ডেসটিনি মাল্টি-পারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড এর ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের অর্থ ফেরত দিতে সরকারকে ৬ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠনের আদেশ দিয়েছেন আদালত।
আজ বৃহস্পতিবার (১২ মে) রায় ঘোষণার আগে পর্যবেক্ষণে ডেসটিনির ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের অর্থ বিতরণে সরকারকে কমিটি গঠনের বিষয়ে নির্দেশ দেন ঢাকার বিশেষ দায়রা জজ আদালত-৪ এর বিচারক শেখ নাজমুল আলম।
রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ডেসটিনি মাল্টি-পারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড এর সম্পদ তার শেয়ারহোল্ডার এবং বিনিয়োগকারীদের অন্তর্গত। তাদের টাকা উদ্ধারই এই মামলার আসল চ্যালেঞ্জ। রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত সম্পত্তি/অর্থ ডেসটিনির শেয়ারহোল্ডার এবং বিনিয়োগকারীদের ক্ষতিপূরণ বলে গণ্য হবে।
এই মামলার ক্ষেত্রে সমস্ত ধরণের জরিমানা এবং সম্পত্তি/অর্থ বাজেয়াপ্ত করা, ডেসটিনির শেয়ারহোল্ডার এবং বিনিয়োগকারীদের ক্ষতিপূরণ হিসাবে বিবেচিত হবে এবং সরকার কর্তৃক গঠিত একটি কমিটির দ্বারা বিতরণ করা উচিত।
ডেসটিনির ক্ষতিগ্রস্ত শেয়ারহোল্ডার এবং বিনিয়োগকারীদের মধ্যে একটি ন্যায্য, স্বচ্ছ এবং ন্যায়সঙ্গত উপায়ে অর্থ বিতরণ করার জন্য, সরকারকে নিম্নলিখিত দায়িত্বপ্রাপ্তদের প্রতিনিধিত্বসহ একটি ‘কমিটি’ গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে পর্যবেক্ষণে।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে চেয়ারম্যান, অর্থ মন্ত্রণালয়, সমবায় মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিবকে সদস্য, পাশাপাশি একজন ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ, একজন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ও কো-অপারেটিভ বিভাগের নিবন্ধককে সদস্য হিসেবে রাখার কথা বলেছেন বিচারক।
পর্যবেক্ষণে আরও বিচারক বলেন, বাজেয়াপ্তকৃত মোট এবং স্থাবর সম্পত্তি আইনের যথাযথ প্রক্রিয়ায় বিক্রি করার জন্য কমিটিকে ক্ষমতা দেওয়া হবে এবং এর পরিমাণ কমিটির একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হবে। সব অর্থ জমা থাকবে এবং তারপরে বাজেয়াপ্ত করা ব্যাংক হিসাবগুলোর সঙ্গে রাখা সমস্ত পরিমাণের ব্যাংক হিসাবে জমা করা হবে। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে তাদের দেওয়া তালিকা অনুযায়ী অ্যাকাউন্টে নগদ ব্যালেন্সসহ ব্যাংক-অ্যাকাউন্টের আয় জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং এসব অর্থ ডেসটিনি মাল্টি-পারপাস-এর সম্পদ বিতরণ কমিটির দ্বারা তাদের সরবরাহ করা একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা করা হবে।
পর্যবেক্ষণে বলা হয়— ডেসটিনির ব্যাংক এবং অন্যান্য সম্পদের কাছে রাখা সম্পত্তি/পরিমাণ, ইতিমধ্যেই রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে, আর ডেসটিনির অন্তর্গত নয় এবং লিকুইডেটর দ্বারা এর সম্পদ মূল্যায়নের জন্য বাদ দেওয়া হবে। ডেসটিনির ব্যাংকে থাকা উদ্বৃত্ত সম্পদ/পরিমাণগুলো কমিটির কাছে হস্তান্তর করা উচিত এবং কমিটি বিচক্ষণতা ও বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত প্রয়োগ করে ন্যায্য ও ন্যায়সঙ্গত পদ্ধতিতে শেয়ারহোল্ডার এবং বিনিয়োগকারীদের অর্থ প্রদান করে সমস্ত তহবিল সংগ্রহ করবে।
