্থিত নিম্ন আদালত, শ্রম আদালতে আইনগত সহায়তা পেতে পারে।
আইনগত সহায়তা প্রদান প্রবিধানমালা, ২০১৫ এর ধারা ৩ অনুযায়ী প্রত্যেক বিচারপ্রার্থীকে তাহার নাম, পূর্ণ ঠিকানা এবং আইনগত সহায়তার কারণ উল্লেখ করে সংস্থা কর্তৃক নিধারিত ফরমে আবেদন করতে হবে। এছাড়াও সাদা কাগজে লিখেও আবেদন করা যায়।
- আপীল বিভাগ বা হাইকোর্ট বিভাগে বিচারের বিষয় হইলে সুপ্রীম কোর্ট কমিটির চেয়ারম্যানের নিকট আবেদন করতে হবে।
- অন্যান্য আদালতে বিচারের বিষয় হইলে জেলা কমিটির চেয়ারম্যানের নিকট আবেদন করতে হবে।
- শ্রম আদালতে বিচারের বিষয় হইলে শ্রম আদালতের বিশেষ কমিটির চেয়ারম্যানের নিকট আবেদন করতে হবে।
এছাড়াও বিচরাধীন মামলার আইনগত সহায়তার জন্য সংশ্লিষ্ট আদালতকে অবহিত করে সহযোগীতা পাওয়া যায়।
যেখানে যোগাযোগ করবেন:
প্রত্যেক জেলায় জেলা জজ আদালত ভবনে জেলা লিগ্যাল এইড কমিটির অফিস রয়েছে। জেলা ও দায়রা জজ ইহার চেয়ারম্যান। সেখানে যোগাযোগ করলে লিগ্যাল এইড অফিসার ও কর্মচারীগণ আইনগত সহায়তার বিষয়ে পূণাঙ্গ সহায়তা প্রদান করেন। সুপ্রিম বিষয়ে আইনগত সহায়তার জন্য বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টে সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড অফিস রয়েছে। এছাড়াও প্রত্যেক উপজেলায় উপজেলা কমিটি রয়েছে, উপজেলা চেয়ারম্যান উক্ত কমিটির চেয়ারম্যান। প্রত্যেক ইউনিয়নে ইউনিয়ন কমিটি রয়েছে, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান উক্ত কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। উক্ত কমিটি সমূহের সাথে যোগাযোগ করে আইনগত সহায়তার বিষয়ে পরামর্শ নেওয়া যায়। এছাড়া জাতীয় আইনগত সহায়তা সংস্থা কর্তৃক প্রকাশিত জাতীয় হেল্পলাইন থেকে সাহায্য নিয়ে যোগাযোগ করা যায়।
বিচারপ্রার্থীর বা আইনগত সহায়তা প্রার্থীর দায়িত্ব:
আইনগত সহায়তা প্রদান প্রবিধানমালা, ২০১৫ এর ৪ ধারা মতে বিচার প্রার্থীর কিছু দায়িত্ব রয়েছে।
- যে আবেদন জমা দিবেন, তা নির্ভুল হতে হবে এবং পরিপূর্ণ তথ্য দিতে হবে।
- কমিটি, লিগ্যাল এইড অফিসার এবং নিযুক্ত আইনজীবীকে সহায়তা করতে হবে।
- কমিটি যে সকল শর্ত দিবেন তা পালন করতে হবে।
আইনজীবী নিয়োগ:
আইনগত সহায়তা প্রদান প্রবিধানমালা, ২০১৫ এর ৫ ধারা মতে, কোন বিচারপ্রার্থীকে আইনগত সহায়তা প্রদানের জন্য সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে মামলা পরিচালনার জন্য কমিটি তালিকাভুক্ত আইনজীবীগণের মধ্যে থেকে ৩ জন আইনজীবীকে মনোনীত করবে এবং বিচার প্রার্থীর সম্মতি সাপেক্ষে তাদের মধ্য থেকে একজনকে মামলা পরিচালনার জন্য নিয়োগ করা হবে।
আইনগত সহায়তায় জাতীয় টোল ফ্রী হেল্পলাইন:
সরকার অসহায়, দরিদ্র, নিযাতিত সকল শ্রেনীর মানুষকে আইনগত সহায়তা প্রদানের উদ্দেশ্যে জাতীয় পযায়ে সম্পূর্ন টোল ফ্রি একটি নম্বরের মাধ্যমে হেল্পলাইন সার্ভিস চালু করেছে। ২০১৬ সালের ২৮ এপ্রিল জাতীয় হেল্প লাইন কলসেন্টারটি উদ্বোধন করা হয়। যাহার হেল্পলাইন নম্বর – ১৬৪৩০। অফিস চলাকালীন সময়ে যে কোন ব্যক্তি আইনগত পরামর্শ, তথ্য বা লিগ্যাল কাউন্সিলিং এর জন্য সেবা গ্রহন করতে পারে। গত অর্থ বছরে ৩৩ হাজার ৯৭৯জন এই হেল্পলাইন থেকে সেবা গ্রহন করেছেন। গত ১৫ এপ্রিল একটি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানানো হয় বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে জাতীয় হেল্পলাইন নম্বর থেকে ২৪ ঘন্টা সেবা নেওয়া যাবে। এখন যে কেউ যে কোন সময় জাতীয় হেল্পলাইন থেকে আইনি পরামর্শ নিতে পারবে।
এছাড়াও জাতীয় আইনগত সংস্থার ওয়েবসাইট, ফেসবুক পেজ, ই-মেইল, ফোন নম্বরের মাধ্যমে তথ্য নেওয়া যায়। ওয়েবসাইট- www.nlaso.gov.bd ; ফেসবুক- www.facebook.com/bdnlaso ; ই-মেইল- directornlaso@gmail.com ; ফোন- ০২-৮৩৩১৯০৬।
২০০৯ সাল থেকে জুন, ২০১৯ সাল পযন্ত মোট ৪,৩০,৭৭৩ জন আইনগত সহায়তা গ্রহন করেছেন। এই আইনগত সহায়তার মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ আদায় হয়েছে ২০,৬৬,৮৩,০৪৪/- টাকা। বাংলাদেশের মোট আইনী পরামর্শ ও মামলার তুলনায় তা খুবই নগন্য। তবে পূর্বের চেয়ে বর্তমানে সেবা গ্রহীতার সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে।
গত অর্থ বছরে মোট ১,০০,৮০৬ জন আইনগত সহায়তা গ্রহন করেছেন। আইনগত সহায়তার মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ আদায় হয়েছে ৯,১৪,০৮,৪৭৫/- টাকা। ১,০০,৮০৪ জনের মধ্যে শুধু আইনী পরামর্শ নিয়েছেন ৫৮৫৭৫ জন। অর্থাৎ মামলায় সহায়তা বা বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি সেবা নেওয়ার সংখ্যা অত্যন্ত কম। যদিও আইনগত সহায়তা গ্রহনের সংখ্যা গত বছরের চেয়ে প্রায় ২৫ শতাংশ বেড়েছে। এর আগের বছর মোট সেবা গ্রহীতার সংখ্যা ছিল ৭৫,৯১২ জন।
পরিশেষে বলা যায় আর্থিক ভাবে অসচ্ছল বিচারপ্রার্থীরা জাতীয় আইনগত সহায়তা সংস্থা থেকে বিনামূল্যে আইনগত সহায়তা লাভ করতে পারে।
লেখক- আইনের শিক্ষার্থী ও প্রতিবেদক- ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডট কম।