মো: সাইফুল ইসলাম পলাশ:
তিন মাস হাজতবাসের পর জানা গেল আসামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ জামিনযোগ্য এবং গ্রাম আদালত কর্তৃক বিচার্য। তদন্ত পরবর্তী সময়ে প্রায়ই কোদাল, রামদা, হাসুয়া হয়ে যায় ভোতা অস্ত্র (blunt weapon), আর গুরুতর আঘাত (grievous hurt) হয়ে যায় সাধারণ আঘাত (simple hurt)। আমরা যারা আইন অঙ্গনে কাজ করি তারা কম-বেশি সকলেই এ ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি। এমন ক্ষেত্রে জখমীদের হাসপাতালের ছাড়পত্র (discharge certificate) নির্দোষ ব্যক্তিদের অন্যায্য কারাবাস থেকে রেহাই দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
ফৌজদারী মামলার শুরুতে এ ধরনের অপরাধের গুরুত্ব ও প্রকৃতি বোঝার মত কোনো চিকিৎসা ও আইন সংক্রান্ত (medico-legal) ডকুমেন্ট থাকে না। কিন্তু আমাদের হাতের কাছেই থাকে হাসপাতালের ছাড়পত্র। এই গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্টটাকে কিভাবে আইন অঙ্গনে ব্যবহার করা যায় সেটা নিয়েই আজ কথা বলব।
আমরা সবাই জানি, সাধারণত রোগীকে যখন হাসপাতাল থেকে ছুটি দেওয়া হয় তখন তাকে একটি ছাড়পত্র (discharge certificate) দেওয়া হয়। চিকিৎসকগণ বাংলাদেশ ফরম নং-৮১৭ তে এটি লিখে থাকেন। এতে রোগীর নাম, বয়স, পিতা/স্বামী, ঠিকানা, হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট বিভাগ, ওয়ার্ড, বেড নং, চিকিৎসার সময়কাল এবং রোগের নাম সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ পূর্বক সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক তারিখসহ স্বাক্ষর প্রদান করেন। শুধু তাই নয়, রোগী কি সমস্যা নিয়ে এসেছিলেন, প্রাথমিকভাবে পরীক্ষা করে কি অবস্থা পাওয়া গেছে, কি কি টেস্ট করানো হয়েছে এবং সেগুলোর ফলাফল কি, অপারেশন হয়ে থাকলে তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ, কি কি ওষুধ কত দিন যাবৎ সেবন করবেন এবং পরবর্তীতে কতদিন পর জখমের সেলাই কাটতে হবে বা হাসপাতালে আসতে হবে- এই বিষয়গুলিও লিপিবদ্ধ থাকে। এজন্য এই ছাড়পত্রটি শুধু রোগীর চিকিৎসার জন্য নয়, আইনগত সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রেও বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।
একটা সময় ছিল যখন জখমীকে হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণের সাথে সাথে চিকিৎসক তাকে মেডিকেল সার্টিফিকেট (এমসি) প্রদান করতেন। এটার কিছু ভালো দিক থাকলেও অনেকে এটার অপব্যবহার করেছিল। ফলশ্রুতিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর একাধিক পরিপত্রের মাধ্যমে নির্দেশনা দেন যে, কর্তৃপক্ষের চাহিদাপত্র ব্যতীত এবং ০৩ সদস্য বিশিষ্ট মেডিকেল বোর্ড কর্তৃক জখমীর পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পরীক্ষা ব্যতীত কোনক্রমেই এমসি প্রদান করা যাবে না। তবে পুলিশ রেফারেন্স ছাড়াও ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের শিকার কোনো নারী ও শিশুর ক্ষেত্রে এমসি প্রদান করার জন্য নির্দেশনা রয়েছে।
এভাবে মামলা দায়েরের পর আদালত বা তদন্তকারী সংস্থার এরূপ চাহিদাপত্র প্রাপ্তি, জখমীর জন্য বোর্ড গঠন ও পরীক্ষা নিরীক্ষা করা, এমসিসহ ফরোয়ার্ডিং প্রস্তুতকরণ এবং তা ডাকযোগে প্রেরণ ইত্যাদি নিয়মাবলী মেনে চলতে দীর্ঘ সময় কেটে যায়। অধিকাংশ মামলার এজাহার বা নালিশে সত্য-মিথ্যার সংমিশ্রণে যে অতিরঞ্জিত বক্তব্য থাকে তা শুরুতেই প্রাথমিকভাবে সত্যতা নিরূপণের জন্য এমন একটা মেডিকো-লিগ্যাল রিপোর্ট আবশ্যক হয়ে দাঁড়ায়।
