মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম: বাংলাদেশে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ নিয়ে বিগত কয়েক দশকে দলীয়করণ, স্বজনপ্রীতি ও অস্বচ্ছতার মারাত্মক অভিযোগ রয়েছে। বিচার সংশ্লিষ্টদের মাঝে তথা মানুষের মনে কোন সন্দেহ রেখে বিচারক নিয়োগদান কোনদিন সুখকর নয়। বিষয়টি আরও সুস্পষ্ট হয়েছে ০৫ আগষ্ট স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ সরকারের পতনের পরে। রাজনীতির প্রেক্ষাপট বদলে রাজনৈতিক নেতাদের মতো বিচারকদের যা অবস্থা হয়েছে তা কোনভাবেই কাম্য নয়। মোটাদাগে আইনের শাসনের পরিপন্থি ও বটে। যদিও আমাদের দেশে বিচারালয় নিয়ে রাজনীতির চর্চা নতুন নয় তবে সকলেরই উচিত বিচার বিভাগকে রাজনীতির বাইরে রাখা।সকল বিতর্কের উর্দ্ধে রাখা। মনে রাখতে হবে বিচারালয় হলো মানুষের ভরসার শেষ আশ্রস্থল। উচ্চ আদালতে আইন জানা, দক্ষ এবং যোগ্য বিচারক নিয়োগ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শর্ত।
বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতির সাথে পরামর্শের পর এ নিয়োগ দেন। সংবিধানে বিচারক নিয়োগে কিছু সুনির্দিষ্ট শর্তাবলীর উল্লেখ আছে। তাছাড়াও ৯৫(২)(গ) নং অনুচ্ছেদ মতে আইনের দ্বারা শর্তাবলী নির্ধারণের বিষয় রয়েছে। বিগত পঞ্চাশ বছরে এই উপ-অনুচ্ছেদের অধীনে আজও কোন আইন প্রণয়ন করা হয়নি। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৫ (২) (গ) এর অধীনে বিচারক নিয়োগের নতুন শর্তাবলী নির্ধারণ সম্বলিত আইন প্রণয়ন ব্যতীত রাষ্ট্রপতির প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ এবং এমন পরামর্শের ফলাফল কি, এবং ৯৫ (২) (খ) নং অনুচ্ছেদ মতে অধস্থন আদালতের বিচারক হিসেবে চাকুরীর ১০ বছর অথবা ৯৫ (২) (ক)নং অনুচ্ছেদ মতে সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী হিসেবে অভিজ্ঞতার ১০ বছর, কিভাবে গণনা করা হবে, অভিজ্ঞতা বা চাকুরীর মেয়াদের সাথে অতিরিক্ত কোন শর্ত যোগ হবে কি-না তা সরকার আইন বা অধ্যাদেশ বা ঘোষণা দ্বারা নির্ধারণ করতে পারেন।
যুক্তরাজ্য তার সাতশত বছরের ইতিহাস ভেঙ্গে ২০০৬ সালে এবং পাকিস্থান তার সংবিধানের অষ্টাদশতম সংশোধনীর মাধ্যমে ২০১০ সালে বিচারক নিয়োগের সুপারিশের জন্য বিশেষ বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠনের ব্যবস্থা করেছে। তবে অষ্ট্রেলিয়া ও কানাডায় বিচার বিভাগীয় নিয়োগ পুরোপুরি নির্বাহী ক্ষমতার অন্তর্গত, যদিও তা নিয়োগকৃতদের একাডেমিক, পেশাগত ও ব্যক্তি চরিত্রগত গুণাবলীর প্রয়োজন সম্বলিত নীতিমালা দ্বারা শর্তায়িত। আমাদের দেশে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে যত সমস্যা ।
মোটাদাগে বিচার বিভাগ তথা আমাদের উচ্চ আদালতে প্রধানত ৪/৫ টি সমস্যা দেখি। তা হলো প্রথমত, বিচারক নিয়োগে চরম অস্বচ্ছতা, স্বেচ্ছাচারিতা ও দলীয়করণ; দ্বিতীয়ত, বিচারিক কাজে নির্বাহী বিভাগের প্রভাব; তৃতীয়ত, উচ্চাদালতের সহায়ক কর্মচারীদের বেপরোয়া দুর্নীতি ও আদালত ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা; চতুর্থত, মামলা নিষ্পত্তিতে অনাকাঙ্খিত বিলম্ব; এবং পঞ্চমত, বিচারকদের সাংবিধানিক শপথের প্রতি অঙ্গিকারের অভাব। তবে এতসব সমস্যার মধ্যে আজকের আলোচ্য বিষয় থাকবে বিচারক নিয়োগে সীমাহীন অস্বচ্ছতা, স্বেচ্ছাচারিতা ও দলীকরণ নিয়ে।
