মোহাম্মদ সাঈদ আহমেদ (রাজা) সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী। আইনজীবী পরিবারের সন্তান সাঈদ আহমেদ রাজা ১৯৭৬ সালের ৩রা মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান, গরীবের আইনজীবী খ্যাত প্রয়াত সিনিয়র অ্যাডভোকেট আবদুল বাসেত মজুমদার।
১৯৯৪ সালে ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাশের পর বাবা আবদুল বাসেত মজুমদারের ঘনিষ্ঠজন তৎকালীন বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট আমিনুল হক, বার কাউন্সিলের সে সময়কার লিগ্যাল এডুকেশন কমিটির চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলামসহ বার কাউন্সিলের তৎকালীন নির্বাচিত অন্যান্য সদস্যদের পরামর্শে ভারতের বেঙ্গালুরুতে অবস্থিত ন্যাশনাল ল’ স্কুল অব ইন্ডিয়া ইউনিভার্সিটিতে আইন পড়তে যান। সেখান থেকে বিএ এলএলবি শেষ করে তিনি দেশে ফিরে আসেন। পরবর্তীতে আইন পেশায় নিয়োজিত হন।
আসন্ন বার কাউন্সিল নির্বাচনে তিনি সাধারণ আসনে সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। বয়সে তরুণ এই প্রার্থীর প্রতি আইনজীবীদের আকর্ষণও রয়েছে। বাবার সাথে দীর্ঘসময় আইনপেশায় সময় দিয়ে ও বার কাউন্সিল নিয়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে কাজ করে নিজের অভিজ্ঞতাকে করেছেন সমৃদ্ধ। তাঁর এই অভিজ্ঞতা আর ভাবনার সাথে পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দিতে ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম সম্পাদক অ্যাডভোকেট বদরুল হাসান কচি মুখোমুখি হয়েছেন সিনিয়র অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ সাঈদ আহমেদ রাজার সাথে।
সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে দেশে আইন শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে অন্তরায় ও করনীয়, এক্ষেত্রে স্বতন্ত্র আইন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয়তাসহ এনরোলমেন্ট পরীক্ষার দীর্ঘসূত্রিতা নিরসনে বিকল্প পদ্ধতি অনুসরণের পরামর্শ। পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হল-
ল’ইয়ার্স ক্লাব: আইনানুযায়ী বার কাউন্সিলের কর্মপরিধি কি কেবল আইনজীবীদের তদারকি করা নাকি আইন শিক্ষা ব্যবস্থায়ও ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে?
সাঈদ আহমেদ রাজা: বাংলাদেশ বার কাউন্সিল এমন একটা গভর্নিং বডি যার কাজ শুধু আইনজীবীদের গভার্ন করা নয়; বরং একজন আইন শিক্ষার্থী কোন কারিকুলামে শিক্ষা গ্রহণ করবেন সেটা নির্ধারণ করাও বার কাউন্সিলের কাজ। একইসঙ্গে আইন কারা পড়াচ্ছেন, পড়ানোর পদ্ধতি তদারকি করাও বার কাউন্সিলের কাজের মধ্যে পড়ে।
আইনে এসব ক্ষমতা দেওয়া হলেও দুর্ভাগ্যবশত বার কাউন্সিল একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর আর বিষয়গুলো দেখভাল করতে সমর্থ হয়নি। ফলশ্রুতিতে ল’ টা যেভাবে ডেভেলপ করে একজন শিক্ষার্থী থেকে আইনজীবী হয়ে; ক্লাসরুম থেকে কোর্ট রুমে আসার কথা ছিল তা মাঝখানে ব্রেক হয়ে গেছে।