সরকার কমিটির সদস্যদের জন্য একটি সম্মানী নির্ধারণ করবে এবং সম্মানী ডেসটিনি মাল্টি-পারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড এর সম্পদ বিতরণ কমিটির অ্যাকাউন্ট থেকে প্রদান করা হবে বলে।
কার কত দণ্ড
গ্রাহকের অর্থ আত্মসাৎ ও অর্থপাচারের মামলায় ডেসটিনি গ্রুপের ৪৬ জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডসহ দুই হাজার ৩০০ কোটি টাকা অর্থদণ্ড দিয়েছেন আদালত।
রায়ে রফিকুলকে ১২ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। অর্থদণ্ড ২০০ কোটি টাকা; ডেসটিনির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হোসেনকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। অর্থদণ্ড ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা; ডেসটিনির প্রেসিডেন্ট ও সাবেক সেনাপ্রধান এম হারুন-অর-রশীদকে চার বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। অর্থদণ্ড ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা; ডেসটিনির উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোফরানুল হক, সাঈদ-উর-রহমান, পরিচালক মেজবাহ উদ্দিনের ১০ বছর করে কারাদণ্ড, এক কোটি ৮০ লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে দুই বছর ছয় মাসের কারাদণ্ড; সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেনের নয় বছরের কারাদণ্ড, ৩০ কোটি টাকা জরিমানা অনাদায়ে দুই বছরের কারাদণ্ড; ইরফান আহমেদ, ফারাহ দীবা, জমশেদ আরা চৌধুরী, শেখ তৈয়বুর রহমান ও নেপাল চন্দ্র বিশ্বাসের আট বছর করে কারাদণ্ড, ৪০ কোটি টাকা জরিমানা অনাদায়ে দুই বছর কারাদণ্ড; জাকির হোসেন, আজাদ রহমান, আকবর হোসেন সুমন ও সুমন আলী খানের নয় বছর করে কারাদণ্ড, ১২৫ কোটি টাকা জরিমানা অনাদায়ে দুই বছর ছয় মাস কারাদণ্ড; আবুল কালাম আজাদ, সাইফুল ইসলাম রুবেল, শিরীন আকতার, রফিকুল ইসলাম সরকার, মো. মজিবুর রহমান, লে. কর্নেল (অব.) মো. দিদারুল আলমের আট বছর করে কারাদণ্ড, ১২৫ কোটি টাকা জরিমানা অনাদায়ে দুই বছর ছয় মাস কারাদণ্ড; ড. এম হায়দারুজ্জামানের ছয় বছরের কারাদণ্ড, ১০ কোটি টাকা জরিমানা অনাদায়ে এক বছর ছয় মাসের কারাদণ্ড; মোহাম্মদ জয়নাল আবেদীনের ছয় বছরের কারাদণ্ড, পাঁচ কোটি টাকা জরিমানা অনাদায়ে এক বছরের কারাদণ্ড; কাজী মো. ফজলুল করিমের পাঁচ বছরের কারাদণ্ড, ৫০ লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে এক বছরের কারাদণ্ড; মোল্লা আল আমীনের আট বছরের কারাদণ্ড, ১০ লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে ছয় মাসের কারাদণ্ড; শফিউল ইসলামের সাত বছরের কারাদণ্ড, ১০ কোটি টাকা জরিমানা অনাদায়ে এক বছর ছয় মাসের কারাদণ্ড; জিয়াউল হক মোল্লা, খন্দকার কবিরুল ইসলাম, মো. ফিরোজ আলমের পাঁচ বছর করে কারাদণ্ড, ১০ লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে এক বছরের কারাদণ্ড; ওমর ফারুকের পাঁচ বছরের কারাদণ্ড, ২৫ লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে এক বছরের কারাদণ্ড; সুনীল বরণ কর্মকার ওরফে এসবি কর্মকারের আট বছরের কারাদণ্ড, পাঁচ কোটি টাকা জরিমানা অনাদায়ে দুই বছরের কারাদণ্ড; ফরিদ আকতারের আট বছরের কারাদণ্ড, দুই কোটি ৫০ লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে দুই বছরের কারাদণ্ড; এস সহিদুজ্জামান চয়নের আট বছরের