প্রথমত- বিচারক নিয়োগে সীমাহীন অস্বচ্ছতা, স্বেচ্ছাচারিতা ও দলীয়করণ, এটা একটা বিরাট সমস্যা। উচ্চ আদালত সংশ্লিষ্টরা বলছে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘ শাসনামলে আমলে সংবিধান এর ৯৫ (১) অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রপতি হাইকোর্ট এ ৭০ জন এর অধিক অস্থায়ী বিচারক নিয়োগ দেন। যারা প্রায় সকলেই আওয়ামী লীগ সরকারের ও দলের ঘনিষ্ট এবং ছাত্র জীবনে ও পেশা জীবনে পেশাজীবী লেজুরবৃত্তিক রাজনীতির সাথে জড়িত ছিল তাদেরকে হাইকোর্ট এর বিচারক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করে। দীর্ঘ শাসনামলে আওয়ামীলীগ সরকার ০২ জন বিচারক নিয়োগের মাধ্যমে গত ৩০/০৬/২০০৯ খ্রিঃ তারিখে প্রথম হাইকোর্ট বিভাগে অস্থায়ী বিচারক নিয়োগ শুরু করে।
এছাড়া ১৮/০৪/২০১০ তারিখে ০৭ জন, ৪/১১/২০১০ তারিখে ০৪ জন, ১২/১২/২০১০ তারিখে ০২ জন, ২০/১০/২০১১ তারিখে ০৮ জন, ১৪/০৬/২০১২ তারিখে ০৫ জন, ১২/০২/২০১৫ তারিখে ০৫ জন, ৩১/০৫/২০১৮ তারিখে ১৭ জন, ২১/১০/২০১৯ তারিখে ১০ জন এবং সর্বশেষ ৩১/০৭/২০২২ তারিখে ১১ জন। সংবিধান ও আইনানুযায়ী উচ্চ আদালতে বিচারকগণ অস্থায়ী ভিত্তিতে ০২ বছরের জন্য নিয়োগ পান। অনেক সময় দেখা যায় ০২ বছর পরে যখন স্থায়ীকরণ হয় তখন একের অধিক বিচারককে স্থায়ী করা হয়না তা অনেকেরই জানা। এখানে অস্থায়ী বিচারককে স্থায়ী না করার পিছনে কিছু নিয়ামক কাজ করে। যেমন যখন যে সরকার নিয়োগ দেন বিচারকালে যদি উক্ত বিচারক দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়ন না করেন বা যদি নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষকে সন্তষ্ট করতে ব্যর্থ হন বা তার বিরুদ্ধে যদি করাপশনের অভিযোগ পাওয়া যায় ইত্যাদি। যেহেতু রাষ্ট্রপতি ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স অনুযায়ী ০১ নং ব্যাক্তি ফলে তিনি কাকে স্থায়ী করবেন আর কাকে করবেন তা জিজ্ঞাসা করা যায় না। বিধায় কি কারণে কাউকে বিচারপতি পদে স্থায়ী করা হয়না তা অজানা থাকে। অনেকে স্থায়ী বিচারপতি হতে না পেরে রীট দায়ের করে থাকেন তবে তাতে খুব একটা যে লাভ হয়েছে তা প্রতীয়মান হয়নি।
বিগত ২০১৪ সনে হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারক জনাব এ, বি, এম আলতাফ হোসেন এবং ২০১৭ সনে জনাব ফরিদ আহমেদ শিবলী কে প্রধান বিচারপতির অনুমোদন বা মতামত থাকা সত্ত্বেও সরকার হাইকোর্ট বিভাগে স্থায়ী বিচারকপদে নিয়োগ করেনি। এ বিষয়গুলো থেকে দায়েরকৃত রীট আবেদন থেকে আপীল বিভাগে একটি নিয়মিত আপীল এবং লীভ-টু-আপীল দায়ের হয়। এ দুটি মামলা এবং আরেকটি লীভ-টু-আপীল একত্রে শুনানী হয়। ২০২৩ সনের মাঝামাঝি সময়ে শুনানী চলাকালে তৎকালীন একজন বিচারক(সম্প্রতি প্রধান বিচারপতি পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন)বললেন আমরা কিভাবে বিচারক পদে নিয়োগ পেয়েছি তা কি বলতে পারব?পরবর্তীতে এই রীটে কি হয় তা জানা যায়নি।
বিএনপির বিগত শাসন আমলে উচ্চাদালতে কিছু বিচারক নিয়োগ করা হয়েছিল। তার মধ্যে একজন ছিলেন বাগেরহাট কোস্টার মালিক সমিতির ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং আরেকজনকে দূতাবাস পাড়ায় একটি দূতাবাসের দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়ার সময় পুলিশ আটক করলে তিনি তার পরিচয় দেন এবং পুলিশ তা নিশ্চিত হয়ে তাকে ছেড়ে দিলেও জাতীয় একটি দৈনিক পত্রিকায় এটি খবর হয়ে যায় “হিসু যখন ইস্যু” শিরোনামে। এতে বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়। এরা দুজনই আইনজীবী থেকে বিচারক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন। এছাড়া বিগত