ইংরেজিতে একটা কথা আছে- ট্রুথ ইজ সামটাইমস স্ট্রেঞ্জার দ্যান দ্য ফিকশন, অর্থাৎ সত্য কখনও কখনও কল্পকাহিনীর চেয়েও অদ্ভুত হয়। হ্যাঁ, কল্পকাহিনীর চেয়ে বিস্ময়কর সেই বাস্তবতা নিশ্চিত করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শেগুফতা তাবাসসুম আহমেদ।
প্রায় ১৬ বছর আগে খুন হন বাবা। বিচার নিশ্চিতের জন্য আইনজীবী হতে চেয়েছিলেন মেয়ে। আজ সে স্বপ্ন পূরণও করলেন আইজীবী হিসেবে। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের প্রয়াত অধ্যাপক ড. এস তাহেরের সন্তান শেগুফতা।
২০০৬ সালে ড. তাহেরকে যখন হত্যা করে ম্যানহোলে ফেলে রাখা হয়, তখন শেগুফতা মাত্রই উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়েছেন। বাবার হত্যার বিচার নিশ্চিতের লক্ষ্যে পড়েছেন আইনে। এরপর লড়েছেন আইনজীবী হয়ে। বিচারের দীর্ঘ এই সময়টাতে মাকে নিয়ে একা একা চালিয়েছেন যুদ্ধ। অবশেষে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হল আলোচিত এই হত্যা মামলার।
অধ্যাপক এস তাহের আহমেদ হত্যা মামলায় দুই আসামির মৃত্যুদণ্ড ও দুজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়ে হাইকোর্টের দেওয়া রায় বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষ ও রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিল খারিজ করে আজ মঙ্গলবার (৫ এপ্রিল) এ রায় দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের আপিল বিভাগ।
রায় ঘোষণার সময় আদালতে অধ্যাপক ড. এস তাহেরের স্ত্রী সুলতানা আহমেদ, ছেলে সানজিদ আলভী আহমেদ এবং মেয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শেগুফতা তাবাসসুম আহমেদ উপস্থিত ছিলেন।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিশ্বজিৎ দেবনাথ। তাদের সাথে ছিলেন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল অবন্তী নুরুল ও মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম। আসামী পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন, এসএম শাহজাহান ও ব্যারিস্টার ইমরান সিদ্দিকী। আর অধ্যাপক ড. তাহেরের পরিবারের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী নাহিদ সুলতানা যুথি।
গত ১৬ মার্চ আপিলের ওপর শুনানি শেষ হয়। শুনানি শেষে রায়ের জন্য আজকের তারিখ (৫ এপ্রিল) ধার্য করেছিলেন বিভাগ। সে অনুসারে আজ সকালে রায় ঘোষণা করা হয়।
রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন তার স্ত্রী সুলতানা আহমেদ। তিনি বলেছেন, ১৬ বছর ধরে অপেক্ষা করছি। আপিল বিভাগ আজ দুই জনের মৃত্যুদণ্ড ও দুই জনের যাবজ্জীবন দণ্ড বহাল রেখেছেন। আমরা ন্যায়বিচার পেয়েছি। দ্রুত এ রায় কার্যকরের জন্য সরকারের কাছে আবেদন করছি। রায় কার্যকর হলে আমরা পুরোপুরি সন্তুষ্ট হব।
রায়ের পর অধ্যাপক তাহেরের মেয়ে শেগুফতা তাবাসসুম আহমেদ বলেন, ‘বাবাকে হারিয়েছি ১৬ বছর হলো। দণ্ডিতদের ফাঁসি কার্যকর হলে কিছুটা হলেও স্বস্তি পাব।’
অধ্যাপক তাহের হত্যা মামলায় ২০১৩ সালের ২১ এপ্রিল রায় দেন হাইকোর্ট। রায়ে তাহেরের একসময়ের ছাত্র ও পরে বিভাগীয় সহকর্মী মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ও তাহেরের বাসভবনের তত্ত্বাবধায়ক জাহাঙ্গীরের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়। অপর দুই আসামিকে মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এই দুজন হলেন জাহাঙ্গীরের ভাই নাজমুল আলম ও নাজমুলের স্ত্রীর ভাই আবদুস সালাম।
হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিরা পৃথক আপিল ও জেল আপিল করেছিলেন। অন্যদিকে হাইকোর্টে যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের সাজা বৃদ্ধি চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আবেদন করে। এসবের ওপর গত ২২ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানি শুরু হয়। অষ্টম দিনে গত ১৬ মার্চ শুনানি শেষ হয়।
প্রসঙ্গত, ২০০৬ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কোয়ার্টারের বাসার বাইরের ম্যানহোলে তাহের আহমেদের লাশ পাওয়া যায়। এ ঘটনায় সেদিন তাঁর ছেলে সানজিদ আলভী আহমেদ মতিহার থানায় মামলা করেন।
মামলায় ২০০৮ সালের ২২ মে রায় দেন বিচারিক আদালত। রায়ে একই বিভাগের এক শিক্ষকসহ চারজনকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়। দুজনকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়।
বিচারিক আদালতের রায়ের পর আসামিদের মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের জন্য ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে আসে। এ ছাড়া দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আসামিরা ২০০৮ ও ২০০৯ সালে আপিল করেন। আপিলের ওপর ২০১৩ সালের ২১ এপ্রিল রায় দেন হাইকোর্ট।