মো: জুয়েল আজাদ: ধর্মীয় চর্চা; ধর্ম, দেশ এবং অভ্যন্তরীণ ধর্মীয় ক্লাস ভেদে পার্থক্য দেখা যায়। তবে সকল ধর্মে শান্তি, নিরাপত্তা, শৃঙ্খলার কথা বলা আছে। শুধু পার্থক্য দেখা যায় ঈশ্বরবাদে। কেও এক ঈশ্বরবাদে বিশ্বাসী আবার বহু ঈশ্বরবাদে। ইসলামে এক ঈশ্বরবাদে বিশ্বাসী। এর বিশ্বাস অনুসরণ করা হয় পবিত্র কুরআন এবং হাদিস অনুসারে। এবং পারিপার্শ্বিক বিশ্লেষণে দেখা যায় ইজমা কিয়াস এর প্রয়োগ। ইসলামিক ইস্কলার পারিপার্শ্বিক সমস্যা সমাধানে এই ইজমা কিয়াস এর প্রয়োগ করে। ইজমা কিয়াস হচ্ছে ইসলামিক ইস্কলারদের মতামত। ধর্মীয় বিশ্বাস এবং এর চর্চা হজরত মুহাম্মাদ (সঃ) এর জীবনী এবং পবিত্র কোরানে মহান আল্লাহ নির্দেশ আছে।
এমনকি কোনো অমুসলিম মৃত্যু বরণ করলে তাদের সম্পর্কে রসুল সা. বলেন, তাদের জীবিতের যেমন হক রয়েছে, তেমনি মৃতেরও হক রয়েছে। প্রয়োজনে তাদের দাফন বা সৎকারে সহযোগিতা করতে হবে। কেননা তারা শ্রেষ্ঠ মাখলুক তথা মানবজাতির অন্তর্ভুক্ত। পবিত্র কোরআন ও হাদিসে সুস্পষ্ট ভাষায় ; অমুসলিম হওয়া সত্ত্বেও সম্পর্ক রক্ষা করতে বলা হয়েছে।
আরও পড়ুন: সুপ্রিম কোর্টে ইতিহাস, একসঙ্গে ৫ নারী বিচারপতি নিয়োগ
এক আয়াতে আল্লাহ বলেন, তোমার পিতা-মাতা যদি এমন কাউকে (প্রভুত্বে) আমার সমকক্ষ সাব্যস্ত করার জন্য তোমাকে চাপ দেয়, যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান (দলিল ও প্রমাণ) নেই, তবে তাদের কথা মানবে না। তবে দুনিয়ায় তাদের সঙ্গে সদাচরণ করো। আর এমন ব্যক্তির পথ অনুসরণ করো, যে একান্তভাবে আমার অভিমুখী হয়েছে। তারপর তোমাদের সবাইকে আমার কাছে ফিরে আসতে হবে। তখন আমি তোমাদের সে বিষয়ে অবহিত করব, যা তোমরা করতে। (সুরা লোকমান ১৫)।
আল্লাহ বলেন, ‘দ্বিন সম্পর্কে জোর-জবরদস্তি নেই; সত্য পথ ভ্রান্ত পথ থেকে সুস্পষ্ট হয়েছে। যে তাগুতকে অস্বীকার করবে ও আল্লাহর ওপর ঈমান আনবে সে এমন এক মজবুত হাতল ধরবে, যা কখনো ভাঙবে না। আল্লাহ সর্বশ্রোতা, প্রজ্ঞাময়। (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৫৬)।। মদিনা সনদে; অমুসলিমদের নিরাপত্তার বিধান, ধর্মীয় অনুষ্ঠান উৎযাপনে স্বাধীনতা, অসুস্থ হলে দেখতে যাওয়া, দান সদগা করা, এবং অন্যান্য বিষয়সহ জীবন বিধানে আছে দিকনির্দেশনা। তবে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে যেমন পূজা করা, পূজায় অংশগ্রহণ করা এমন কর্মে আছে, বাধা এবং নিষেধ। এক্ষেত্রে বলতে পারেন, ধর্ম যার উৎসব তার।
আরও পড়ুন: চারিদিকের গুজব রুখবে কে!
