কাজী মহিবুল হক শাফি: ভারতের ধর্মীয় ও সাংবিধানিক কাঠামো বর্তমানে এক অভূতপূর্ব সংকটের মুখে। সম্প্রতি রাষ্ট্রপতির সম্মতিতে আইন হিসেবে কার্যকর হওয়া ওয়াকফ (সংশোধন) আইন, ২০২৫ দেশটির সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তিকে এক তীব্র প্রশ্নবিদ্ধ অবস্থানে নিয়ে এসেছে।
সরকার এটিকে ‘সংখ্যালঘুদের কল্যাণে ঐতিহাসিক সংস্কার’ হিসেবে তুলে ধরলেও বাস্তবতা হলো, এই আইন এক গভীর সাংবিধানিক ও সামাজিক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে, যার প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত থেকে সমাজের প্রান্তিক মানুষ পর্যন্ত।
এই আইনের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে সুপ্রিম কোর্টে রিট দায়ের করেছেন কংগ্রেস সাংসদ মোহাম্মদ জাভেদ, এআইএমআইএম প্রধান আসাদউদ্দিন ওয়াইসি, আম আদমি পার্টির বিধায়ক আমানতুল্লাহ খান এবং সিভিল রাইটস সংরক্ষণে নিয়োজিত ‘অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য প্রোটেকশন অফ সিভিল রাইটস’।
তারা সংবিধানের ১৪, ১৫, ২১, ২৫, ২৬, ২৯, ৩০ এবং ৩০০(এ) ধারার পরিপন্থী বলে এই আইনকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। বিশেষভাবে বিতর্কিত ৩৯(এ) ধারা অনুসারে, কেউ ইসলাম ধর্মে ওয়াকফ সম্পত্তি সৃষ্টি করতে পারবে না, যদি না সে কমপক্ষে পাঁচ বছর ধরে ইসলাম ধর্ম পালন করে।
এই শর্ত ইসলামি শরিয়তের পরিপন্থী এবং ধর্মান্তরিত মুসলিমদের প্রতি একপ্রকার বৈষম্যমূলক আচরণ। এতে ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মীয় স্বাধীনতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
আরও উদ্বেগজনক হলো, যেসব মসজিদ, দরগাহ বা কবরস্থান ঐতিহাসিকভাবে ইসলামের প্রয়োজনে ব্যবহৃত হয়েছে কিন্তু যেগুলোর লিখিত নথিপত্র নেই সেসবের ওপর থেকে সুরক্ষা তুলে নেওয়া হয়েছে। এমন নীতির বিপরীতে আযোধ্যা মামলার রায়েও এমন ঐতিহাসিক ব্যবহারকে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছিল।
আরও পড়ুন : ভারতের বিতর্কিত ওয়াকফ বিল ২০২৫: কী পরিবর্তন আসছে নতুন আইনে?
আইনে আরও বলা হয়েছে, ওয়াকফ বোর্ডে অমুসলিমদের অন্তর্ভুক্তি বাধ্যতামূলক করা হবে। তবে হিন্দু মন্দির বা শিখ গুরুদ্বারায় এমন কোনো বিধান নেই। এটি একটি একতরফা “আন্তঃধর্মীয়” অন্তর্ভুক্তি, যা কার্যত সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপকে বৈধতা দেয়।
এছাড়া প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ জেলা প্রশাসকের হাতে হস্তান্তরের মাধ্যমে ওয়াকফ বোর্ডের স্বশাসনকে একপ্রকার বিলুপ্ত করা হয়েছে। আইনের ‘contravention’ বা ‘লঙ্ঘন’ সংক্রান্ত ধারা কর্তৃপক্ষকে অনির্দিষ্ট ও সীমাহীন ক্ষমতা দিয়েছে, যার ফলে ‘সম্ভাব্য অনিয়ম’ এর ভিত্তিতে ওয়াকফ সম্পত্তি বাতিল করা যেতে পারে যা সরাসরি সংবিধানের ন্যায়বিচার চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
আইনের ৩(ডি) ও ৩(ই) ধারা অনুযায়ী, সংরক্ষিত স্মারক এলাকায় ওয়াকফ নিষিদ্ধ এবং তফসিলভুক্ত জনগোষ্ঠী থেকে ধর্মান্তরিত মুসলমানরা ওয়াকফ প্রতিষ্ঠার অধিকার হারাচ্ছেন।
পাশাপাশি, এই আইনের সঙ্গে মুসলমান ওয়াকফ আইন বাতিল করাও এক সুসংগঠিত আইনি কৌশলের ইঙ্গিত দেয়, যার মাধ্যমে মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান পরিচালনার অধিকার কাঠামোগতভাবে খর্ব করা হয়েছে।
সরকার যেখানে এই আইনকে আধুনিকীকরণ ও প্রশাসনিক স্বচ্ছতার খাতিরে গ্রহণযোগ্যতা দিতে চাচ্ছে, সেখানে বিরোধীদলগুলো একে ‘স্পষ্টভাবে মুসলিমবিরোধী ও অসাংবিধানিক’ আখ্যা দিচ্ছে। কারণ, অন্য কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে এমন হস্তক্ষেপ বা বিধিনিষেধ আরোপের নজির নেই।
এই আইন এককভাবে একটি সম্প্রদায়ের ধর্মীয় স্বাধীনতা হরণ না করে, বরং গোটা ভারতের বহুত্ববাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সাংবিধানিক মূল্যবোধের ওপর এক মৌলিক আঘাত। এটি নিছক আইনি বিতর্ক নয়, বরং ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ ভবিষ্যতের ওপর একটি বড় ধরনের পরীক্ষা।
প্রথিতযশা আইনবিদ ও সমাজকর্মীরা শিরুর মঠ মামলা (Shirur Mutt Judgment) এর দৃষ্টান্ত তুলে ধরে বলছেন, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের স্বায়ত্তশাসন হচ্ছে সাংবিধানিকভাবে সুরক্ষিত অধিকার। তাই এই আইনের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই কেবল আইন রক্ষার জন্য নয় বরং দেশের নৈতিক ভিত্তি ও বহুত্ববাদী চেতনা রক্ষার জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
শেষ পর্যন্ত, ভারতের বিচারব্যবস্থার কাঁধেই বর্তেছে একটি ধর্মনিরপেক্ষ জাতির ভবিষ্যৎ রক্ষার গুরুদায়িত্ব। এই মুহূর্তে আশা একটাই বিচার হবে যুক্তিসংগত, ন্যায়সঙ্গত এবং ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের মূল চেতনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।
লেখক : শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ফেনী ইউনিভার্সিটি।