স্বৈরাচারী শাসন আমলে একজন আইনজীবীকে বিএনপি সরকারের আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত ও কর্মরত প্রধান বিচারপতির দরজায় লাথি দেয়ার পুরষ্কারস্বরূপ উচ্চাদালতের বিচারক নিয়োগ করা হয়। উচ্চাদালতে বিচারক নিয়োগে এধরণের আরো অনেক উদাহরণ দেয়া যাবে। আওয়ামী স্বৈরাচারী শাসন আমলে আপীল বিভাগে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে কোন নিয়ম নীতির তোয়াক্কা করা হয়নি। স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে চিহ্নিত দলবাজ ছাত্রলীগ করা বিচারকদের তাদের থেকে অনেক জ্যেষ্ঠ, অভিজ্ঞ ও দক্ষ বিচারকদের ডিঙ্গিয়ে আপীল বিভাগে নিয়োগ করা হয়েছিল। আপীল বিভাগ পরিণত হয়েছিল একটি দলীয় আখড়ায়।
হাইকোর্ট বিভাগের তিনজন বিচারককে বিগত স্বৈরশাসন আমলে দুর্নীতির অভিযোগে বেঞ্চ না দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বসিয়ে বসিয়ে বেতন এবং বিচারকের সব ধরণের সুবিধা দেয়া হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। তাদের বিষয়টি তদন্ত করার জন্য সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিলকে রাষ্ট্রপতি নির্দেশ দেননি বা কাউন্সিলও বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রপতিকে জানায়নি। সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিল সংক্রান্ত অংশ বাতিল করে দেয়া আপীল বিভাগের ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের পর সংবিধানের পূর্বের ৯৬ অনুচ্ছেদের সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। তবে রাষ্ট্রপতির নির্দেশ না পেলে এ কাউন্সিল কোন কাজ করতে পারেনা।
পতিত স্বৈরাচারী সরকারের আমলে কঠোরভাবে সুপ্রীম কোর্টের বিচারিক কার্যক্রম নিয়ন্ত্রিত হত। বিশেষ করে হাইকোর্টের রীট বেঞ্চ গুলো, আপীল বিভাগের জাজ-ইন-চেম্বার আদালত, প্রধান বিচারপতির কোর্ট ও আপীল বিভাগের অন্য কোর্টগুলোর দৈনিক কার্য তালিকা বা কজ লিস্ট গোয়েন্দা সংস্থা সমূহ বিশেষভাবে নজরদারি করত। সরকারের বিরূদ্ধে রুল ইস্যু করতে রীট বেঞ্চগুলোরভীতি ছিল হতাশাজনক। যদি কোন বেঞ্চ থেকে কোন সাহসী আদেশ পাওয়া যেত তা ও সরকার জাজ-ইন-চেম্বারে গিয়ে স্থগিত করিয়ে নিত।
উচ্চাদালত সংশ্লিষ্ট ঘটনাবলি থেকে যে বিষয়গুলো প্রণিধানযোগ্য সেগুলো হচ্ছে (১) বিচারক নিয়োগে চরম অস্বচ্ছতা, স্বেচ্ছাচারিতা ও দলীয়করণ; (২) বিচারিক কাজে নির্বাহী বিভাগের প্রভাব; (৩) উচ্চাদালতের সহায়ক কর্মচারীদের বেপরোয়া দুর্নীতি ও আদালত ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা; (৪) মামলা নিষ্পত্তিতে অনাকাঙ্খিত বিলম্ব; এবং (৫) বিচারকদের সাংবিধানিক শপথের প্রতি অঙ্গিকারের অভাব।
আমাদের সংবিধানের ৯৪ (৪) নং অনুচ্ছেদে প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারক বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন বলে ঘোষনা করা হয়েছে। এছাড়া ১১৬ক অনুচেছদে বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিগণ এবং ম্যাজিস্ট্রেটগণ বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবেন বলেও সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪৭ (২) অনুযায়ী সুপ্রীম কোর্টের একজন বিচারকের কার্যভারকালে তাঁর পারিশ্রমিক, বিশেষ-অধিকার ও কর্মের অন্যান্য শর্তের এমন তারতম্য করা যাবে না, যা তাঁর পক্ষে অসুবিধাজনক হতে পারে। উচ্চাদালতের বিচারকদের পারিশ্রমিক ইত্যাদির রক্ষাকবচ থাকা এবং সাংবিধানিকভাবে বিচারিক স্বাধীনতার সুস্পষ্ট