এপ্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে সূরা কাফিরুন বলা আছে, “…আমি যার ‘ইবাদাত কারি তোমরা তার ‘ইবাদাতকারী নও’। আর তোমরা যার ‘ইবাদাত কারি আমি তার ‘ইবাদাতকারী নই,…” এখন দেখা যাক ধর্মীয় আইন এবং হাদীসের দৃষ্টিভঙ্গি দেশ ও দেশের বাইরে আইন এর প্রতিফলন কতটুকু। ১৯৭২ সালের সংবিধানের আটিকেল ৪১(১) এ, বলা আছে, আইন, জনশৃঙ্খলা এবং নৈতিকতা সাপেক্ষে- (ক) প্রত্যেক নাগরিকের যে কোনো ধর্ম পালন, পালন বা প্রচারের অধিকার রয়েছে;(খ) প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায় বা সম্প্রদায়ের তাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা, রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনা করার অধিকার রয়েছে। (২) কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যোগদানকারী কোন ব্যক্তিকে ধর্মীয় নির্দেশ গ্রহণের বা কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা উপাসনায় অংশগ্রহণ বা অংশগ্রহণের প্রয়োজন হবে না, যদি সেই নির্দেশ, অনুষ্ঠান বা উপাসনা তার নিজস্ব ধর্ম ব্যতীত অন্য কোন ধর্মের সাথে সম্পর্কিত হয়।
আরও পড়ুন: দিনাজপুর চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে চাকরি, পদ ৩০
আটিকেল ২৭; এ সকল নাগরিক আইনের সামনে সমান এবং আইনের সমান সুরক্ষা পাওয়ার অধিকারী। আটিকেল ১২(৪); কোনো বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তিদের প্রতি কোনো বৈষম্য বা নিপীড়ন করা যাবে না। যেহেতু দেশের সর্বচ্চ আইনে ধর্মীয় বিশ্বাস এবং এর চর্চায় নিরাপত্তার বিধান করা হয়েছে এর লালন এবং পালন করা প্রত্যেক নাগরিকের দায়িত্ব। যদি রাষ্ট্র এই বিধানের কোনও ব্যক্তয় ঘটায় তাহলে সংবিধান দ্বারা রাষ্ট্রকে বাধ্য করা যাই। আর যদি কোন ব্যক্তি এই বিধানের কোনও ব্যক্তয় ঘটায় তাহলে দেশের প্রচলিত আইনে আছে শাস্তির বিধান।
১৮৬০ সালের পেনাল কোড চ্যাপটার ১৫, ধারা ২৯৫ এ বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি কোনো উপাসনালয়কে ধ্বংস করে, ক্ষতি করে বা অপবিত্র করে, বা কোনো শ্রেণির ব্যক্তির দ্বারা পবিত্র ধারণ করা কোনো বস্তুর দ্বারা কোনো শ্রেণির ব্যক্তির ধর্মকে অবমাননা করার অভিপ্রায়ে বা কোনো শ্রেণির ব্যক্তি এই ধরনের ধ্বংসের কথা বিবেচনা করতে পারে এমন জ্ঞান নিয়ে, তাদের ধর্মের অবমাননা হিসাবে ক্ষতি বা অপবিত্রতা, এক্ষেএে দুই বছর পর্যন্ত বিনাশ্রম মেয়াদের জন্য যেকোন বর্ণনার কারাদণ্ড, বা জরিমানা, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে। এবং ২৯৫ক; তে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে এবং বিদ্বেষপূর্ণ উদ্দেশ্য নিয়ে বাংলাদেশের কোনো শ্রেণীর নাগরিকের ধর্মীয় অনুভূতিতে, কথায়, কথ্য বা লিখিতভাবে বা দৃশ্যমান উপস্থাপনা দ্বারা সেই শ্রেণীর ধর্ম বা ধর্মীয় বিশ্বাসকে অবমাননা বা অবমাননা করার চেষ্টা করে, সে অপরাধী হবে।
আরও পড়ুন: অবসরে আইন সচিব গোলাম রব্বানী
