ক্ষতিপূরণের আদেশ দিয়ে সুনামগঞ্জে ৫০ বছরের পুরানো মামলা নিষ্পত্তি

মানুষ যখন পশু হয়, তার জীবন কেড়ে নেওয়াই শ্রেয়: পর্যবেক্ষণে আদালত

‘একজন মানুষ যখন পশু হয়ে যায়, তখন তার জীবন কেড়ে নেওয়াই শ্রেয়। এ মামলার আসামিরা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে। তারা নির্মম, বর্বর ও নিষ্ঠুরভাবে রেণুর ওপর হামলা করেছে।’

বুধবার (৯ অক্টোবর) ঢাকার অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত-৬-এর বিচারক মোহাম্মদ মোরশেদ আলম রেণু হত্যা মামলার রায় ঘোষণার আগে পর্যবেক্ষণে এসব কথা বলেন।

গণপিটুনির নামে মধ্যযুগীয় বর্বরতায় মানুষ হত্যার লাইসেন্স দেওয়া হলে তা এ সমাজের যেকোনও মানুষের জন্য আতঙ্ক ও অনিরাপত্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত না হলে এ ধরনের অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটবে এবং আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে, যুক্ত করেন আদালত।

এদিন সকাল ১১টা ১০ মিনিটে মামলার রায় পড়া শুরু করেন আদালত। শুরুতে বিচারক বলেন, এটা একটা চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলা। টেলিভিশন, পত্র-পত্রিকায় দেখেছি। আমার আগেও এ মামলার বিচারক ছিল। ভাগ্যক্রমে আমিই রায় পড়ছি। এ মামলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ ভিডিও ফুটেজ। এটা না থাকলে রায়ের দিকে যাওয়াটা কঠিন হতো। চারটি ভিডিও ক্লিপ আমি দেখাতে চাই। পরে আদালত ৫ মিনিট করে দুটি ভিডিও ক্লিপ আদালতে দেখান। ভিডিও দেখে আদালতে কাঁদতে দেখা যায় রেনুর বোন নাজমুন নাহার নাজমাকে।

এর মাঝে বিচারক বলেন, আবুল কালাম কে? তখন হাত তোলেন আবুল কালাম। বিচারক বলেন, দেখছেন আপনাকে? আবুল কালাম বলেন, দেখা যায়নি।

কালামকে উদ্দেশ করে বিচারক বলেন, আপনি দেখেন তো কী করতেছিলেন? কামাল বলেন, আমি সবাইকে বলেছি থামো। দয়া করে থামো। শোনো সে (রেনু) কী বলতে চায়। আমরা শুনতে চাই। কিন্তু কেউ শোনে না।

এরপর বিচারক বলেন, আপনি মনে হচ্ছে, সেখানে অ্যাগ্রেসিভ (আক্রমণাত্মক) আচরণ করছেন। এ মামলার তদন্তে কিছু দুর্বলতা আছে। অবশ্য উপস্থিত অনেকে সাক্ষী হতে চায়নি।

হৃদয়কে উদ্দেশ করে বিচারক বলেন, দেখবা তোমাকে চিনতে পারো কি না।

ভিডিও দেখা শেষ হলে বিচারক বলেন, বেশিরভাগই একজন মেরেছে। তাকে (রেনু) হত্যা করা হয়েছে সন্দেহ নেই।

এ মামলায় ভিকটিমকে হত্যার জন্য আসামিদের পূর্ব পরিকল্পনা ছিল না। কিন্তু তাদের গণপিটুনির ধরণ দেখে বোঝা যায়, তারা তাকে হত্যা করতে চেয়েছে। মামলায় লাল গেঞ্জি পরিহিত একজন রয়েছেন। তিনিও নিষ্ঠুরতা করেছেন৷ কিন্তু তাকে শনাক্ত করা যায়নি।

