মোহাম্মদ সেলিম মিয়া: স্বৈরশাসক হাসিনার দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছরের শাসনে সংবিধান কাটা ছেঁড়া করে প্রায় দলীয় গঠন তন্ত্রে রুপ দিয়েছেন, সর্বোচ্চ আদালত থেকে অধস্তন আদালত পর্যন্ত স্বৈরশাসকের অঙ্গুলিহেলনের মাধ্যমে বিচার কাজ চলত। স্বৈরশাসক হাসিনার পতনের সাথে সবসেক্টরে পরিবর্তন আসছে। যে কোন সময় হাইকোর্ট বিভাগে বিচারপতি নিয়োগের বিষয়টিও সামনে আসবে।
অধস্তন আদালতে যে বিচারক নিয়োগ হয় তাদের একাডেমিক যোগ্যতা নিয়ে কখনো প্রশ্ন আসে না কারন ৩টি ধাপ পেরিয়ে অনেক যাচাই বাছাই অন্তে সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রটিই বিচারক হিসাবে নিয়োগ পায় কিন্তু হাইকোর্ট বিভাগে বিচারপতি নিয়োগে খুবই নিম্নমানের শিক্ষাগত যোগ্যতার আইনজীবীকেও অতীতে বিচারক নিয়োগ দেওয়ার রেকর্ড আছে।
অথচ যদি আমরা তুলনামূলক বিচার করি সেরার সেরা একাডেমিক যোগ্যতা, সমৃদ্ধ পেশাগত দক্ষতা, আইনগত বিচক্ষণতা ও একাগ্রতা সম্পন্ন আইনজীবীর বিচারপতি নিয়োগ পাওয়ার কথা। ভবিষ্যতে আমরা এমন চাই না যে, ছাত্রজীবনে এমন একাডেমিক যোগ্যতা ছিল যে একটা ২য়/৩য় শ্রেণীর চাকুরী পেতে ব্যর্থ হয়ে পরে আইনপেশায় এসে রাজনৈতিক মাপকাঠিতে একেবারে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি বনে যাক!
বিচারপতি নিয়োগের বিদ্যমান প্রক্রিয়া প্রধান বিচারপতি চাইলেই উন্নত করতে পারেন। বিচারপতি নিয়োগের বিষয়ে বিএনপি ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে, বিচারপতি নিয়োগের লক্ষ্যে সংবিধানের ৯৫(২)(গ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট যোগ্যতা ও মানদণ্ড সম্বলিত ‘বিচারপতি নিয়োগ আইন’ প্রণয়ন করবে।
আরও পড়ুন: সাবেক বিচারপতি মানিকের জামিন
ইতিমধ্যে বিচারবিভাগ সংস্কারে একটি কমিটিও গঠন হয়েছে যার দায়িত্বে আছেন বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান। আইন প্রণয়ের পূর্বে বর্তমান অন্তর্বতীকালীন সরকার বিচারপতি নিয়োগ বিষয়ে উচ্চ আদালতের কিছু রায় আছে সেগুলো যথাযথ ভাবে পরিপালন করলেই যোগ্যতম বিচারপতি পাওয়া সম্ভব বলে মনে করি কারণ সেগুলোই এখন আইন।
বিচারপতি নিয়োগ বিষয়ে ২০১০ সালের ৬ জুন হাইকোর্ট রুল দিয়েছিল। রুলে সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগে বাছাই-প্রক্রিয়ায় ‘স্বচ্ছতা ও প্রতিযোগিতা’ আনতে কেন সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা তৈরি করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছিল।
এই রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১৭ সালে ১৩ এপ্রিল হাইকোর্ট সংবিধানের ৯৫ (২) অনুচ্ছেদ তুলে ধরে যোগ্যতার বিষয়ে সাত দফা পর্যবেক্ষণসহ ৪৬ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ এক রায় প্রকাশ করেন।