এক্ষেএে দুই বছর পর্যন্ত বিনাশ্রম মেয়াদের জন্য যেকোন বর্ণনার কারাদণ্ড, বা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত। এবং ধারা ২৯৬; তে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় ধর্মীয় উপাসনা, বা ধর্মীয় অনুষ্ঠান সম্পাদনে নিযুক্ত কোনো সমাবেশে স্বেচ্ছায় বিঘ্ন ঘটায়, তাকে যেকোন বর্ণনার কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে যার মেয়াদ এক বছর পর্যন্ত হতে পারে, বা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে।
ধারা ২৯৭; তে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি, যে কোনো ব্যক্তির অনুভূতিতে আঘাত করার উদ্দেশ্যে, বা কোনো ব্যক্তির ধর্মকে অবমাননা করার উদ্দেশ্যে, অথবা কোনো ব্যক্তির অনুভূতিতে আঘাতের সম্ভাবনা রয়েছে বা কোনো ব্যক্তির ধর্ম অবমাননার সম্ভাবনা রয়েছে এমন জ্ঞান নিয়ে এইভাবে, যে কোনো উপাসনালয়ে বা সমাধিস্থলে, বা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পাদনের জন্য আলাদা করা কোনো স্থান বা মৃতদের দেহাবশেষের জন্য একটি আমানত হিসাবে যেকোনও অনধিকার সংঘটিত করে, বা কোনো মানুষের মৃতদেহের প্রতি কোনো অসম্মান প্রদর্শন করে, বা বিঘ্ন ঘটায় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানের জন্য একত্রিত যেকোন ব্যক্তি, যেকোন একটি মেয়াদের জন্য কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন যা এক বছর পর্যন্ত প্রসারিত হতে পারে, বা জরিমানা, বা উভয়ই।
আরও পড়ুন: প্রধান বিচারপতির বাসভবন পুরাকীর্তি হিসেবে সংরক্ষণের ঘোষণা
ধারা ২৯৮; তে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে কোন ব্যক্তির ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার অভিপ্রায়ে কোন শব্দ উচ্চারণ করে বা উক্ত ব্যক্তির শ্রবণে কোন শব্দ করে বা উক্ত ব্যক্তির দৃষ্টিতে কোন অঙ্গভঙ্গি করে বা উক্ত ব্যক্তির দৃষ্টিতে কোন বস্তু স্থাপন করে, সে তার অপরাধ। তাহলে যেকোন একটি মেয়াদের জন্য কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন, যা এক বছর পর্যন্ত বাড়তে পারে, বা জরিমানা, বা উভয়ই। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠনের সদস্য প্রাপ্তিতে আইন প্রণেতারা দেশীও আইনকে আরও বেশি প্রসিদ্ধ হয়েছে। তবে কোন দেশে আন্তর্জাতিক আইন সরাসরি প্রয়োগযোগ্য না হলেও এর বিধানবলি অস্বীকারকরার সুযোগ নাই।
আরও পড়ুন: মানুষ যখন পশু হয়, তার জীবন কেড়ে নেওয়াই শ্রেয়: পর্যবেক্ষণে আদালত
কারন উক্ত দেশ অধিকাংশ আইনেই স্বাক্ষরকারী দেশ। যেমন ধর্মীয় স্বাধীনতায় জাতিসংঘ সনদ (১৯৪৫) অনুচ্ছেদ ১,১৩,৫৫; এই নিবন্ধগুলিতে জাতিসংঘের সনদ “জাতি, লিঙ্গ, ভাষা বা ধর্মের পার্থক্য ছাড়াই মানবাধিকার এবং মৌলিক স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা” শব্দটি ব্যবহার করে। মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা (১৯৪৮) মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা (UDHR) মানবাধিকারের ইতিহাসে একটি মাইলফলক দলিল।
