মঈদুল ইসলাম: স্পেশাল জজের বিচার্য মনে করে সিনিয়র স্পেশাল জজের কাছে মামলা পাঠাচ্ছেন ম্যাজিস্ট্রেট। আর, সিনিয়র স্পেশাল জজ আবার তা স্পেশাল জজের কাছে না পাঠিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের বিচার্য মনে করে ফেরত পাঠাচ্ছেন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছেই (শুনলাম নাকি সিনিয়র স্পেশাল জজ মামলার নথিতে কোনো আদেশ না লিখেই বিচার করার মৌখিক নির্দেশ দিয়েফেরত পাঠাচ্ছেন)। দণ্ডবিধির ৪০৮ ধারার বিচার নিয়েঅনেক জেলাতেইচলছে এই ঠেলাঠেলি।
এ-পোড়ার দেশে এরকমটা যে ঘটবে সেটা আঁচ করেছিলাম আগেই, কথাটা তুলেও ছিলাম ২০১৬ সালে দুদক আইন সংশোধনের খসড়া চূড়ান্ত করারসময়ই। আইন মন্ত্রণালয়ের ড্রাফটিং ডিভিশনের তখনকার সচিব (জনাব শহীদুল হক) মহোদয়কে বলেছিলাম, দণ্ডবিধির ৪০৮ধারাটা তো দুদক আইনের তফসিল থেকে বাদ যাচ্ছে, কিন্তু, ‘ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট (১৯৫৮) এর তফসিলে থেকে যাচ্ছে। ফলে ধারাটা আগের মতোই স্পেশাল জজেরই বিচারযোগ্য থেকে যাচ্ছে (দুদকের সব মামলাই স্পেশাল জজ কর্তৃক বিচারযোগ্য )। দুদক আইনের সাথে মিল রেখে ৪০৮ ধারাটা তফসিল থেকে বাদ দিয়ে ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্টও সংশোধন না করলেবিচারে বিভান্তি দেখা দেবে। কিন্তু, তিনি ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট সংশোধনের কোনো প্রস্তাব আসেনি বলে তা করা যাবে না বলেন। বললাম, এই অ্যাক্টটা তো আইন মন্ত্রণালয়েরই, আইন মন্ত্রণালয়ই প্রস্তাব তুলে তা সংশোধন করতে পারে। তখনকার আইনমন্ত্রী (অ্যাডভোকেট আনিসুল হক) মহোদয়ের কাছেও কথাটা পেড়েছেলাম। উল্টো তিনি দুদক থেকেই প্রস্তাব দিতে বলেন।
তাও দিয়েছিলাম। তার পরিণতি বলছি একটু পরে। তার আগে আরো কিছু কথা বলার আছে। পাবলিক সার্ভেন্ট, মানে সরকারি কর্মচারী তার কাছে ন্যস্ত থাকা বা তার নিয়ন্ত্রণে থাকা সরকারি অর্থ/সম্পদ আত্মসাত করলে হয় দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আর, সরকারি কর্মচারী ছাড়া অসরকারি, বেসরকারি, ব্যক্তিগত, অন্য সব যত কর্মচারী আছে তারা যদি তাদের কাছে ন্যস্ত থাকা বা নিয়ন্ত্রণে থাকা অর্থ/সম্পদ আত্মসাত করে তাহলে সেটা হয় দণ্ডবিধির ৪০৮ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ(যার শাস্তি সাত বছর পর্যন্ত জেল বা কিছু জরিমানা বা দুটোই)। এটা ঠিক দুর্নীতির পর্যায়ে পড়েও না। কারণ, এতে সরকারি কোনো অর্থ-স্বার্থের সংশ্লেষ নেই। নিতান্তই ব্যক্তিগত ও বেসরকারি অর্থ-স্বার্থের ব্যাপার। কিন্তু, কি আশ্চর্য! ১৯৫৭ সালে যখন দুর্নীতি দমন আইন (অ্যান্টি-করাপশান অ্যাক্ট, ১৯৫৭) হয় তখন দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারার সাথে সাথে ৪০৮ ধারাই শুধু নয়, দণ্ডবিধির একেবারে ৪০৩ থেকে ৪০৯পর্যন্ত আত্মসাতের যে-ক’টি ধারা আছে সবক’টি এ-আইনের তফিসিলে ঢুকিয়ে দেয়া হয় (যাতে আসল দুর্নীতি ছেড়ে নকল কাজে ব্যস্ত থাকে দুর্নীতি দমন ব্যুরো!)।