ঘোষনা সত্ত্বেও বিগত স্বৈরাচারী সরকারের সময়তো বটেই এমনকি অন্যান্য সরকারের সময়ও আমাদের উচ্চ ও অধস্থন আদালতের বিচারকগণ তাঁদের বিচারকার্যে স্বাধীনতার কতটুকু প্রতিফলন ঘটাতে চেয়েছেন বা পেরেছেন তা একটি প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত বিষয়। সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে বিচার বিভাগের বিচারিক কার্যক্রমেও তার প্রতিফলন ঘটতে দেখা যায়। এটি কাম্য নয় এবং এটির দ্বারা বিচার বিভাগের ওপর নির্বাহী বিভাগের সুস্পষ্ট প্রভাব প্রমাণিত হয়।
কেয়ার টেকার সরকার ২০০৮ সনের ২৯ জানুয়ারি তখনকার উচ্চাদালতে বিচারক নিয়োগের জন্য সুপ্রীম জুডিসিয়াল কমিশন অর্ডিন্যান্স, ২০০৮ নামীয় আইন জারি করে। ঐ আইনে সুপ্রীম কোর্টের বিচারক নিয়োগের জন্য ৯ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিশন গঠন করে দেয়া হয় যেটির প্রধান থাকেন বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি। অন্যান্য সদস্যরা ছিলেন আইন মন্ত্রী, আপীল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম দুজন বিচারক, অ্যাটর্নি-জেনারেল, সরকার এবং বিরোধী দলীয় দুজন সংসদ সদস্য, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট বার এসোশিয়েশনের সভাপতি এবং আইন সচিব। ইদ্রিসুর রহমান বনাম বাংলাদেশ রীট মামলায় এ অধ্যাদেশটি চ্যালেঞ্জ হয়। একজন বিচারক অধ্যাদেশটি বাতিল ঘোষনা করেন। তবে অপর দুজন বিচারক শুধু অধ্যাদেশের ৯(৪) ধারা বাতিল ঘোষনা করেন। তবে আওয়ামী স্বৈরাচারী সরকারের নবম সংসদ অধ্যাদেশটি অনুমোদন না করায় এটির কার্যকারিতা বিলুপ্ত হয়।
একটি স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ বিচার-আদালতে প্রকাশ্য শুনানি লাভের অধিকারকে একটি সার্বজনীন মানবাধিকার বলে ঘোষনা করে জাতিসংঘের মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষনাপত্রের ১০ অনুচ্ছেদে এবং বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৫(৩)নং অনুচ্ছেদে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালতে বা ট্রাইব্যুনালে দ্রুত ও প্রকাশ্য বিচার লাভের অধিকারকে একটি মৌলিক অধিকার হিসেবে নিশ্চয়তা দেয়। এ অধিকারগুলো সঠিকভাবে উপভোগ করতে দরকার স্বচ্ছতার ভিত্তিতে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ যা স্বৈরাচারের যাতাকলে এতোদিন নিষ্পেষিত ছিলো। উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ করার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অতি দ্রুত কিছু পদক্ষেপ নিতে পারেন। যেমন:
১। আমাদের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৫ (২) (খ) এর অধীনে বর্তমানে সুপ্রীম কোর্টের বিচারক হিসেবে নিয়োগ লাভের জন্য অধস্থন আদালতে চাকুরীর অভিজ্ঞতা ১০(দশ) বছর বিশেষভাবে বুঝতে ও গণনা করতে হবে। এই ১০(দশ) বছর পুরোটাই বিচার কাজে নিয়োজিত অবস্থায় থাকতে হবে, কোন বিচার বিভাগীয় প্রশাসন যেমন, আইন মন্ত্রণালয়, বা অন্য কোন সরকারী সংস্থায় কর্মের সময় গণনায় আনা যাবে না। উল্লিখিত ১০(দশ) বছরের মধ্যে অবশ্যই ন্যূনতম তিন বছর জেলা জজ বা সম পর্যায়ের বিচারক হিসেবে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন হতে হবে।