এরূপ পরিস্থিতিতে নির্দোষ ব্যক্তির অন্যায্য কারাবাস রোধের লক্ষ্যে আমরা জেলার বিভিন্ন হাসপাতালের বেশ কিছু ছাড়পত্র সংগ্রহ করলাম। সেগুলো পর্যালোচনায় দেখা গেল, মারামারির মামলাগুলোর জখমীর ছাড়পত্রে কি রোগে ভূগছিলেন এর জায়গায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে physical assault লেখা থাকে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, পেটে ছুরি মারলেও যা লিখা হয়, মাথা ফাটলেও বা হাড়ভাঙ্গা জখম হলেও একই কথা লেখা হয়। কিন্তু শরীরের কোথায় জখম হয়েছে, ক্ষতের পরিমাণ, অস্ত্রের প্রকৃতি ইত্যাদি বিষয় উল্লেখ থাকে না।
অথচ এক্ষেত্রে রোগীর ছাড়পত্রের জখমের সংক্ষিপ্ত বিবরণ, চিকিৎসার সময়কাল ও অন্যান্য বিবরণ থাকলে শুধু ভালো মামলা গুলোই এজাহার হিসেবে রেকর্ড হবে এবং জামিন শুনানীকালেও সেগুলো বিজ্ঞ বিচারক ছাড়পত্রে বর্ণিত ইনজুরি নোট বিবেচনায় নিতে পারেন। ফলে যে আসামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছাড়পত্রে বর্ণিত ইনজুরি নোট দ্বারা সমর্থিত নয়, তিনি অন্যায্য কারাবাসের সম্মুখীন হবে না। তাছাড়া প্রকৃত জখমের সাথে মেডিকেল সার্টিফিকেটে বর্ণিত জখমের হেরফের পরিলক্ষিত হলে নারাজি শুনানির সময়ও বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট তা বিবেচনায় নিতে পারেন।
যেকোনো সংকটজনক পরিস্থিতির চটজলদি সমাধান নেই। একটি সিস্টেমের মাঝে কোনো বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হলে প্রয়োজন পরিকল্পিত কর্মসূচি ও ফলোআপ। যেই ভাবনা সেই কাজ। বিষয়টি সমাধানের জন্য মাসিক পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেসি কনফারেন্সে এজেন্ডা আকারে উপস্থাপন করা হলো। উক্ত সভার সভাপতি মাননীয় চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ইকবাল বাহার মহোদয় তাৎক্ষণিকভাবে পরবর্তী সভায় সিভিল সার্জন, জেলার সকল উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ক কর্মকর্তা, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালকগণকে উপস্থিত থাকার জন্য বিশেষভাবে আহবান করলেন। পরবর্তী সভায় চিকিৎসকরা ইনজুরি নোট লেখার ব্যাপারে প্রথমে আপত্তি জানালেও পরে বিষয়টির গুরুত্ব বুঝে একমত পোষণ করলেন।
সৌভাগ্যক্রমে সেদিন কনফারেন্সে পেয়েছিলাম রাজশাহীর মাননীয় সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ আব্দুর রহিম মহোদয়কে। তিনি সকল চিকিৎসককে ছাড়পত্রে ছোট করে হলেও ইনজুরি নোট লেখার নির্দেশ দিলেন। ফলোআপের জন্য পরের মিটিংয়ে সকল আমলী আদালত থেকে ইতোমধ্যে দায়েরকৃত মামলার জখমীর ছাড়পত্রের কপি সংগ্রহ করা হলো। দেখা গেল, মাত্র ৩/৪ টি হাসপাতাল অনিয়মিতভাবে নির্দেশনা মেনে চলছে।
