মো. শহীদুল্লাহ মানসুর: জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন ও সন্তানের উজ্জল ভবিষ্যৎ বিবেচনায় শহরমুখী হচ্ছে সাধারণ মানুষ। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য সকল সুযোগ-সুবিধা হাতের লাগালে পাওয়া ছাড়াও আধুনিক কর্মসংস্থানের অধিংকাংশ প্রতিষ্ঠানের অফিস শহরকেন্দ্রিক হওয়ায় এক রকম বাধ্য হয়েই শহরমুখী হতে হচ্ছে। এসব মানুষের অধিকাংশকেই ভাড়া বাসায় থাকতে হয় আর অন্যদিকে বাড়িভাড়া বিড়ম্বনা নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাড়িওয়ালাদের দাপটে বা স্বেচ্ছাচারিতায় অসহায় ভাড়া বাসার বাসিন্দারা। নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চ-মধ্যবিত্ত সবাই বাড়িভাড়া ও বাড়িওয়ালাদের কাছে অসহায় ও নিরুপায়। নেই কোন কোনো জবাবদিহিতা বা নিয়ন্ত্রণ। এক্ষেত্রে বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়া উভয়পক্ষই নানাবিধ অনিয়ম করেন এবং হয়রানি শিকারও হন। যেমন– হটাৎ ভাড়া বৃদ্ধি করা, বিনা নোটিশে উচ্ছেদ করা, বাসার ক্ষতি করাসহ ইত্যাদি। তবে ভাড়াটিয়ারা অনেক বেশি হয়রানীর শিকার হন।
এ ধরনের অনিয়ম ও হয়রানি প্রতিরোধে বাংলাদেশে রয়েছে “বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯১” ভাড়াটে হিসেবে ব্যক্তির অধিকার যেমন রয়েছে তেমনি কোনো বাড়িওয়ালা অধিকার লঙ্ঘন করলে পেতে হবে শাস্তি। সাধারণত জ্যেষ্ঠ সহকারী জজ আদালত বাড়িভাড়া সংক্রান্ত সমস্যা নিষ্পত্তি করে থাকেন।
এ আইনে বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়াকে কী কী অধিকার দিয়েছে বিশ্লেষণ করা যাক;
লিখিত চুক্তি
ভাড়া বাসায় ওঠার আগে বাড়ির মালিক ও ভাড়াটিয়ার মধ্যে একটি চুক্তিনামা করা উচিৎ যেখানে চুক্তির মেয়াদ, বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়ার নাম, ঠিকানা ও উভয়পক্ষের মোবাইল নম্বর উল্লেখ করতে হবে। এছাড়াও ভাড়ার পরিমাণ, মাসের কত তারিখের মধ্যে ভাড়া পরিশোধ করতে হবে, পানি সরবরাহ, বিদ্যুৎ বিলসহ অন্যান্য সেবার চার্জ ও শর্ত চুক্তিতে উল্লেখ রাখতে হবে। এক্ষেত্রে যে ধরণের চুক্তিই হোক না কেন, তা ৩০০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে লিখিত হতে হবে। এর ফলে অনাকাঙ্ক্ষিত ঝামেলা এড়ানো সম্ভব।
ভাড়া হতে হবে মানসম্মত
“বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯১” এর ১৫ ধারা অনুযায়ী, বাড়ির ভাড়া মানসম্মত হতে হবে। এখানে ‘মানসম্মত’ বলতে যৌক্তিক ও উপযুক্ত ভাড়ার কথা বলা হয়েছে। আরো বলা হয়েছে যে, ভাড়ার বার্ষিক পরিমাণ সংশ্লিষ্ট বাড়ির বাজার মূল্যের শতকরা ১৫ ভাগের বেশি হবে না। এছাড়াও ৭ ধারায় আরো বলা হয়েছে, বাড়ির ভাড়া মান সম্মতের অধিক হলে তা চুক্তিদ্বারা নির্ধারিত হলেও তা কোনোভাবেই আদায়যোগ্য হবে না।
অগ্রিম জামানত গ্রহণ
এ আইনের ১০ ও ২৩ ধারা অনুযায়ী, ভাড়া দেওয়া বা ভাড়ার মেয়াদ বৃদ্ধির কারণে কোনো ব্যক্তি ভাড়ার অতিরিক্ত প্রিমিয়াম, সালামি বা জামানতের জন্য কোন অর্থ দাবি বা গ্রহণ করতে পারবেন না। আরো বলা হয়েছে যে, নিয়ন্ত্রকের পূর্ব অনুমতি ব্যতীত অগ্রিম ভাড়া বাবদ একমাসের বাড়িভাড়ার অধিক টাকা দাবী বা আদায় করতে পারবেন না। যদি কোন বাড়িওয়ালা এমন কাজ করে তবে তা অপরাধ বলে বিবেচিত হবে এবং এর জন্য দণ্ডবিধি ২৩ ধারায় দণ্ডিত হবেন।
ভাড়ার রসিদ প্রদান
একই আইনের ১৩ ধারা অনুযায়ী, বাড়িওয়ালাকে ভাড়ার রসিদ প্রদান ও সংরক্ষণ করতে হবে। আরো বলা হয়েছে, যদি কোন বাড়িওয়ালা রসিদ প্রদান করতে অস্বীকার করে বা ব্যর্থ হয় তবে ভাড়াটের অভিযোগের ভিত্তিতে যে অর্থআদায় করেছেন তার দ্বিগুণ অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। (ধারা-২৭)
বাসযোগ্য বাসস্থান
বাড়ির অবস্থা সম্পর্কে এই আইনের ২১ ধারায় বলা হয়েছে যে, স্বাস্থ্যসম্মত ও বসবাসের উপযোগী করে বাড়িটি প্রস্তুত রাখতে হবে। এক্ষেত্রে বাড়িওয়ালা ইচ্ছাকৃতভাবে ভাড়াটিয়াকে বসবাসের অনুপযোগী বা অযোগ্য অবস্থায় রাখতে পারবেন না অর্থাৎ বাড়ির পরিবেশ পরিষ্কার রাখা, পানি সরবরাহ, বিদ্যুৎ সরবরাহ, পয়ঃপ্রণালী নিষ্কাশন ইত্যাদিসহ চুক্তিতে উল্লেখিত অন্যান্য সকল সুবিধা প্রদান করা ও ভাড়াটিকে ব্যবহার করা হতে বিরত রাখতে পারবে না।
বাড়ি মেরামত
“বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯১” এর ২১ (৬) ধারা অনুযায়ী, জরুরী প্রয়োজনে বাড়ির কোন অংশ মেরামত করার প্রয়োজন হলে বাড়িওয়ালাকে তা মেরামতের নোটিশ দিতে হবে কিন্তু নোটিশ দেওয়ার ৭২ ঘন্টার মধ্যে মেরামতের ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে ভাড়াটিয়া তার নিজ উদ্যোগে মেরামত করতে পারবেন এবং যাবতীয় খরচ ভাড়া থেকে কেটে রাখতে পারবেন তবে তা নিয়ন্ত্রকের আদেশে উল্লেখিত অর্থের অধিক হবে না।
ভাড়া বাড়ানো
