আইমান রহমান খান: আদালত চলাকালীন অবস্থায় গত ১৬ নভেম্বর আনুমানিক বিকেল ৪টায় ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে একটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। আদালতের সবচেয়ে জরুরী বিভাগ রেকর্ড রুম থেকেই এই আগুনের সূত্রপাত হয়েছে তা অনুমান করা হচ্ছে। যতটা না অবাক করার মত এই ঘটনা, তার চেয়েও উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে রেকর্ড রুমে সংরক্ষিত নথিপত্রগুলোর পুড়ে যাওয়া। এই ঘটনার মাধ্যমে উঠে এসেছে নিম্ন আদালতের প্রতিবন্ধকতার চিত্র।
আশ্চর্য হলেও সত্য, দেশের বিচার বিভাগে প্রযুক্তির ব্যবহার অতি সীমিত। বিশেষ করে নিম্ন আদালতে এর প্রচলন নেই বললেই চলে। প্রযুক্তি বলতে প্রাথমিক পর্যায়ে কম্পিউটার কম্পোজকৃত মামলার পিটিশন তৈরী ও নোটিশ ছাপানোতেই সীমাবদ্ধ। প্রযুক্তির দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়া নিম্ন আদালতগুলো এখনো ব্যবহার করে যাচ্ছে ছাপা কাগজ, যার অস্তিত্ব সর্বক্ষণ হুমকির মুখে।
সারাবিশ্ব যখন প্রতিযোগিতায় নেমেছে কিভাবে প্রযুক্তির প্রয়োগ করে বিচার ব্যবস্থাকে আরো সহজ করা যায়, তখন আস্থার সাথে আমরা ভরসা করে যাচ্ছি প্রাচীন সব পদ্ধতিতে৷অথচ সময়ের সাথে সাথে ও আবহাওয়ার পরিবর্তনে এই কাগজগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছে। বিলীন হয়ে যাচ্ছে শত শত মামলার জরুরি দলিলপত্র। তাদের সুরক্ষা প্রদান মাঝেমধ্যে আমাদের আওতার বাইরে চলে যায়। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তারই একটি উদাহরণ মাত্র।
মামলাজটের পাশাপাশি বছরের পর বছর বাড়ছে মামলার নথির স্তূপ। প্রতিনিয়ত যোগ হচ্ছে নতুন মামলার ফাইল। রেকর্ড রুমে কর্মচারীদের চেয়ে বেশি কাগজপত্রের উপস্থিতি। এই গুরুত্বপূর্ণ কাগজগুলো সংরক্ষণ করা হচ্ছে কখনো বা স্টিলের আলমারিতে কখনো কাঁচের শোকেসে। কাগজের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় মাঝেমধ্যে তা আলাদা কামরায় স্থানান্তর করা হচ্ছে বা আলমিরার উপরেই স্তূপ করা হচ্ছে। তারপরও ছাপানো হচ্ছে নতুন মামলার নথি। এভাবেই প্রতিদিন জমছে শত শত মামলার দলিল দস্তাবেজ।
এর কারণ কাগজের উপর আমাদের বাধাহীন নির্ভরতা। একটি মামলার প্রয়োজনীয় কাগজগুলো আদালতে দাখিল করার সাথে জড়িত থাকে সংশ্লিষ্ট অংশগ্রহণকারীদের অধিকার। আদালত যাদের শেষ আশ্রয়স্থল, তাদের কাছে আদালতই দাখিলকৃত কাগজপত্রের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা। তবে এই আদালতই যদি কার্যকরী না হয়, তাহলে তাদের যাওয়ার আর কোন পথ বাকি থাকেনা। ঢাকার দায়রা জজ আদালতে আগুন লাগাতে এমন অনেক মানুষ, যারা বিভিন্ন মামলার পক্ষ, আর্থিক ও মানুষিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এমন ঘটনা প্রথমবার ঘটলেও এমনটা যে কোনদিনও ঘটতোনা তার নিশ্চয়তা নেই। তাই প্রয়োজন আধুনিক পদ্ধতিতে মামলার নথিপত্র সংরক্ষণের।
আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের কিছু রাজ্যে ইতিমধ্যে চালু হয়েছে ‘কাগজবিহীন বিচার ব্যবস্থা’। এর মাধ্যমে বিচার ব্যবস্থাটির স্বচ্ছলতা এবং ন্যায় বিচারের গুনগত মানকে বাড়িয়ে তুলেছে। আইসিটির ব্যবহার তাদের বিচার ব্যবস্থাকে জনগনের কাছে আরো সহজলভ্য করে তুলেছে। সেই সাথে তথ্য সুরক্ষা ও একটি ভাল মানের আইনী ডাটাবেজ তৈরি করা হয়েছে যা জনসাধারণের হাতের নাগালেই।
একটি কাগজবিহীন বিচার ব্যবস্থাই পারে প্রয়োজনীয় নথি সংরক্ষিত রাখতে। একই সাথে সম্পূর্ণ ডিজিটাল পদ্ধতিতে মামলা দায়ের করা হবে এবং যাবতীয় তথ্যসমূহ জমা হবে একটি অনলাইন ‘ক্লাউড সিস্টেমে’। এই ‘ক্লাউড সিস্টেম’ একটি অনলাইন ডাটাবেজ, যেখানে মামলার উভয় পক্ষই তাদের নথিপত্র জমা করবে। এই সিস্টেম সরাসরি সংশ্লিষ্ট আদালতের সাথে সংযুক্ত থাকবে যা শুনানি চলাকালে বিচারকের কম্পিউটারে প্রদর্শিত হবে। ফলে একটি মামলা পরিচালনা করার খরচ ও সময় অর্ধেকে নেমে আসবে। নথিপত্র থাকবে সুরক্ষিত কারন তখন সব তথ্যই হবে ডিজিটাইজ। এভাবে কাগজের ব্যবহার কমতে কমতে এক পর্যায়ে তা শুধুমাত্র ইতিহাসের পাতায় সীমাবদ্ধ হবে।
একটি পরিবর্তন একদিনে সম্ভব না। এর জন্য চাই যথাযথ প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণ। যেহেতু সময়ের সাথে পাল্টে যাচ্ছে দক্ষতার বৈশিষ্ট্য, তাই এখন আদালতের প্রাথমিক জ্ঞানের পাশাপাশি প্রযুক্তিগত জ্ঞানও থাকা দরকার। তাই আদালতে কর্মরত সকল শ্রেণির কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন। নতুন প্রার্থীদের জন্যও তা বাধ্যতামূলক করা হোক। এই ডিজিটাল যুগে সব ধরনের প্রতিষ্ঠান প্রযুক্তির আওতায় চলে এসেছে তাই আইনাঙ্গনের আধুনিকায়ন এখন সময়ের দাবি।
আইমান রহমান খান: অ্যাডভোকেট, ঢাকা জজ কোর্ট। ই-মেইল: advarklaw@gmail.com