এটি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমরা দেখেছি, নানা কারণে ছাড়পত্রে সবগুলো তথ্য সঠিকভাবে তুলে ধরা হয় না। যেমন, কোন কোন ছাড়পত্রে ইউনিটের নাম, রেজিস্ট্রেশন নম্বর, পূর্ণ নাম, বয়স, লিঙ্গ, ঠিকানা, মেডিকেল অফিসার বা ইউনিট প্রধানের সীলসহ নাম ইত্যাদি অসম্পূর্ণ থাকে। মেডিকেল অফিসারের পূর্ণাঙ্গ নামযুক্ত সীলসহ সাক্ষর প্রদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এরূপ সীল ছাড়া ছাড়পত্র ইস্যু করলে জালিয়াত চক্রের ভুয়া ছাড়পত্র তৈরি করে অন্যায় সুবিধা লাভের সুযোগ হয়। প্রতিপক্ষকে হয়রানি বা অন্যায় সুবিধা লাভের জন্য ভুয়া ছাড়পত্র ব্যবহারের কারণে রাজশাহী, নাটোরসহ একাধিক জেলায় মামলাও হতে দেখেছি।
পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেসি কনফারেন্সে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরেও যখন কাজ হচ্ছে না তখন পরবর্তী সভায় প্রস্তুাব দিলাম, আমাদের সভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য সিভিল সার্জন ও রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল দাপ্তরিকভাবে বিশেষ নির্দেশনা জারী করবেন। সভার পর সভার ফোকাল পারসন জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মারুফ আল্লাম একটি চিঠি প্রস্তুত করলেন এবং দুই কর্তৃপক্ষের সাথে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করলেন।
একের পর এক নিরলস ফলোআপ দিয়ে অবশেষে গত ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ তারিখে রাজশাহীর সিভিল সার্জন মহোদয় জেলার সকল উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ক কর্মকর্তাদের জখমী ব্যক্তিদের হাসপাতালের ছাড়পত্রে আবশ্যিকভাবে ইনজুরির নোট লিপিবদ্ধ করার নির্দেশনা জারি করেন। একইভাবে ২১ সেপ্টেম্বর রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক মহোদয় একই নির্দেশনা জারি করেন।
এভাবে রাজশাহী জেলায় জখমীদের ছাড়পত্রের সংক্ষিপ্ত ইনজুরি নোট একটি স্থায়ী রূপ লাভ করেছে। এখন হাসপাতালের ছাড়পত্র যেন একটি মিনি মেডিকেল সার্টিফিকেট। তবে দেশব্যাপী এর উপর সুফল লাভের জন্য স্থানীয় কর্তৃপক্ষের জেলায় জেলায় নির্দেশনা জারি যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরের বিশেষ নির্দেশনা সম্বলিত পরিপত্র। পাশাপাশি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ও এমসি লিপিবদ্ধ করার গাইডলাইন বা অনুসরণীয় নীতিমালাও প্রণয়ন করা যেতে পারে। এছাড়া তাৎক্ষণিকভাবে এমন নোটসহ ছাড়পত্র প্রদানে ঝুকি মোকাবেলায় চিকিৎসকগণের নিরাপত্তার বিষয়টিও বিবেচনায় নিতে হবে।
এছাড়া সম্প্রতি সরকার দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগীর স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত তথ্যের একটি কেন্দ্রীয় ডিজিটাল তথ্যভান্ডার চালু করার পরিকল্পনা করেছে। এই ইলেকট্রনিক ডেটা যেকোনো সময় সমস্ত হাসপাতাল থেকে দেখা ও সংগ্রহ করা যাবে। গুরুত্বপূর্ণ এই ডাটাবেজে ইনজুরি নোট সংযোজন করা হলে নিঃসন্দেহে মেডিকো-লিগ্যাল সেবায় আরও স্বচ্ছতা ও গুণগত মান বাড়বে। পাশাপাশি কারাবন্দীর সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য হারে কমবে।
জখমীর ছাড়পত্র একটি গুরুত্বপূর্ণ মেডিকো-লিগ্যাল ডকুমেন্ট। আমাদের দেশে হাসপাতালের ছাড়পত্রে ইনজুরি নোটের সংযোজন করতে কিছু সীমাবদ্ধতা ও প্রতিবন্ধকতা থাকলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃঢ়তা ও সদিচ্ছাই পারে বিদ্যমান সকল বাঁধা দূর করে আইন অঙ্গনে নব দিগন্তের উন্মোচন করতে।
লেখক: অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, রাজশাহী।