এই আইনের ১৬ ধারায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, চুক্তি অনুযায়ী ভাড়া কার্যকর হওয়ার তারিখ হতে দুই (২) বছর পর্যন্ত ভাড়া বাড়ানো যাবে না। তবে ৮ ধারা এবং ৯ ধারায় বলা হয়েছে যে, বাড়িভাড়ার চুক্তি হওয়ার পর বাড়িওয়ালা যদি নিজ খরচে প্রয়োজনীয় মেরামতের অন্তর্ভুক্ত নয় এমন কোন সংযোজন, উন্নয়ন বা পরিবর্তন করেন বা কোন আসবাবপত্র সরবরাহ করেন বা কোন বাড়ির পৌর অভিকর, কর, টোল বা ফিস বা তা কোন অংশ যা স্বাভাবিকভাবে ভাড়াটিয়া পরিশোধ করতে বাধ্য এমন টাকা পরিশোধ করেন তবে বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়া পরস্পর আলোচনা সাপেক্ষে অতিরিক্ত ভাড়া নির্ধারণ করতে পারবেন।
বাড়ি থেকে উচ্ছেদ
“বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯১” এর ১৮ ধারা অনুযায়ী, সম্পত্তি হস্তান্তর আইন, ১৮৮২ বা চুক্তি আইন, ১৮৭২ আইনে যাই থাকুক না কেন, কোন ভাড়াটিয়া যদি নিয়মিত বাড়িভাড়া পরিশোধ করেন এবং চুক্তির অন্যান্য শর্তসমূহ মেনে চলেন তবে ভাড়াটিয়াকে উচ্ছেদ করা যাবে না। এমনকি উপধারা ২ সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, বাড়িওয়ালাও যদি পরিবর্তন হয় তাবুও উচ্ছেদ করা যাবেনা যদি না বাড়িওয়ালা উক্ত বাড়ি নিজের জন্য ব্যবহার বা ভেঙ্গে নতুনভাবে করতে চান।
ভাড়াবাবদ ভাড়াটিয়ার আসবাবপত্র ক্রয়
এই আইনের ১২ নং ধারায় আরো বলা হয়েছে, কোনো বাড়িওয়ালা বাড়িভাড়া বা ভাড়া নবায়ন বা মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য ভাড়াটিয়ার কাছ থেকে অর্থ না নিয়ে তার আসবাবপত্র ক্রয় করতে পারবেন না। এমনকি ভাড়া নবায়ন বা মেয়াদ বৃদ্ধির শর্ত চুক্তিতে থাকা সত্ত্বেও ভাড়াটিয়া তা নবায়ন বা মেয়াদ বৃদ্ধি না করে তবেও কোনো আসবাবপত্র আটক বা ক্রয় করা যাবে না।
বাড়িওয়ালার অধিকার
এই আইনে ভাড়াটিয়াকে বেশি নিরাপত্তা দিলেও এখানে বাড়িওয়ালাকেও একাধিক অধিকার দিয়েছে। স্বাভাবিকভাবে কোনো ভাড়াটিয়াকে উচ্ছেদ করা না গেলেও বিশেষক্ষেত্রে উচ্ছেদ করা যায়। যেমন;
- চুক্তির শর্তাবলী লঙ্ঘন করেছে।
- ভাড়ার সময়সীমা চুক্তিতে নির্ধারিত করা থাকলে।
- ভাড়া বাকি রাখলে।
- বাড়ীতে উৎপাত করলে বা ক্ষতি করলে।
- বাড়ীতে যেকোন ধরণের অবৈধকাজ করলে বা অবৈধ জিনিস রাখলে, ইত্যাদি কারণে
এই আইনের ২৬ ধারায় বলা হয়েছে যে, ভাড়াটিয়া যদি বাড়ী ছেড়ে দেন কিন্তু বাড়িওয়ালাকে খালি বাড়ী বুঝিয়ে না দেন তবে বাড়িওয়ালার আবেদনের প্রেক্ষাপটে ভাড়াটিয়াকে মানসম্মত ভাড়ার দশগুণ অর্থদণ্ড দেওয়া যাবে। এছাড়াও বাড়িওয়ালার নাম, ঠিকানা ভুল দিয়ে টাকা পাঠালেও ভাড়াটিয়াকে শাস্তির সম্মুখীন করা যাবে।
লেখক: শিক্ষানবিশ আইনজীবী; জজ কোর্ট, দিনাজপুর।