শফিকুল ইসলাম: ব্যভিচার ঘৃণিত অপরাধ। ব্যভিচার ইসলাম ধর্মে অত্যন্ত ঘৃণিত অপরাধ। এটি একটি সমাজ বিধ্বংসী অপরাধ। পরকীয়া এবং ব্যভিচারের কারণে অনেক পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে। বর্তমান সময়ে ডিভোর্সের একটি অন্যতম বড় কারণ পরকীয়া ও ব্যভিচার। ব্যভিচার ইসলামের দৃষ্টিতে এত বড় একটি জঘন্য অপরাধ যে ইসলাম ধর্মে বিবাহিত কেউ ব্যভিচার করলে তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড ধার্য করেছে।
প্রচলিত আইনে ব্যভিচারের শাস্তি
বাংলাদেশের পরকীয়া সম্পর্কিত আইন দণ্ডবিধি, ১৮৬০ এর ধারা ৪৯৭ এ উল্লেখ আছে। ধারাটিতে ব্যভিচারের শাস্তি ঘোষণা করা হয়েছে। যে ব্যক্তি অনুরূপ অপরাধে দোষী হবেন তার শাস্তি সর্বোচ্চ ৫ বছরের কারাদণ্ড বা অর্থদন্ড অথবা উভয়দণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন।
এই ধারার সীমাবদ্ধতা
বর্তমানে বাংলাদেশে বলবৎ এই ধারাটি অনেকগুলো সীমাবদ্ধতার দোষে দুষ্ট।
প্রথমত, এই ধারাটিতে স্পষ্টভাবে বলে দেওয়া আছে “অনুরূপ অপরাধ সংঘটনের ক্ষেত্রে স্ত্রীলোকটিকে দুষ্কর্মের সহায়তা কারিনী হিসাবে দণ্ড প্রদান করা যাবে না।” তাছাড়া এই ধারায় শুধুমাত্র পুরুষ ব্যভিচারীর শাস্তির কথা উল্লেখ আছে কিন্তু এই ধারার অধীন যে স্ত্রীলোকের সাথে সে এই হীন কাজটি করেছে সেই স্ত্রীলোককে কোনভাবেই এই ধারার অধীনে কিংবা অন্যকোন ধারায় শাস্তির আওতায় আনা যাচ্ছে না।
যদিও বর্তমান সমাজে পরকীয়া অপরাধ সংঘঠিত হওয়ার পিছনে অনেক ঘটনায় পুরুষের চেয়ে নারীর ভূমিকা বেশি থাকে। কিন্তু আইন শুধু পুরুষটিকেই সমস্ত দোষের ও শাস্তির ভাগ দিচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, এই ধারার আরেকটি সীমাবদ্ধতা হল এখানে বলা হয়েছে যে, “যদি কোন ব্যক্তি অন্য লোকের স্ত্রী অথবা যাকে সে অন্যলোকের স্ত্রী বলে জানে বা অনুরূপ বিশ্বাস করার কারণ আছে, এমন কোন স্ত্রীলোকের সাথে যদি উক্ত ব্যক্তির অনুমতি ব্যতীত কেহ সহবাস করে যা ধর্ষণ নয় তবে সে ব্যক্তি ব্যভিচারের অপরাধে দোষী হবে।” এই কথায় এটা স্পষ্ট যে নারীর সাথে এরকম পরকীয়া করা হচ্ছে সেই নারীকে অবশ্যই বিবাহিত হতে হবে। যদি সে মেয়েটি অবিবাহিত হয় এবং পুরুষলোকটি বিবাহিতও হয় তবে এইক্ষেত্রে ব্যভিচারের অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে না! এ রকম একপেশে আইনের ফলে উচ্চবিত্ত সমাজে ‘সুগারড্যাডি’র মত কুরুচিপূর্ণ কালচার গড়ে ওঠার সাহস পাচ্ছে।
তাছাড়া ধারাটির মধ্যেও একটি কুরুচিপূর্ণ বিষয় লুকায়িত আছে।যে বিবাহিত মহিলার সাথে পরপুরুষ সহবাস করছে সেই পুরুষ যদি উক্ত মহিলার স্বামীর থেকে অনুমতি নিয়ে সহবাস করে তাহলেও তা এইআইনের অধীনে ব্যভিচারের অপরাধ হচ্ছে না। এখন একজন স্বামী তার স্ত্রীকে পরপুরুষের সাথে এসবের অনুমতি দিবে কিনা সেই আলোচনা এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। বরং বিষয় নিয়ে চিন্তা ভাবনা অত্যন্ত কুরুচিপূর্ণ সেটা বলাই যায়।
সংবিধানের সাথে অসামঞ্জস্যতা
সংবিধানের অনেকগুলো বিধানের সাথে এই রকম একপেশে আইন অসামঞ্জস্যপূর্ণ।
প্রথমত, এই আইনটি সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৭ আইনের দৃষ্টিতে সমতা সেই সমতা রক্ষা করছে না। শুধু পুরুষকেই দোষী করছে।এছাড়া সংবিধানের বিধান মতে কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী পুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করবেন না। কিন্তু দণ্ডবিধির এই ধারায় আমরা উপরের আলোচনায় দেখেছি কিভাবে বৈষম্য করা হয়েছে।
এছাড়া আমাদের সংবিধান শুরু হয়েছে “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম”এর পর থেকে এবং রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হিসাবে রাষ্ট্রের দায়িত্ব ইসলামিক মূল্যবোধের প্রতি সম্মান দেখানো এবং ইসলামের মূল্যবোধের বিপরীতে কোন আইন না করা।
মন্তব্য
বৃটিশরা যখন এই আইনটি তৈরী করেছিল তখন মহিলাদের সামাজিক অবস্থানের কারণে হয়তো এটা কল্পনীয় ছিল যে শুধু পুরুষরাই মহিলাদের প্ররোচিত করবে ব্যভিচারের দিকে। আর এই ব্যভিচার কোন বিবাহিত মহিলার সাথে হলেই সমস্যা বলে বিবেচিত। যদিও এটি আমার ধারণা
এছাড়া আমাদের ইতিহাস ও সংস্কৃতির ও সমাজব্যবস্থা এবং ধর্মের মূল্যবোধের নিরিখে পরকীয়া প্রেম এবং ব্যভিচার যেকারো সাথে; হোক বিবাহিত বা অবিবাহিত, পুরুষ অথবা মহিলা, বিবাহবহির্ভূত যৌন সম্পর্ক এদেশের হিন্দু মুসলিম সকল সমাজেই সকল আঙ্গিকেই নিষিদ্ধ এবং ব্যভিচার হিসাবে গণ্য। কিন্তু আইন তা স্বীকৃতি দিচ্ছে না।
ভারতে সম্প্রতি দণ্ডবিধির এই ধারাটি অসাংবিধানিক বলে বাতিল করেছে দেশটির সুপ্রীম কোর্ট। ভারতের সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি খান উইলকারের মন্তব্য ছিল যে এই ধারাটি বৈষম্যমূলক এবং সমতার অধিকার এখানে লঙ্ঘিত হচ্ছে।
যেহেতু দণ্ডবিধির ধারাটি বৃটিশদের করা তাই বর্তমানে উচিৎ এইধারাটির সংস্কার করাও যুগোপযোগী করে সংশোধন করা। মেয়েরা এখন অনেক এগিয়ে গেছে। তাই বর্তমানে শুধু ব্যভিচারের জন্য পুরুষকে দায়ী করে শাস্তি দেওয়া বৈষম্যমূলক।
লেখক: শিক্ষানবীশ আইনজীবী; জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ঢাকা।