কারাদণ্ড, ১৫ কোটি টাকা জরিমানা অনাদায়ে দুই বছরের কারাদণ্ড; আবদুর রহমান তপন ও মো. শফিকুল হকের সাত বছর করে কারাদণ্ড, এককোটি টাকা জরিমানা অনাদায়ে এক বছরের কারাদণ্ড; মেজর (অব.) সাকিবুজ্জামান খান ও জেসমিন আক্তার মিলনের পাঁচ বছর করে কারাদণ্ড, এক কোটি টাকা জরিমানা অনাদায়ে এক বছরের কারাদণ্ড; এসএম আহসানুল কবির, এএইচএম আতাউর রহমান রেজার আট বছর করে কারাদণ্ড, ১০ কোটি টাকা জরিমানা অনাদায়ে দুই বছরের কারাদণ্ড; গোলাম কিবরিয়া মিল্টনের আট বছরের কারাদণ্ড, পাঁচ কোটি টাকা জরিমানা অনাদায়ে দুই বছরের কারাদণ্ড; মো. আতিকুর রহমানের সাত বছরের কারাদণ্ড, পাঁচ কোটি টাকা জরিমানা অনাদায়ে দুই বছরের কারাদণ্ড; খন্দকার বেনজীর আহমেদ, একেএম সফিউল্লাহ, শাহ আলম, মো. দেলোয়ার হোসেনের সাত বছর করে কারাদণ্ড, এক কোটি টাকা জরিমানা অনাদায়ে এক বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
মামলায় ডেসটিনির এমডি রফিকুল আমীনসহ মোট আসামি ৪৬ জন । তাদের মধ্যে জামিনে রয়েছেন- লে. কর্নেল (অব.) মো. দিদারুল আলম, লে. জেনারেল (অব.) হারুন-অর-রশিদ, মিসেস জেসমিন আক্তার (মিলন), জিয়াউল হক মোল্লা ও সাইফুল ইসলাম রুবেল। কারাগারে আছেন এমডি রফিকুল আমীন ও প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হোসেন। অন্য ৩৯ আসামি পলাতক।
মানি লন্ডারিং আইনে পৃথক দুই মামলা
অর্থ আত্মসাৎ ও অর্থপাচারের অভিযোগে দুদকের তৎকালীন উপ-পরিচালক মো. মোজাহার আলী সরদার ও সহকারী পরিচালক মো. তৌফিকুল ইসলাম ২০১২ সালের ৩১ জুলাই রাজধানীর কলাবাগান থানায় মানি লন্ডারিং আইনে পৃথক দুটি মামলা করেছিলেন।
২০১৪ সালের ৪ মে আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করেন মোজাহার আলী সরদার। এতে ডেসটিনির গ্রাহকদের চার হাজার ১১৯ কোটি ২৪ লাখ টাকা আত্মসাৎ করে পাচারের অভিযোগ আনা হয়।
এর মধ্যে ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির মামলায় ৪৬ জন এবং ডেসটিনি ট্রি-প্ল্যানটেশন লিমিটেডে দুর্নীতির মামলায় ১৯ জনকে আসামি করা হয়। দুই মামলায়-ই আসামি হারুন-অর-রশিদ ও রফিকুল আমিন।
মামলার অভিযোগপত্রে যা বলা হয়
২০০৮ সাল থেকে মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ প্রজেক্টের নামে ডেসটিনি বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে এক হাজার ৯০১ কোটি টাকা। সেখান থেকে এক হাজার ৮৬১ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয় বলে দুদকের অনুসন্ধানে ধরা পড়ে। ওই অর্থ আত্মসাতের ফলে সাড়ে ৮ লাখ বিনিয়োগকারী ক্ষতির মুখে পড়েন।
ডেসটিনি ট্রি-প্ল্যানটেশন প্রজেক্টের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে দুই হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে দুই হাজার ২৫৭ কোটি ৭৮ লাখ ৭৭ হাজার টাকা আত্মসাৎ করা হয়। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হন সাড়ে ১৭ লাখ বিনিয়োগকারী।
অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, ডেসটিনি গ্রুপের নামে ২৮টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বেশ কয়েকটি ছিল নামসর্বস্ব। আসামিরা প্রথমে প্রজেক্টের টাকা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হিসাবে জমা করতেন। এরপর বিভিন্ন ব্যাংকের হিসাবে তা স্থানান্তর করা হতো। দুদক ৩৪টি ব্যাংকে এমন ৭২২টি হিসাবের সন্ধান পায়, যেগুলো পরে জব্দ করা হয়।