এর পরে দুর্নীতির বিচারের স্পেশাল জজ আদালত সৃষ্টির জন্য ১৯৫৮ সালে হয় ‘ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট। শুরু থেকেই এ-আইনের তফসিলে দণ্ডবিধির ৪০৮ ধারাটি ঢুকিয়ে রাখা হয়। ফৌজদারি কার্যবিধিতে (সিআরপিসি,২য় তফসিল) দণ্ডবিধির এই ৪০৮ ধারাটি রাখা ছিল দায়রা-বিচার্য করে, ১৯৮০ সালে এসে তা ম্যাজিস্ট্রেট (প্রথম শ্রেণি/মেট্রোপলিটান) বিচার্য করা হয়। ফৌজদারি কার্যবিধির সে-বিধান অক্ষত রেখে ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্টের ৫ ধারায় বিধান দেয়া হয়, ফৌজদারি কার্যবিধি বা প্রচলিত অন্য কোনো আইনে যে-বিধানই থাকুক না কেন ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্টের তফসিলভুক্ত সব অপরাধ কেবলই স্পেশাল জজ কর্তৃক বিচার্য হবে। যার ফলে দণ্ডবিধির ৪০৮ ধারাটি শুরু থেকেই কেবলই স্পেশাল জজ কর্তৃক বিচার্য ছিল। আবার, ১৯৮৭ সালে এসে ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ট অ্যাক্টের ৪(২) ধারা সংশোধনের ফলে এ-আইনের তফসিলভুক্ত সব অপরাধ কেবলই সিনিয়র স্পেশাল জজ কর্তৃক আমলযোগ্য হয়। এর ফলে দণ্ডবিধির ৪০৮ ধারাও কেবলই সিনিয়র স্পেশাল জজ কর্তৃক আমলযোগ্য ও স্পেশাল জজ কর্তৃক বিচার্য থাকে।
২০০৪ সালে দুদক (দুর্নীতি দমন কমিশন) আইন হলে তার তফসিলেও দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারার সাথে ৪০৮ ধারাটাও ঢুকিয়ে দেয়া হয় (এবারে বাদ দেয়া হয় দণ্ডবিধির ৪০৩ থেকে ৪০৭ ধারাসমূহ)। তার সাথে মিল রেখে ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্টের তফসিলেও দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারার সাথে ৪০৮ ধারাও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যার ফলে এবারেও দণ্ডবিধির ৪০৮ ধারাটি কেবলই সিনিয়র স্পেশাল জজ কর্তৃক আমলযোগ্য ও স্পেশাল জজ কর্তৃক বিচার্য থেকে যায়।
অ-দুর্নীতির এই ৪০৮ ধারার অপরাধের অনুসন্ধান-তদন্ত নিয়ে দুদকের যথেষ্ট সময় ও জনবলের অপচয় চলতে থাকে। তার ওপরে আবার ২০১৩ সালের নভেম্বরে দুদক আইনের তফসিলে বিবেচনাহীনভাবে ঢালাওঢুকিয়ে দেয়া হয় দণ্ডবিধির ৪২০ (প্রতারণা),৪৬২এ (ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারীর অবহেলাজনক আচরণ, সাজা দু-বছর পর্যন্ত জেল বা কিছু জরিমানা বা দুটোই ), ৪৬২বি (ব্যাংকে প্রতারণা, সাজা দু-বছর পর্যন্ত জেল বা কিছু জরিমানা বা দুটোই), ৪৬৬ (কোর্ট বা সরকারি নথি জালিয়াতি), ৪৬৭ (মূল্যবান জামানত ইত্যাদি জালিয়াতি), ৪৬৮ (প্রতারণার উদ্দেশ্যে জালিয়াতি), ৪৬৯ (কারো সুনাম ক্ষুণ্ন করার উদ্দেশ্যে জালিয়াতি) ৪৭১ (জাল দলিলাদি ব্যবহার), ৪৭৭এ (হিসাব-বই ইত্যাদি বিকৃতকরণ) ধারাগুলো। (ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্টের তফসিলে কিন্তু হাত দেয়া হয়নি তখন)ব্যক্তিগত ও বেসরকারি অর্থ-স্বার্থের এই সব অপরাধেরঅভিযোগ ও মামলার ঢলেদুদকের একেবারে জেরবার অবস্থা।
পরিত্রাণ পেতে দুদক প্রস্তাব তুলে সরকারি সম্পদ সংক্রান্তে সংঘটিত অথবা সরকারি বা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্তৃক দাপ্তরিক দায়িত্ব পালনকালে সংঘটিতটুকু রেখে প্রতারণা-জালিয়াতির ঐসব ধারা দুদক আইনের তপসিল থেকে বাদ দিতে। একই সঙ্গেদণ্ডবিধির ৪০৮ ধারাটাওপ্রথমবারের মতো পুরোপুরি বাদ দেবার প্রস্তাব করা হয় তাতে ।দুদক থেকে ঐ-প্রস্তাব মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছিল ২০১৪ সালের জুলাইতে। আমি ২০১৫ সালের এপ্রিলে দুদকে মহাপরিচালক হয়ে এসে দেখি তার সাথেক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্টের তপসিল থেকে দণ্ডবিধির ৪০৮ ধারা বাদ দেবার প্রস্তাব দেয়া নেই। আন্তঃমন্ত্রণালয় মিটিং কয়েকটি হয়ে গেছে, মতামত চূড়ান্ত হবার অপেক্ষায়, সেটা হলেই ভেটিং-এর জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে যাবে। ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট সংশোধনের প্রস্তাব জুড়ে দেবার সুযোগ চলে গেছে। এ-আইনটা আইন মন্ত্রণালয়ের করা, তাই ভেবেছিলাম তা সংশোধনের এ-ব্যাপারটা সেখানেই পাড়া যাবে এবং তাদেরকে সহজেই রাজি করানওযাবে।
কিন্তু, রাজি তো করা গেল না। ২০১৬ সালের জুনে পাশ হয়ে গেল দুদক আইন সংশোধন। দণ্ডবিধির ৪০৮ ধারা বাদ গেল দুদক আইন থেকে। এর পরে তা ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট থেকে বাদ দেবার (এবং আনুষঙ্গিক আরও দুয়েকটি বিষয়ে) সংশোধনীর খসড়া তৈরি করে দুদকের অনুমোদন নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মাধ্যমে (সেটাই নিয়ম, দুদকের জন্য সংযোগ মন্ত্রণালয় হলো মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ)প্রস্তাব পাঠাতে পাঠাতে লেগে যায় ২০১৭ সালের আগস্ট। বার কয়েক তাগাদা দিয়ে দিয়ে নিচের সব ঘাট পার করিয়ে ২০১৮ সালের এপ্রিলে তা যাওয়াই আইনমন্ত্রীর ঘরে। ফাইল সেই যে গেল তাঁর ঘরে আর বের হলো না। ফাইল নম্বর টুকে নিয়ে আসা ছিল। সুযোগ পেলেই তাঁকে, তাঁর পিএস, এপিএসকে ফাইলটার কথা বলেছি। চাকরি থেকে আমার অবসর হয়ে গেল কিন্তু ফাইল আর সেখান থেকে বের করা যায়নি। তাঁরও মন্ত্রীত্ব গেছে অবশেষে।
দণ্ডবিধির ৪০৮ ধারা বহাল রয়ে গেছে ক্রিমিন্যাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্টের তফসিলে। বিচার না করার উপায় নেই স্পেশাল জজের, আমল গ্রহণের ফায়সালা না করার উপায় নেই সিনিয়র স্পেশাল জজেরও। ম্যাজিস্ট্রেট বিচার করলে তা হবে এখতিয়ার বহির্ভূত বে-আইনি কাজ, টিকবে না তা উচ্চ আদালতে। ২০১৬ সালের দুদক আইন সংশোধন আইনের ৮ ধারায় বিশেষ বিধানে বিচারাধীন মামলা স্থানান্তরের যে-কথা বলা হয়েছে তাতে এখতিয়ার সম্পন্ন আদালতে স্থানান্তরের কথা বলা হয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেটের এখতিয়ার না থাকায়দণ্ডবিধির৪০৮ ধারার মামলা সেখানে স্থানান্তর হবে না।বিচার চলবে এখতিয়ারসম্পন্ন স্পেশাল জজে। দুদক আইন ছাড়াও তাঁর এখতিয়ার নির্ধারিত আছে ঐ ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্টেই। দুদক আইন সংশোধন আইনের বিশেষ বিধানে দণ্ডবিধির ৪০৮ ধারাটা বসানো হয়েছে তার অনুসন্ধান-তদন্ত দুদক থেকে সরাবার জন্যে। দুদকের আর কারবার নেই সে-ধারা নিয়ে।
দণ্ডবিধির ৪০৮ ধারার অপরাধ, যেটা আসলে দুর্নীতি নয় মোটেও, তার বিচার স্পেশাল জজে না হয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছেই হওয়া উচিত। কিন্তু, ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্টের তফসিল এবং তার ৪ (২) ও ৫ ধারার বিধি বাম। এর তফসিল থেকে দণ্ডবিধির ৪০৮ ধারাটা বাদ দিলেই বিধি ডান হয়ে যায়। বন্ধ হয় বিচার নিয়ে এই ঠেলাঠেলি। এখন, আইন উপদেষ্টা মহোদয়ের কি ফুরসত হবে আমার সেই আটকে থাকা ফাইলটা ছাড়বার।
লেখক: কলামিস্ট, প্রবন্ধকার ও আইনগ্রন্থকার; অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র জেলা জজ ও দুদকের সাবেক মহাপরিচালক। ই-মেইল : moyeedislam@yahoo.com