আমাদের দেশে পপুলার লিগ্যাল এডুকেশন মানেই তো কিছু ল’ কলেজ, আর কিছু সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এছাড়া যাদের আর্থিক সামর্থ্য আছে তারা যুক্তরাজ্যে যাচ্ছেন, একটা ডিফারেন্ট স্টাডিজ অলটুগেদার। যে স্টাডিজের সাথে ইনফ্যাক্ট স্কিল ডেভেলপমেন্ট ছাড়া দেশের ল’ –এর সাথে কোনো রিলেভেন্সই নাই আন্ডার অ্যানি সার্কামস্টান্সেস। আবার দেশে যারা ল’ পড়ছেন এবং পড়াচ্ছেন দে নো নাথিং অ্যাবাউট লিগ্যাল ডেভেলপমেন্ট অব বাংলাদেশ।
এসবই আসলে আইন শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে অন্তরায় বলতে পারেন। আজকে ৫০ বছর পর আমরা এটা ফিল করছি। অথচ দেশ স্বাধীনের পর থেকে এসব নিয়ে কেউ ভাবেইনি। কেউ ফিল করেনি, আইন শিক্ষা ক্ষেত্রে আমাদের ভবিষ্যৎ কি হবে।
অথচ দেখুন, ব্রিটিশরা ২০০ বছর আগে কন্ট্রাক্ট ল’ করে দিয়েছে, এখন পর্যন্ত একটা ওয়ার্ড কেউ চেঞ্জ করতে পারেনি। হোয়াট ইজ দ্যা পারপাস অব ল’ মেকার? এটাই তো যে, ল’ মেকাররা ১০০ বছর দূরের ভবিষ্যৎও দেখবেন।
ল’ইয়ার্স ক্লাব: আইন শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে দেশে স্বতন্ত্র আইন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন?
সাঈদ আহমেদ রাজা: আইন শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে স্বতন্ত্র আইন বিশ্ববিদ্যালয় অবশ্যই প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী এবং প্রধান বিচারপতিসহ অন্যান্য বিচারকগণ দেশে বর্তমানে যত লিগ্যাল অন্তরায়ের কথা বলছেন সেগুলোর মধ্যে ল্যাক অব ট্রেনিং অব অন আওয়ার ওন ল’। অর্থাৎ আমাদের আইনের ওপর আমাদের ট্রেনিংয়ের অভাব রয়েছে।
সংবিধানে সাম্যতার কথা বলি, কিন্তু এই সাম্যতা বলতে কি বুঝায় সেটা বলা হয়নি। সংবিধান প্রণেতারা পরিষ্কার করেননি- ইজ ইট ইক্যুয়াল অ্যান্ড ইক্যুয়ালস? অর ইট ইজ আনইক্যুয়াল অ্যান্ড আনইক্যুয়ালস? সংবিধানের অনেক কিছুর অ্যানালাইসিস নাই।
আর এটাই হচ্ছে সমস্যা। কারণ দেশে রিসার্চ নেই, আমাদের মতো করে পড়ানো হয় না, কোন রকম অ্যানালাইসিস নাই। এজন্য বিশাল একটা গ্যাপ হয়ে যাচ্ছে। এই ক্ষেত্রে বার কাউন্সিল কুড নট টেক অ্যানি স্টেপ ফর লাস্ট ফিফটি ইয়ার্স।
তবে সব দোষ বার কাউন্সিলকে দিচ্ছি না। কেননা আমার বাবার (সিনিয়র অ্যাডভোকেট আবদুল বাসেত মজুমদার) কারণে বার কাউন্সিলকে খুব কাছ থেকে স্ট্রংলি দেখেছি। বার কাউন্সিলে বসার জায়গা ছিল না, ফাইল রাখার পর্যাপ্ত জায়গা ছিলনা। তবে ৪৫ বছর কষ্টের পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সদয় হয়ে নতুন একটা বিল্ডিং করে দিলেন।
চলতি বছরের মার্চের শেষদিকে যখন প্রধানমন্ত্রী সুপ্রিম কোর্টের নবনির্মিত ভবন ‘বিজয়-৭১’ উদ্বোধন করেন তখন তিনিও স্বতন্ত্র আইন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সম্মত হয়েছেন। আমারও মনে হয় এটাই রাইট টাইম স্বতন্ত্র আইন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার। যে ইউনিভার্সিটি থেকে আইন বিশেষজ্ঞরাই শিক্ষার্থীদের পড়াবেন টু মেক দেম গুড ল’ইয়ার্স।
ল’ইয়ার্স ক্লাব: আপনি বলছিলেন, বার কাউন্সিলকে আপনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন। এনরোলমেন্ট পরীক্ষার দীর্ঘসূত্রিতার কারণ কি বলে মনে করেন, এই সমস্যা নিরসনে আপনার পরামর্শ কি?