উক্ত মামলায় বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে আইনজীবী ও অধস্তন আদালতের বিচারকদের মধ্যে সত্যিকার যোগ্য ব্যক্তি নির্ধারণে প্রধান বিচারপতি মুখ্য ও উপযুক্ত ব্যক্তি বলে মত দিয়েছেন হাইকোর্ট।
রায়ে বলা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের বিচারক হতে একজন ব্যক্তির ন্যূনতম বয়স ৪৫ হওয়া উচিত। বিচারকদের ক্ষেত্রে জেলা ও দায়রা আদালতে বিচারিক অভিজ্ঞতা তিন বছরের কম হলে উচ্চতর বিচারিক ক্ষেত্রে তাঁরা সুপারিশের জন্য গণ্য হবেন না।
পর্যবেক্ষণে যা বলা হয়
সাত দফার প্রথম পর্যবেক্ষণে বলা হয়, একজন ব্যক্তি, যিনি বাংলাদেশের নাগরিক ও যিনি সংবিধানের ৮ অনুচ্ছেদে বর্ণিত বাংলাদেশের চারটি রাষ্ট্রীয় মূল নীতি যথা জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতার ওপর এবং মুক্তিযুদ্ধের ওপর আস্থা রাখেন, তাঁকে নিয়োগে সুপারিশ করা যাবে। তবে কেউ এই মূলনীতি ও ভাবধারার ওপর আস্থাহীন হলে তাঁকে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা যাবে না।
দ্বিতীয় পর্যবেক্ষণে বলা হয়, সুপারিশ করা ব্যক্তির শিক্ষাজীবনে দারুণ ফলাফল, সমৃদ্ধ পেশাগত দক্ষতা, আইনগত বিচক্ষণতা ও একাগ্রতা থাকতে হবে।
তৃতীয় দফায় বলা হয়, সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে আগ্রহী প্রার্থীর জীবন বৃত্তান্ত সংরক্ষণ করা যেতে পারে, যাতে প্রধান বিচারপতি ইচ্ছে করলে প্রাথমিক বিবেচনার জন্য ওই ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ সাক্ষাৎকারের জন্য তাদের সম্পদ ও দায়-দেনার বিবরণসহ হাজির হতে পারেন, যা কার্যকর, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ ভাবমূর্তির মধ্য দিয়ে যথার্থ সুপারিশের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সুবিধা দেবে।
আরও পড়ুন: চার জেলা জজ আদালত পরিদর্শন করলেন বিচারপতি আহমেদ সোহেল
চতুর্থ দফায় বলা হয়, পেশাগত ক্ষেত্রে সময় দেওয়ার মধ্য দিয়ে একজন ব্যক্তি পেশাগত দক্ষতা এবং যোগ্যতা অর্জন করেন। তাই সাধারণভাবেই প্রার্থীর বয়স সুপারিশের ক্ষেত্রে একটি অন্যতম বিবেচ্য বিষয় হওয়া উচিত। ভারতীয় আইন কমিশনের ৮০ তম প্রতিবেদনে বিচারকদের নিয়োগের বিষয়ে দেওয়া পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, একজন বিচারকের জন্য পরিপক্বতা একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বহু বছরের চমকপ্রদ পেশাগত কৃতিত্বের কোনো বিকল্প নেই। এ বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করে আদালতের মত, সুপ্রিম কোর্টের বিচারক হতে চাওয়া একজন ব্যক্তির ন্যূনতম বয়স ৪৫ হওয়া উচিত।
পঞ্চম দফায় বলা হয়, ভালো মানের নিয়োগ নিশ্চিত করতে প্রধান বিচারপতির সুপারিশের ক্ষেত্রে আপিল বিভাগে নিযুক্ত আইনজীবীদের অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। তবে খুব ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে হাইকোর্টে নিযুক্ত আইনজীবীদেরও তাদের কাজের পরিধি, চর্চার অভিজ্ঞতা, সততা ও আন্তরিকতাকে আমলে নিয়ে হাইকোর্ট বিভাগের জন্য তাঁদের সুপারিশ করা যেতে পারে।
