মতিউর রহমান: জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণসহ সামগ্রিকভাবে তাদের শান্তিপূর্ণ জীবন-যাপন নিশ্চিতের লক্ষ্যে ভূমি সংক্রান্ত অপরাধ দমনের জন্য অত্র আইন প্রস্তুত করার লক্ষ্যে “ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন, ২০২১”-এর খসড়া প্রস্তুত একটি যুগান্তরকারী পদক্ষেপ। অত্র খসড়া আইনটিতে ভূমি সংক্রান্ত অপরাধকে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে তা যথেষ্ট সমৃদ্ধ। তবে, অত্র আইনের প্রয়োগ যথাযথ ও কার্যকরী করার নিমিত্তে এবং মামলার বহুতা ও মামলাজট কমানোর নিমিত্তে আইনের পদ্ধতিগত বিধিসমূহের কিছু বিষয়ে বিবেচনার প্রয়োজন মর্মে প্রতীয়মান হয়। অত্র খসড়া আইনের ৪, ৫, ৬, ১০, ১১, ১২ ও ১৩ ধারায় বর্ণিত অপরাধের বিচার ও শাস্তি প্রদানের ক্ষমতা সিভিল আদালতের বিচারককেই প্রদান করা হলে উক্ত বিধানগুলোর কার্যকর প্রয়োগ হবে এবং একই বিষয়ে মামলার বহুতা ও মামলার দীর্ঘসূত্রিতা কমবে। উক্ত ধারাগুলোর অপরাধের শাস্তি প্রদানের জন্য দেওয়ানী আদালতের বিচারককেই ১ম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে ক্ষমতায়ন করা যেতে পারে। দেওয়ানী আদালতে বিচারিক কাজের অভিজ্ঞতা হতে আমার কাছে নিম্নোক্ত কারণসমূহের প্রেক্ষিতে এই প্রস্তাবটি যৌক্তিক মনে হয়েছে।
অত্র আইনের অপরাধ সমূহ বিচার করার ক্ষমতা ১ম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট আদালত বা ক্ষেত্রমতে মোবাইল কোর্টকে প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু, অত্র আইনের ৫, ৬, ১০ ও ১১ ধারার অপরাধ গুলো সংগঠিত হয়েছে কি না তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেওয়ানী আদালত কর্তৃক নির্ধারণ ছাড়া নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়। কেউ মালিকানার চেয়ে বেশি জমি বিক্রয় করেছেন কি না বা কেউ মালিকানার চেয়ে বেশি জমি দলিলে উঠিয়ে নিয়েছেন কি না তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চেইন অব টাইটেল ধরে বাটোয়ারা মোকদ্দমার ন্যায় হিসাব বের করা প্রয়োজন। আবার সহ-শরিকদের বঞ্চিত করার নিমিত্তে কেউ প্রাপ্যতার অধিক দলিল সৃজন করছেন কি না এটাও বাটোয়ারা মোকদ্দমার মত হিসাব বের করা ছাড়া নির্ধারণ অসম্ভব। এই ধারাগুলোর অপরাধগুলো সিভিল মামলার বিচারের ক্ষেত্রে সিভিল আদালতের নজরে প্রায়শই আসে। অত্র আইন পাশ হলেও উক্ত ধারা গুলোর অপরাধ সিভিল আদালত কর্তৃক মোকদ্দমার নিষ্পত্তি কালে নজরে আসলেও উক্ত আদালতের কিছু করার থাকবে না। সেক্ষত্রে সিভিল আদালতের ফাইন্ডিংস নিয়ে পুনরায় একটি ফৌজদারি মামলা করার প্রয়োজন হবে। যার ফলে মামলার বহুতা বৃদ্ধি পাবে। আবার, উক্ত ধারাগুলোর অপরাধ সংগঠিত হয়েছে মর্মে ফৌজদারি আদালতে মামলা করা হলে আসামী পক্ষরা একই বিষয়ে সিভিল আদালতে মামলা দায়ের করবেন তার স্বত্বের জটিল হিসাব নির্ধারণ করার জন্য। যার ফলে একই বিষয়ে মামলার বহুতা এবং দীর্ঘসূত্রিতা বৃদ্ধি পাবে।
