বিচারপতিদের অপসারণ: ষোড়শ সংশোধনীর রিভিউ শুনানি ১৬ নভেম্বর
সংবিধান ও সুপ্রিম কোর্ট

বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা পেল সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল

বিচারপতি অপসারণে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের বিধান ফিরিয়ে আনার যে রায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সাত বছর আগে দিয়েছিল, পর্যালোচনার পর সেই সিদ্ধান্তই বহাল রেখেছে সর্বোচ্চ আদালত।

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে আপিল বিভাগের দেওয়া ওই রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করেছিল রাষ্ট্রপক্ষ।

প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে ৬ বিচারপতির আপিল বেঞ্চ রোববার শুনানি শেষে কিছু নির্দেশনাসহ তা নিষ্পত্তি করে দিয়েছে।

বিচারপতি অপসারণ প্রক্রিয়া নিয়ে গত সরকারের সময় যে জটিলতা তৈরি হয়েছিল, এই রিভিউ রায়ের মধ্য দিয়ে তার অবসান ঘটল বলে আইনজীবীরা মনে করছেন।

এর আগে গত ১৫ আগস্ট আপিল বিভাগের কার্যতালিকার ৩৭ নম্বর ক্রমিকে থাকা আইটেমটি শুনানির জন্য প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির আপিল বিভাগে মেনশন করেন রিটকারী পক্ষের সিনিয়র আইনজীবী মনজিল মোরসেদ।

ওই সময় অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান আদালতকে বলেন, এটার বিষয়ে ইনস্ট্রাকশন দরকার। তাই সময় চাচ্ছি।

এরপর সর্বোচ্চ আদালত বলেন, ‘ওয়ান উইক আফটার ভ্যাকেশন’ এটি শুনানির জন্য আসবে।

তবে ‘আওয়ামী লীগের ফ্যাসিস্ট বিচারক’ উল্লেখ করে তাদের পদত্যাগের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের হাই কোর্ট ঘেরাও কর্মসূচির প্রেক্ষাপটে হাই কোর্টের ১২ বিচারপতিকে কোর্ট পরিচালনার জন্য বেঞ্চ দেওয়া হচ্ছে না বলে প্রধান বিচারপতির সিদ্ধান্ত বুধবার বিকালে জানান সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল আজিজ আহমেদ ভূঞা।

সে সময় তিনি আরও বলেন, বিচারপতিদের অপসারণের কোনো বিধান এখন না থাকায় বিচারপতিদের অপসারণের বিধান-সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের রিভিউটি আগামী ২০ অক্টোবর আপিল বিভাগে ১ নম্বর আইটেমে শুনানির জন্য থাকবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

প্রেক্ষাপট

সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিতে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পাস করা হয়। ওই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর তা গেজেট আকারে প্রকাশ হয়।

কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের কাছে ন্যস্ত করে আনা সংবিধানের এ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একই বছরের ৫ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের নয়জন আইনজীবী হাই কোর্টে একটি রিট করেন।

সে রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১৬ সালের ৫ মে হাই কোর্টের তিন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত বিশেষ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন।

হাই কোর্টের দেওয়া ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৬ সালের ২৮ নভেম্বর রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে। সে আপিলের শুনানি শেষে ২০১৭ সালের ৩ জুলাই তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির আপিল বেঞ্চ রাষ্ট্রপক্ষের আপিল খারিজ করে রায় ঘোষণা করেন।

বহুল আলোচিত ওই রায়ের পর্যবেক্ষণে দেশের গণতন্ত্র, রাজনীতি, সামরিক শাসন, নির্বাচন কমিশন, সুশাসন, দুর্নীতি, বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপসহ বিভিন্ন বিষয় উঠে আসে। তবে আপিল বিভাগের দেওয়া রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ।

সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কী?

বিচারকরা যদি সংবিধান লঙ্ঘন করেন কিংবা গুরুতর অসদাচরণের দায়ে অভিযুক্ত হন, সে ক্ষেত্রে তাদের অপসারণের জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কর্তৃক তদন্ত করা হবে। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান ও জ্যেষ্ঠ বিচারকদের সমন্বয়ে গঠিত এ কাউন্সিল বিচারকদের আচরণবিধিও নির্ধারণের কাজ করবে।

বাংলাদেশ সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের ৩ নম্বর দফায় বলা আছে, ‘‘একটি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল থাকবে যা এই অনুচ্ছেদে ‘কাউন্সিল’ বলে উল্লিখিত হবে এবং বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারকের মধ্যে পরবর্তী যে দুজন কর্মে প্রবীণ তাদের নিয়ে গঠিত হবে। এই পদ্ধতিতে শর্ত থাকে যে, কাউন্সিল যদি কোনও সময় কাউন্সিলের সদস্য এরকম কোনও বিচারকের সামর্থ্য বা আচরণ সম্পর্কে তদন্ত করেন, অথবা কাউন্সিলের কোনও সদস্য যদি অনুপস্থিত থাকেন, অথবা অসুস্থতা কিংবা অন্য কোনও কারণে কাজ করতে অসমর্থ হন, তাহলে কাউন্সিলের যারা সদস্য আছেন, তাদের মধ্যে পরবর্তী যে বিচারক কর্মে প্রবীণ তিনিই অনুরূপ সদস্য হিসেবে কাজ করবেন।’’

যেভাবে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠিত হয়েছিল

১৯৭২ সালের সংবিধানে ৯৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অদক্ষতা, অযোগ্যতা, দুর্নীতিসহ অসদাচরণের কারণে বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে ছিল। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সময় সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত করা হয়।

১৯৭৮ সালে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান এক সামরিক ফরমানে বিচারপতিদের অপসারণে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাতিল করেন। এ সময় বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা দেওয়া হয় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে।

সংবিধানের অনুচ্ছেদ নং ৯৬(২)-এর বিধানে উল্লেখ ছিল, ‘প্রমাণিত অসদাচরণ বা অসামর্থ্যের কারণে সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতার দ্বারা সমর্থিত সংসদের প্রস্তাবক্রমে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ ব্যতীত কোনও বিচারককে অপসারিত করা যাবে না।’