সাঈদ আহমেদ রাজা: কিছু অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ প্রবলেমের কারণে সেশনজট হয়ে গেছে। তবে কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করলে এ জট থেকে মুক্তির সুযোগ আছে। পুরো পরীক্ষা ব্যবস্থা ডিজিটাল পদ্ধতিতে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। ভিন্ন ভিন্ন এনরোলমেন্ট এক্সাম বন্ধ করে শুধু একটা পরীক্ষা নিলেই হয়। অনেকেই হয়তো বলতে পারেন এটা কীভাবে সম্ভব। তাদের উদ্দেশে বলবো, জিআরই, জিম্যাট, টোয়েফল, আইইএলটিএস, স্যাট ইত্যাদি পরীক্ষা বিশ্বব্যাপী অনলাইনে হচ্ছে না? তো আমাদের এনরোলমেন্ট এক্সামটাও তেমন স্ট্যান্ডার্ডে নিয়ে গেলেই হয়। এটার জন্য ইউ ডোন্ট নিড অ্যা রকেট সাইন্স।
এক্ষেত্রে তেমন কিছুর প্রয়োজন নেই, কোন কমিটিও প্রয়োজন নেই। একজন পরীক্ষার্থী ব্যাংকে টাকা জমা দেবে, কম্পিউটার জেনারেটেড কোয়েশ্চেন, ইউ অ্যানসার। টেক দ্যা রেজাল্ট, গো হোম। পরদিন নিজের নাম, রেজিস্ট্রেশন নম্বর দিয়ে সনদ প্রিন্ট করে স্টার্ট প্র্যাকটিস। শুধু একজন স্বউদ্যোগী মানুষ হলেই সম্ভব, যার মনে সত্যিকার অর্থেই দেশের বিচার ব্যবস্থা ও আইনজীবীদের ডেভেলপমেন্টের জন্য কাজ করার বাসনা রয়েছে।
এনরোলমেন্টের সবচেয়ে ভালো পজিটিভ বিষয় হচ্ছে, এখানে বার কাউন্সিল ডু নট পে, সনদপ্রার্থী নিজেই এই পরীক্ষার ব্যয় বহন করে। এক্ষেত্রে টাকা না হয় কিছু বেশি যাবে, কিন্তু এক এক্সামেই অধস্তন আদালত থেকে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত এনরোল হয়ে যাক। এতে করে অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড সিস্টেমও রাখার প্রয়োজন পড়বে না।
হয়তো এখনই একদম সর্বোচ্চ স্ট্যান্ডার্ড সেট করা বা পাওয়া সম্ভব না, ধাপে ধাপে উন্নতি সাধিত হবে। আমি এর সাথে সম্পূর্ণ একমত, কিন্তু সেটার লক্ষ্যে কোথাও থেকে শুরু তো করতে হবে। আর এটাই একমাত্র উপায় যাতে করে চলমান সেশনজট চিরতরে দূর করা সম্ভব।
ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি ইউ নিড মোর ল’ইয়ার্স ইন দ্যা কান্ট্রি। কারণ দেশে ১৮ কোটি লোকের বিপরীতে আইনজীবী মাত্র ৫০ হাজার! এটা কোন সংখ্যাই না।
ল’ইয়ার্স ক্লাব: আপনি আসন্ন বার কাউন্সিল নির্বাচনে সাধারণ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, নির্বাচিত হলে আইনজীবীদের পেশাগত দক্ষতা অর্জন ও আইন শিক্ষার মানোন্নয়নে আপনার বিশেষ কোন পরিকল্পনা আছে কিনা?