ধারা ৪-এ বর্ণিত অপরাধ হয়েছে কি না তাও দেওয়ানী মোকদ্দমাতেই নির্ধারণের বিষয়। কারণ, কোন দলিল নিঃস্বত্ববান ব্যক্তি কর্তৃক সৃষ্ট কি না বা কোন দলিল জাল কি না তা দেওয়ানী আদালতে মোকদ্দমা বিচারকালীন সময়েই প্রকাশ পায় বা দেওয়ানী আদালত কর্তৃকই উক্ত দলিল জাল ও নিঃস্বত্ববান ব্যক্তির দ্বারা সৃষ্ট এবং অকার্যকর মর্মে নির্ধারিত হয়। জাল কি না তা ফৌজদারি আদালতেও নির্ণয়যোগ্য হলেও নিঃস্বত্ববান ব্যক্তি কর্তৃক সৃষ্ট কি না তা নির্ধারণের জন্য স্বত্বের প্রশ্ন নির্ধারণ করা প্রয়োজন। দেওয়ানী আদালতের মাধ্যমে কোন দলিল নিঃস্বত্ববান ব্যক্তির দ্বারা সৃষ্ট কি না বা কোন দলিল জাল কি না সেই বিষয়ে নির্ধারণের মাধ্যমে আবার শাস্তি নিশ্চিতের জন্য ফৌজদারি আদালতে মামলা দায়ের করার প্রয়োজন হলে মামলার বহুতা বৃদ্ধি পাবে।
ধারা ১২ ও ১৩: কোন ব্যক্তি কোন জমি অবৈধভাবে দখল করেছেন বা অবৈধভাবে দখলে রয়েছেন কি না তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য আগেই স্বত্বের প্রশ্ন বিবেচনা করে নিষ্পত্তি করা প্রয়োজন। আবার, কোন সহ-উত্তরাধিকার অপর সহ-উত্তরাধিকারের জমি জোর পূর্বক দখলে রয়েছেন কি না তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য পূর্বেই নির্ধারণ করা প্রয়োজন কে কত টুকু অংশের অংশীদার এবং কার কোন দিকে দখল। কারণ, এজমালি সম্পত্তিতে সকল শরিক দখলে রয়েছে মর্মে গণ্য হয়। এই বিষয় গুলো সিভিল আদালতে নির্ধারণ ব্যতীত অত্র ধারা গুলোতে বর্ণিত অপরাধ সংগঠিত হয়েছে কি না তা নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়। দেওয়ানী আদালতের মাধ্যমে আগে এই বিষয়গুলো নির্ধারণ হওয়ার পর তারপর একই বিষয় নিয়ে ফৌজদারি আদালতে শাস্তির জন্য মামলা করতে হলে মামলার বহুতা এবং দীর্ঘসূত্রিতা বাড়বে।
এমতবস্থায়, অত্র ধারার অপরাধসমূহ বিচার করার নিমিত্তে এখতিয়ারসম্পন্ন আদালতের বিষয়টি নিয়ে বিবেচনা করা যেতে পারে। যেমন: পারিবারিক আদালতের বিচারক পারিবারিক মোকদ্দমায় সিভিল ক্ষমতার পাশাপাশি ১ম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবেও ক্ষমতাপ্রাপ্ত থাকায় পারিবারিক ডিক্রি জারী মোকদ্দমাগুলো কার্যকরভাবে নিষ্পত্তি করে মানুষকে দ্রুত প্রতিকার দিতে পারছেন তেমনিভাবে দেওয়ানী আদালতের বিচারককে ১ম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট এর ক্ষমতা প্রদান করে অত্র আইনের অত্র ধারাগুলোর অপরাধ বিচার করার ক্ষমতা প্রদান করা যেতে পারে। সিভিল স্যুটেই যদি পক্ষগণ অত্র আইনের উক্ত ধারা গুলো অনুসারে শাস্তির প্রতিকার প্রার্থনা করেন এবং আদালত যদি উক্ত সিভিল মামলা নিষ্পত্তির প্রাক্কালে ঐ ধারার অপরাধের উপাদান প্রমাণ পায় তাহলে সিভিল জজ ১ম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে শাস্তি প্রদান করতে পারবেন এমন বিধান করা যেতে পারে।
তবে, যেসকল ক্ষেত্রে স্বত্বের বিষয় নিয়ে জটিলতা নেই এবং স্পষ্টত অত্র ধারাগুলোর অপরাধ সংগঠিত হয়েছে সেই সকল অপরাধের বিচারের নিমিত্তে ফৌজদারী আদালতেও ফোরাম রাখা যেতে পারে। দেওয়ানী আদালতকে এইভাবে এখতিয়ার প্রদান করা হলে দেওয়ানী আদালতের সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে, অত্র আইনের উক্ত বিধানগুলী যথাযথভাবে কার্যকর হবে, ভূমি সংক্রান্ত উক্ত অপরাধগুলো কমে যাবে। যার ফলে দেওয়ানী মামলা কমে যাবে, একই বিষয়ে মামলার বহুতা কমে যাবে। ফলে মামলাজট ও মামলার দীর্ঘসূত্রিতা সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে, বিচারপ্রার্থীদের হয়রানি কম হবে। আশাকরি কর্তৃপক্ষ বিষয়টি সুবিবেচনা করবেন।
লেখক: সহকারী জজ; জেলা ও দায়রা জজ আদালত, রংপুর।