মোঃ ইব্রাহীম খলিলুল্লাহ্ : বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের ঘটনা সমাজের নৈতিক ও নীতিগত মূল্যবোধকে গভীরভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। ডয়চে ভেলের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী বিগত দুই-মাসে বাংলাদেশে মোট ৯৬ জন নারী ধর্ষণ ও ২৯৪ জন নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে সারা দেশে ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে মোট ৪০১ জন নারী। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৩৫৭ জন, যা মোটের ৮৮.৯৫%।
বিগত বছরের সাথে তুলনা করলে দেখা যায় ২০২৫ সালের প্রথম দুই মাসে ধর্ষণের ঘটনা প্রায় ২৬.৮% বৃদ্ধি পেয়েছে। ধর্ষণের ঘটনা এভাবে আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাওয়ার ধর্ষণ ও নারী নিপীড়ন ঠেকাতে হিমশিম খাচ্ছে সরকার। বিশেষ করে মাগুরায় আট বছরের শিশু আছিয়া ধর্ষিত হওয়ার পর থেকে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে দেশের নানা প্রান্তে আন্দোলনে মুখর হয়েছে ছাত্র-জনতা ফলে অতিরিক্ত চাপ বেড়েছে সরকারের উপর।
এমতাবস্থায় চাপ সামলাতে ও জনরোষ ঠেকাতে ধর্ষণের মামলায় জামিনের সুযোগ বন্ধ করে ৯০ দিনের মধ্যে বিচার সম্পন্নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এই কঠোর আইনানুগ উদ্যোগ সমাজে অপরাধীদের বিরুদ্ধে তৎক্ষণাৎ পদক্ষেপ গ্রহণের প্রত্যাশা জাগালেও, বিচারব্যবস্থার কাঠামোগত দুর্বলতা ও মানবাধিকার সংরক্ষণের প্রশ্নও নতুন করে সামনে এনেছে।
নিঃসন্দেহে, সরকারের এই উদ্যোগের উদ্দেশ্য অপরাধীদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যাতে নারীদের প্রতি হওয়া অত্যাচার ও নির্যাতনের ঘটনা দ্রুত দমন করা যায়। ধর্ষণ একটি জঘন্যতম অপরাধ এবং বিচারব্যবস্থার কাঠামোগত দুর্বলতা এই অপরাধের বিস্তারকে উৎসাহিত করে। দ্রুত বিচার না হওয়া, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও আইনের ফাঁকফোকরের ফলে ধর্ষণের পরিমাণ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ফলে জামিনের সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া ও ৯০ দিনের মধ্যে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার পদক্ষেপটি নিঃসন্দেহে অপরাধীর মনে ভয় জাগাবে এবং ধর্ষণ রোধে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। তবে প্রশ্ন উঠে, যদি কোনো নিরপরাধ ব্যক্তিকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ধর্ষণের অপরাধে অভিযুক্ত করা হয় তাহলে তার কি হবে?
আরও পড়ুন : ধর্ষণের অপরাধ এবং বিচারের পদ্ধতি- সরকারের দায়বদ্ধতা
প্রসঙ্গত, ২০১৭ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) তদন্ত করা ১,০০৯টি ধর্ষণ মামলার প্রায় ২১% মামলাই তদন্তে প্রমাণিত হয়নি। এর মধ্যে ১২.০৯% মামলা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে এবং ৮.৭২% মামলায় আইন বা তথ্যের ভুল পাওয়া গেছে। এছাড়াও, আইনজীবীদের সাথে কথা বলে জানা যায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের অধীনে করা মামলাগুলোর অধিকাংশই বিয়ের প্রলোভনে শারীরিক সম্পর্ক বা ব্রেকআপ এর পর প্রেমিকের বিরুদ্ধে প্রেমিকার মিথ্যা ধর্ষণ মামলা দায়ের করা হয় যা প্রকৃতপক্ষে ধর্ষণের মধ্যে পরে না।
অনেকে এও মন্তব্য করেন যে এই আইনের অধীনে করা ৯০% বা তার অধিক মামলাই হয় মিথ্যা আর হয়রানিমূলক। এমতাবস্থায়, মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলার ফলে নিরপরাধ ব্যক্তি বছরের পর বছর জামিন না পেয়ে কারাগারে আটকে থাকতে পারে, যা তার মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের শামিল। আবার, জনমতের চাপ, রাজনৈতিক প্রভাব ও অতিরিক্ত আবেগপ্রবণতার মধ্যে বিচারপ্রক্রিয়া পরিচালনা করা হলে, নির্দোষ ব্যক্তিকে অন্যায়ভাবে কঠোর শাস্তিতে দণ্ডিত করার আশঙ্কাও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায়না।