সাঈদ আহমেদ রাজা: আমার বাবা (সিনিয়র অ্যাডভোকেট আবদুল বাসেত মজুমদার) জীবিত থাকাকালীন সময়ে লাস্ট দুই টার্ম ইলেকশন করেছিলেন। সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে জয়লাভও করেছিলেন। উনার খুব ইচ্ছা ছিল দেশে একটি বিশেষায়িত আইন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা। সকলেই জানেন বার কাউন্সিলের নতুন ভবন নির্মাণের জন্য আমার হাতে লেখানো চিঠি নিয়ে একাই রাষ্ট্রপতির কাছে গিয়ে, প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে অনুমোদন করিয়েছেন। সংশ্লিষ্টদের সামনে তাঁর লিজেন্ডারি হিউমারাস বক্তব্যের মাধ্যমে একনেকের সভায় বার কাউন্সিল ভবনের প্রস্তাব পাস করিয়ে নেন। পরবর্তী কমিটি এসে এই নবর্নিমিত সুরম্য ভবনের কাজ শেষ করেন।
ঠিক একইভাবে বাবার ইচ্ছা ছিল যদি উনার হেলথ পারমিট করত অবশ্যই এই রকম একটা স্বতন্ত্র ফান্ড এনে বাংলাদেশ বার কাউন্সিল অর্ডিন্যান্সের আন্ডারে (সংশোধন করে) একটা বিশেষায়িত আইন বিশ্ববিদ্যালয় করতেন। যে ল’ ইউনিভার্সিটিতে বাংলাদেশে বেস্ট অব দ্যা বেস্ট প্রোডাক্ট বের হত।
ফলে এই বিষয়টি নিয়ে আমার পরিকল্পনা আছে। সুপ্রিম কোর্টের ‘বিজয়-৭১’ ভবন উদ্বোধনকালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্বতন্ত্র আইন বিশ্ববিদ্যালয় প্রসঙ্গে কথা বলেছেন। এই ল’ ইউনিভার্সিটি যে প্রয়োজন সেটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও বুঝতে পেরেছেন। আমি সব সময় এটা বিশ্বাস করি, হঠাৎ করেই একটা জিনিসকে গ্যাস বেলুনের মতো বড় করা যায়না। সোসাইটিও বুঝতে হবে এটা আমাদের জন্য প্রয়োজন।
বিশেষত, আইন ও জাজমেন্ট বিচার বিশ্লেষণে ইন্ডিপেনডেন্ট ডিসকাশন্স অ্যান্ড ফর ইন্ডিপেন্ডেন্ট প্র্যাকটিস স্বতন্ত্র আইন বিশ্ববিদ্যালয় ভীষণ প্রয়োজন। যেন এটি শুধু ইউনিভার্সিটি নয়, ল্যাবরেটরির মতো হয়। আমি যখন শিক্ষার্থী ছিলাম, তখন ভারতের কোর্টের দেওয়া মাইলফলক জাজমেন্টগুলো ক্লাসে সরবরাহ করা হত। ওই বড় বড় জাজমেন্ট যদি ৭০০ পৃষ্ঠার হয়, সেটার ক্রিটিক আমরা লিখতাম ২৭০০ পৃষ্ঠা। হাউ ইউ হ্যাভ গন রং। ওইরকম একটা প্রতিষ্ঠান করা আমার অন্যতম উদ্দেশ্য।
ল’ ইয়ার্স ক্লাব: আমাদের পাঠকদের উদ্দেশ্যে আপনার মূল্যবান সময় দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।