২। অনুচ্ছেদ ৯৫(২) (ক)-এর অধীন সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী হিসেবে কর্মকালের ১০(দশ) বছরও বিশেষভাবে বুঝতে এবং পড়তে হবে। আদালতে ১০(দশ) বছরের জন্য নিছক অন্তর্ভুক্তি যথেষ্ঠ বিবেচিত হবে না। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মামলা সফলভাবে পরিচালনাসহ তাঁকে নিয়মিত সক্রিয়ভাবে প্র্যাকটিস করতে হবে, যা প্রধান বিচারপতি ও তাঁর সহবিচারপতিবৃন্দ নির্ধারণ করবেন। এছাড়া কমপক্ষে দুই বছর আপিল বিভাগে মামলা পরিচালনায় অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
৩। ৯৫ (২) (ক) ও ৯৫ (২) (খ)-এর অধীন আইনজীবী ও বিচারক ছাড়াও ৯৫ (২) (গ) এর অধীন কোন আইনজ্ঞ, যেমন আইনের অধ্যাপক বা আইনের গবেষক, যার প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় রয়েছে, সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগের জন্য বিবেচিত হতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর বয়সের নিম্ন সীমা হবে পয়তাল্লিশ (৪৫) বছর।
৪। সুপ্রীম কোর্টে অধস্থন আদালত হতে বিচারক নিয়োগের আনুপাতিক সংখ্যা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
৫। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৮-এর অধীন হাইকোর্ট বিভাগে অস্থায়ী মেয়াদে অতিরিক্ত বিচারক নিয়োগ এবং হাইকোর্ট বিভাগ হতে অস্থায়ী মেয়াদে কোন বিচারকের আপিল বিভাগে আসন গ্রহণের বিধান যুক্তিসঙ্গত কারণে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ধারণার সঙ্গেঁ সঙ্গঁতিপূর্ণ নয় বিধায় সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে তা বিলুপ্ত করা প্রয়োজন।
৬। বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রধান বিচারপতির সঙ্গে ‘পরামর্শ’ নিছক আভিধানিক অর্থে নয়, বরং তা সাংবিধানিক ও বিচার বিভাগীয় ধ্যান ধারণায় বিশেষ অর্থে পড়তে ও বুঝতে হবে (উল্লিখিত প্যারা ৭-এর বর্ণনা মতে), যার ফলে ‘পরামর্শ’ হয়ে উঠতে পারে অর্থবহ ও কার্যকর। এজন্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রধান বিচারপতির পরামর্শ চাওয়া এবং প্রধান বিচারপতির পরামর্শ প্রদান প্রক্রিয়া হতে হবে স্বচ্ছ ও লিখিতভাবে যাতে তার উপর সামাজিক পর্যবেক্ষণ সম্ভবপর হয়।
৭. সুপ্রীম জুডিসিয়াল কমিশন অধ্যাদেশ জারি করে সুপ্রীম কোর্টের উভয় বিভাগে বিচারক নিয়োগে স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করা যাতে করে কেবল উপযুক্ত যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তিরাই এ বিভাগে বিচারক হিসেবে নিয়োগ লাভ করতে পারেন।
৮. সংবিধানের পুনরুজ্জীবিত ৯৬ নং অনুচেছদ অনুসারে সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিলকে কার্যকর করা। ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের বিরূদ্ধে আপীল বিভাগে সরকার কর্তৃক কোন রিভিউ দায়ের করা থাকলে অবিলম্বে তা প্রত্যাহার করা। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের প্রয়োজনীয় সহায়তা নেয়া যেতে পারে।
৯. রুলস অব বিজনেস এবং এলোকেশনশ অব বিজনেস সংশোধন করে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন বিচার বিভাগ নামীয় একটি বিভাগ সৃজন করে তার নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের অধীন ন্যস্ত করা যেতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের কথা বলা যায়। বিচার বিভাগই বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ করবে।
১০. বিচার বিভাগের জন্য পর্যাপ্ত তহবিল বরাদ্দ করা এবং প্রয়োজনীয় লোকবল ও সরঞ্জাম নিশ্চিত করা ও সময়ের দাবী।
লেখক: মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম, আইন গবেষক (পিএইচডি ফেলো) ও কলামিস্ট, ইমেইলঃ bdjdj1984du@gmail.com