ধারা ১৮; বলা হয়েছে, প্রত্যেকেরই ধর্ম, বিবেক ও চিন্তার স্বাধীনতায় অধিকার রয়েছে। এ অধিকারের সঙ্গে ধর্ম বা বিশ্বাস পরিবর্তনের অধিকার এবং এই সঙ্গে, প্রকাশ্যে বা একান্তে, একা বা অন্যের সঙ্গে মিলিতভাবে, শিক্ষাদান, অনুশীলন, উপাসনা বা আচারব্রত পালনের মাধ্যমে ধর্ম বা বিশ্বাস ব্যক্ত করার অধিকারও অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
আরও পড়ুন: প্রায় এক যুগ পর আয়কর আপিলাত ট্রাইব্যুনালে ২ জেলা জজ নিয়োগ
ধারা ২৬ (২); বলা হয়েছে, ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশ এবং মানবিক অধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা-সমূহের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে শিক্ষা পরিচালিত হবে। শিক্ষা সকল জাতি, গোত্র এবং ধর্মের মধ্যে সমঝোতা, সহিষ্ণুতা ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক উন্নয়নের প্রয়াস পাবে এবং শান্তিরক্ষার স্বার্থে জাতিসংঘের কার্যাবলীকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। International Covenant on Civil and Political Rights (১৯৬৬) এর আটিকেল ১8(৪); বর্তমান চুক্তির রাষ্ট্রপক্ষগুলি পিতামাতার স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং, যখন প্রযোজ্য, আইনী অভিভাবকদের তাদের নিজস্ব বিশ্বাসের সাথে সামঞ্জস্য রেখে তাদের সন্তানদের ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দেয়।
আরও পড়ুন: বরখাস্ত ম্যাজিস্ট্রেট ঊর্মির নামে হাজার কোটি টাকার মানহানি ও রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা
আটিকেল ২০(২); জাতীয়, জাতিগত বা ধর্মীয় বিদ্বেষের যে কোনো ওকালতি যা বৈষম্য, শত্রুতা বা সহিংসতার উদ্রেক করে আইন দ্বারা নিষিদ্ধ। আটিকেল ২৭; যে সমস্ত রাজ্যে জাতিগত, ধর্মীয় বা ভাষাগত সংখ্যালঘুদের অস্তিত্ব রয়েছে, সেই সমস্ত সংখ্যালঘুদের অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিদের তাদের গোষ্ঠীর অন্যান্য সদস্যদের সাথে সম্প্রদায়ে, তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি উপভোগ করার, তাদের নিজস্ব ধর্ম পালন ও পালন করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হবে না, অথবা তাদের নিজস্ব ভাষা ব্যবহার করতে।
Declaration of the general assembly (১৯৮১) আটিকেল ৬(ক); উপাসনা বা সমাবেশের জন্য স্থান বজায় রাখা; আটিকেল (খ); দাতব্য বা মানবিক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা; এবং আটিকেল (গ) আচার বা প্রথা সম্পর্কিত উপকরণ তৈরি করা, অর্জন করা এবং ব্যবহার করা। পরিশেষে বলা যায়; আইনের শাসন, ন্যায় বিচার, নিরাপত্তা এবং শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য ধর্মীয় স্বাধীনতা কিংবা ধর্মীয় চর্চার স্বাধীনতা থাকা দরকার। দেশ এবং দেশের বাইরে প্রচলিত আইনে এমনকি ইসলামিক আইনেও এই স্বাধীনতা এবং সমঅধিকারের কথা বলা আছে।
লেখক : মো: জুয়েল আজাদ; আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।