জামিন নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল জানিয়েছেন ধর্ষণ মামলার ক্ষেত্রে ১৫ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের বাধ্যবাধকতা থাকবে। দ্রুত ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণের জন্য সরকারের এমন সিদ্ধান্ত ইতিবাচক হলেও সামাজিক বাস্তবতায় এটি কতটুকু সম্ভব তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। বেশীরভাগ তদন্ত সংস্থাগুলোর কাঠামোগত দূর্বলতা বিদ্যমান ও পর্যাপ্ত দক্ষতা নেই।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তদন্ত বিলম্বিত হয়, সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহে গাফিলতি থাকে, এবং অপরাধীদের সাথে রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক যোগসাজশের কারণে সঠিক প্রতিবেদন পাওয়া যায় না। ফলে মামলার বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘসূত্রতায় পরিণত হয়, যার ফলে বিচারহীনতা ও মামলাজট বৃদ্ধি পায়। ফলে মাত্র ১৫ দিনে সঠিক ও স্বচ্ছ তদন্ত নিশ্চিত করা বর্তমান প্রেক্ষাপটে অলীক বললেও ভুল হবেনা।
পাশাপাশি, ৯০ দিনের মধ্যে বিচারকার্য সম্পন্ন করা ঘিরেও তৈরি হয়েছে আশঙ্কা। বাংলাদেশে ধর্ষণের মামলার তুলনায় ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা সীমিত। ইতিমধ্যেই এই সীমিত সংখ্যক ট্রাইবুন্যালগুলো অতিরিক্ত মামলার চাপে হিমশিম খাচ্ছে। এমতাবস্থায় ৯০ দিনের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করার সিদ্ধান্ত কতটা বাস্তবসম্মত তা প্রশ্নের দাবি রাখে।
আরও পড়ুন : ধর্ষণ মামলায় জামিন নিষিদ্ধ: ন্যায়বিচার নাকি বাড়তি ঝুঁকি?
এছাড়াও, বর্তমান ডিজিটাল যুগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, অনলাইন ফ্যাক্টচেক পোস্ট ও গণমাধ্যম সাধারণ জনগণের মাঝে অপরাধবিরোধী চেতনা জাগ্রত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তবে, বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে জনমতের এই চাপকে সতর্কতার সাথে বিবেচনা করা জরুরি।
অপরাধের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন ও গণমাধ্যমের সক্রিয়তা অপরিহার্য হলেও, বিচারপ্রক্রিয়ায় আবেগপ্রবণতা বা রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত থেকে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা উচিত। এতে নিরপরাধ ব্যক্তিরা হয়রানি বা অন্যায় শাস্তির শিকার হওয়া থেকে রক্ষা পাবে, এবং প্রকৃত অপরাধীরা যথাযথ শাস্তি পাবে। প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক চাপ থেকে বিচারপ্রক্রিয়াকে মুক্ত রাখা এবং বিচারিক নিরপেক্ষতা বজায় রাখলে আইনি সিদ্ধান্তগুলো অধিকতর বিশ্বাসযোগ্য ও ন্যায্য হবে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে, আদালত, সরকার ও নাগরিক সমাজের মিলিতভাবে কাজ করা জরুরী, যাতে আইনানুগ সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় জনমতের প্রভাব থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে নিরপেক্ষতা বজায় রাখা যায়। এটি ভুলে গেলে চলবে না যে, শুধু অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি প্রদানেই নয়, বরং নিরপরাধ ব্যক্তিকে অবিচার থেকে রক্ষা করার দায়িত্বও সমানভাবে পালন করা উচিত। শুধুমাত্র আইন কড়া করে অপরাধ প্রতিরোধ সম্ভব না, বরং বিচারব্যবস্থার কাঠামোগত উন্নয়ন, প্রশিক্ষিত তদন্ত সংস্থা ও পর্যাপ্ত ট্রাইব্যুনাল ব্যবস্থা নিশ্চিত করলে সমাজে সত্যিকার ন্যায় প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত হবে।
এই সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে, আইন-কঠোরতা ও মানবাধিকার সংরক্ষণের মধ্যে একটি সঠিক ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব হবে। বিচারব্যবস্থা যদি জনমতের চাপ থেকে মুক্ত, স্বচ্ছ এবং নিরপেক্ষ থাকে, তবেই সমাজে সত্যিকারের ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা যাবে। সুষ্ঠু ও মানবিক বিচার ব্যবস্থা গড়ে তোলা আমাদের সকলের সর্বোচ্চ লক্ষ্য হওয়া উচিত, যাতে নারী ও শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একসাথে জয়লাভ করা সম্ভব হয়।
লেখক: মোঃ ইব্রাহীম খলিলুল্লাহ্, সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ ল অ্যালায়েন্স (বিএলএ)। ই-মেইলঃ ibrahimkhalilullah010@gmail.com