৯৮ সালের কথা, রূপার বয়স ১০ বছর। বাবা সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। তার বাবা-মা দুজনেই কথা বলতে পারেন না। তাই তারা হাউমাউ করে চিকিৎসককে কী বোঝাতে চেয়েছেন, চিকিৎসক তার কিছুই বুঝতে পারেননি। চিকিৎসা চলাকালে ৯ দিনের দিন তিনি মারা যান।
রূপা বলেন, চিকিৎসকরা বলেছিলেন আমার বাবা-মায়ের ভাষা যদি তারা বুঝতে পারতেন, তবে তার চিকিৎসা করা সহজ হতো। অনেক পরীক্ষানিরীক্ষা করে তার অসুবিধা সম্পর্কে জানা যেত।
রূপা বলেন, ২৪ বছরেও দেশের হাসপাতাল কিংবা আদালতে কোথাও ইশারা ভাষা অন্তর্ভুক্ত করার নজির নেই।
এমন বাস্তবতার মধ্যে ‘বাংলা ইশারা ভাষা প্রচলন, বাক ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী ব্যক্তির জীবনমান উন্নয়ন’কে প্রতিপাদ্য করে আজ ৭ ফেব্রুয়ারি দেশ জুড়ে পালিত হচ্ছে ‘বাংলা ইশারা ভাষা দিবস-২০২৩’।
বিজ্ঞজনেরা বলেন, অল্প করে হলেও দেশে ইশারা ভাষা ব্যবহার শুরু হয়েছে, কিন্তু তার কোনো মানদণ্ড নেই। বেসরকারিভাবে কিছু প্রতিষ্ঠান এক্ষেত্রে কাজ করছে। তাই সরকারের ইনস্টিটিউট যেমন—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের দায়িত্ব নিলে একটি মানসম্পন্ন ইশারা ভাষার প্রচলন হবে। আর হাসপাতাল, আদালত ও রেল স্টেশন, বিমানবন্দরে ইশারাভাষী নিয়োগ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা।
ইশারা ভাষা যারা শিখছেন
সেই রূপার পুরো নাম শিরিণ আক্তার রূপা। সে এখন বাংলাদেশ টেলিভিশনের একজন ইশারা ভাষা উপস্থাপক। রূপা বলেন, বাবা-মায়ের পাশাপাশি আমার মা-খালাদের তিন জন কথা বলতে পারতেন না। আমি তাদের সঙ্গে ইশারায় কথা বলতে বলতে এই ভাষা শিখে ফেলি।
বাংলাদেশ টেলিভিশনে কাজ করছেন আরাফাত সুলতানা লতা। তার বাবা-মা দুই জনেই কথা বলতে পারেন না। লতা জানান, বিটিভিতে আট জন ইশারাভাষী সংবাদ উপস্থাপনা করেন, তাদের মধ্যে পাঁচ জন মেয়ে। তাদের সবার বাবা-মা কথা বলতে পারেন না। বেসরকারি টেলিভিশন দেশ টিভিতে তিন জন ইশারাভাষী কাজ করছেন। মোট ১১ জন গণমাধ্যমে কাজ করছেন।
জানা গেছে, ২০০৪ সাল থেকে পাক্ষিক বার্তায় বিটিভিতে ইশারা ভাষা উপস্থাপন শুরু হয়। ২০০৯ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী বইমেলা উদ্বোধনকালে সব গণমাধ্যমে ইশারা ভাষা ব্যবহারের নির্দেশ দেন। তখন থেকে বিটিভির প্রতিটি সংবাদ ইশারাভাষীরাও উপস্থাপন করেন। কেবল দুটি গণমাধ্যমে মোট ১১ জন ইশারাভাষী কাজ করেন। সংশ্লিষ্টরা বলেন, এখন ইশারা ভাষার প্রচলন বাড়ছে, দু-একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখানো হচ্ছে।
ব্যবহার বাড়ানোর তাগিদ
শিরিণ আক্তরা রূপা বলেন, একটি প্রতিবন্ধী মেয়ে ধর্ষণ হয়। তার বিচারকাজ পরিচালনার সময় আমাকে আদালতে ডাকা হয়। কারণ সে তার কথার মধ্য দিয়ে কাউকেই কিছু বোঝাতে পারছিল না। ফলে বিচার প্রক্রিয়া বিলম্বিত হচ্ছিল।
ইশারাভাষীরা বলেন, রেল স্টেশন, বিমানবন্দর, আদালত এবং হাসপাতালে একজন ইশারাভাষী বিশেষ প্রয়োজন। তা না হলে বাকপ্রতিবন্ধী ও বধির ব্যক্তিরা সমস্যায় পড়েন। এই সমস্যা উভয় পক্ষেরই বলে মনে করেন তারা।
সংশ্লিষ্টরা যা বলেন
বাংলাদেশ জাতীয় বধির সংস্থার তথ্যমতে, পাঁচ শতাধিক ব্যক্তিকে এই সংস্থা ইশারা ভাষা প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এদের মধ্যে ৩০ শতাংশ কাজে প্রবেশ করলেও তারা কেউ শুধু ইশারা ভাষাকে পেশা হিসেবে নিতে পারেনি। তারা অনেকেই দুই-তিন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন।
সংস্থার ইশারা ভাষা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ পরিচালক মনোয়ার হোসেন বলেন, অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশের জন্য ইশারা ভাষাকে গুরুত্ব সহকারে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং এর মান মূল্যায়ন জরুরি। সেবামূলক সকল প্রতিষ্ঠানে ইশারাভাষীর বিকল্প নেই। তা না হলে উন্নয়ন পূর্ণ হবে না। ১৯৯৪ সালে নরওয়ের অর্থায়নে বাংলাদেশ জাতীয় বধির সংস্থা ও সমাজ কল্যাণ অধিদপ্তর প্রথম ইশার ভাষার অভিধান প্রকাশ করে।
সরকারি তথ্য মতে, বর্তমানে মোট আটটি বাক-শ্রবণপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয় রয়েছে, যেখানে মোট আসনসংখ্যা ৭৫০টি। সরকারের চলমান হিসাব মতে, দেশে এক লাখ ৮২ হাজার ১১৩ জন বাক ও এক লাখ ১৩ হাজার ৫২ জন শ্রবণপ্রতিবন্ধী আছে।
সোসাইটি ফর দ্য ওয়েলফেয়ার অব দ্য ইন্টেলেকচুয়ালি ডিজঅ্যাবলড, বাংলাদেশ (সুইড বাংলাদেশ)-এর মেন্টর জওয়াহেরুল ইসলাম মামুন বলেন, এখন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ইশারা ভাষাকে বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। সরকার দিবসটি ঘোষণা করেছে এবং সচেতনতা বৃদ্ধির আলোচনাও করছে। কিন্তু কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে এর সুফল থেকে বঞ্চিত হতে হবে।
সূত্র : ইত্তেফাক