বিচারক বলেন, রিয়া ও হৃদয় ছেলেধরার গুজব ছড়ায়। আজাদ মন্ডলের নেতৃত্ব ও নির্দেশে দ্বিতীয় তলা থেকে বোরখা পরা মহিলাকে টেনেহিঁচড়ে নামায়। এসময় রিয়া ডিসিস্টের (নিহতের) চুল টানাটানি করে। স্কুলের মাঠে ফাঁকা জায়গায় নিয়ে এলে কামাল মাথায় চাপ দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয়। আসাদ ঘুষি মারে। হৃদয় কাঠের লাঠি দিয়ে পেটায়। সে রেণুকে হত্যার মূল কার্যকারক ছিল। পেটাতে পেটাতে সে ক্লান্ত হয়ে ঘেমে যায়। বিশ্রাম নিয়ে পুনরায় আবার পেটায়। হৃদয় নির্দয়-নির্মমভাবে পেটায় মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত। কিন্তু তার (রেনু) মাঝে ছেলেধরার কোনও আলামত বা পরিস্থিতি ছিল না। তিনি ছিলেন নিরস্ত্র। আসামিরা নিষ্ঠুরভাবে তাকে পিটিয়ে হত্যা করে। নির্দোষ প্রমাণে তাকে কোনও সুযোগ দেয়নি। বাঁচার আকুতি উপেক্ষা করে। আঘাতের তীব্রতা এত বেশি ছিল, ঘটনার দিনই সে মারা যায়।

বিচারক আরও বলেন, কেস ডায়েরি পর্যালোচনা করে দেখা যায় আসামিরা আইন-কানুনের পরোয়া করেননি। আসামি ইব্রাহিম ওরফে হৃদয় মোল্লা লাঠি দিয়ে নিহতের দুই হাতে, কাঁধে, বুকে, উরু ও পা-সহ বিভিন্ন জায়গায় নির্দয় ও নিষ্ঠুরভাবে আঘাত করে। মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তাকে আঘাত করতে থাকে। রেনুকে হত্যা বীভৎস, নারকীয় ও নৃশংস ছিল। যেভাবে গণপিটুনি দিয়ে রেনুকে হত্যা করা হয়েছে তা মধ্যযুগীয় বর্বরতা এবং সমাজের প্রত্যেক মানুষের জন্য আতঙ্ক ছড়িয়েছে।

আদালত বলেন, আসামি ইব্রাহিম কোনও যৌক্তিক কারণ ছাড়া নিষ্ঠুর ও বর্বরভাবে আঘাত করে একজন স্বামী পরিত্যক্তা মহিলাকে হত্যা করেছে এবং দুই শিশুকে মাতৃহারা করেছে, নিজের পশু মনোবৃত্তির বহিঃপ্রকাশ করেছে। তার পূর্ব অপরাধ ও শাস্তির রেকর্ড নাই। কিন্তু নিহতকে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে আঘাত করে মৃত্যু নিশ্চিত করায় তাকে লঘু শাস্তি দেওয়ার সুযোগ নেই। অপরাধ সংগঠনের সময় সে যে নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা, উন্মত্ততা ও পৈশাচিকতা প্রদর্শন করেছে সেক্ষেত্রে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া সমীচীন হবে না। সংগঠিত আপরাধের মাধ্যমে সে নিজেকে সমাজে কলঙ্কিত করেছে। একজন মানুষ যখন পশু হয়ে যায় এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের কলঙ্কে পরিণত হয়ে যায় তখন তার জীবন কেড়ে নেওয়াই শ্রেয়।

উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ২০ জুলাই সকালে রাজধানীর উত্তর বাড্ডায় মেয়েকে ভর্তি করাবেন বলে স্থানীয় একটি স্কুলে যান তাসলিমা বেগম রেনু (৪০)। এ সময় ‘ছেলেধরা’ বলে অভিযোগ করে তাকে পিটিয়ে আহত করে স্থানীয় কিছু লোক। গুরুতর অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ওই রাতেই রেনুর বোনের ছেলে সৈয়দ নাসির উদ্দিন টিটু বাদী হয়ে বাড্ডা থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় অজ্ঞাতনামা ৫০০ জনকে আসামি করা হয়। পরে সিসিটিভি ফুটেজ দেখে গণপিটুনিতে জড়িত কয়েকজনকে শনাক্তের পর গ্রেফতার করে পুলিশ।

বুধবার এই মামলায় রায় দেওয়া হয়। আসামি ইব্রাহিম ওরফে হৃদয় মোল্লার মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত। এছাড়া আসামি রিয়া বেগম ময়না, আবুল কালাম আজাদ, কামাল হোসেন ও আসাদুল ইসলামের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়েছে। সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের ১ লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় মো. শাহিন, বাচ্চু মিয়া, মো. বাপ্পি, মুরাদ মিয়া, সোহেল রানা, বেল্লাল মোল্লা, মো. রাজু ও মহিন উদ্দিনকে খালাস দেন আদালত।