ষষ্ঠ পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, অধস্তন বিচারিক ক্ষেত্রে কর্মরত বিচারকদের ক্ষেত্রে জেলা ও দায়রা আদালতে বিচারিক অভিজ্ঞতা তিন বছরের কম হলে তাঁরা উচ্চতর বিচারিক ক্ষেত্রে সুপারিশের জন্য গণ্য হবেন না।
সপ্তম দফায় বলা হয়, অধস্তন বিচারিক ক্ষেত্রে কর্মরতদের সুপারিশের ক্ষেত্রে মেধা এবং একাগ্রতাও অন্যতম বিবেচ্য হবে। এটা মাথায় রাখতে হবে যে উচ্চ মেধা সম্পন্ন একজন ব্যক্তির একাগ্রতা না থাকলে তিনি প্রতিষ্ঠানের জন্য ক্ষতিকর হন।
আরও পড়ুন: সংবিধান সংস্কার এর প্রয়োজনীয়তা ও প্রাসঙ্গিক বাস্তবতা
রায়ে বলা হয়, হাইকোর্ট বিভাগ থেকে কাউকে নিয়োগের ক্ষেত্রে মতামত গঠন এবং যথার্থ, কার্যকর ও স্বচ্ছ সুপারিশের জন্য প্রধান বিচারপতি যদি মনে করেন, তাহলে তিনি আপিল বিভাগের দুজন এবং হাইকোর্ট বিভাগের দু’জন জ্যেষ্ঠতম বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ করতে পারেন। প্রধান বিচারপতি এই সুপারিশকে মতামত হিসেবে দেওয়ার পরে ওই সিদ্ধান্তকে অনুমোদন না করার কোনো উপায় থাকবে না, যদি না সুপারিশকৃত ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ কোনো রাষ্ট্র বিরোধী বা সমাজবিরোধী কার্যকলাপে জড়িত থাকেন।
রায়ে বলা হয়, দশ বিচারপতির মামলায় আপিল বিভাগের দেওয়া রায়ের পর্যবেক্ষণ অনুসারে প্রধান বিচারপতির দেওয়া সুপারিশ অযৌক্তিক কারণে গোপন রাখা যাবে না।
আপীল বিভাগ ১০ বিচারকের নিয়োগের বিষয়ে যে গাইডলাইন দিয়েছিলেন, সেটা মানা বাধ্যতামূলক। আদালত শুধু ১০ বিচারকের নিয়োগের বিষয়টি ফয়সালা করেনি, বিচারক নিয়োগের স্থায়ী একটা পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছিলেন। আরেকটি আইন দ্বারা তাকে প্রতিস্থাপন না করা পর্যন্ত পুরো জাতির জন্য এটাই কার্যকর আইন।
এর পর আরও কয়েকটি রায়ে এ বিষয়ে নিদের্শনা দেওয়া হয় এর মধ্যে সর্বশেষ ২০১৭ সালে ১৩ এপ্রিল বিচারক নিয়োগে আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত একটি রিটে উক্ত সাত দফা নির্দেশনা দেন হাইকোর্ট। সুতরাং আইন করলে ভালো, না করা পর্যন্ত আপীল বিভাগের নির্দেশনা মেনে সরকার কাজ করতে পারে।
রেভ্যুলেশনের মাধ্যমে একটা নতুন সরকার এসেছে কাজেই বর্তমান সরকারের কাছে প্রত্যাশা থাকবে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে তদবিরকারীদেরকে অযোগ্য ঘোষণা করে বরং যোগ্যতম আইনজীবীদের প্রস্তাব দিয়ে নিয়ে আসবে (প্রয়োজনে আগ্রহী প্রার্থীদের জীবন বৃতান্ত ওয়েবসাইটে প্রকাশ করবে) এবং দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে যোগ্যতম বর্তমান মাননীয় প্রধান বিচারপতি তাঁর মতই যোগ্য ব্যক্তিদের বিচারপতি নিয়োগ দিবেন।
লেখক: মোহাম্মদ সেলিম মিয়া; অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।