বিনা খরচে আইনি সেবা নিশ্চিতে অধিদপ্তর করার সুপারিশ

৯টি আইনের বিরোধ মধ্যস্থতার মাধ্যমে নিষ্পত্তি বাধ্যতামূলক

আইনগত সহায়তা প্রদান (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫

নয়টি (পাঁচটি দেওয়ানি ও চারটি ফৌজদারি) আইনের বিরোধ লিগ্যাল এইড অফিসে মধ্যস্থতার মাধ্যমে নিষ্পত্তি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। মামলা দায়েরের আগে এসব আইনের বিরোধ লিগ্যাল এইড অফিসের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করতে হবে। মধ্যস্থতা প্রক্রিয়া ব্যর্থ হলে বিরোধের কোনো পক্ষ প্রয়োজনে উপযুক্ত আদালতে মামলা দায়ের করতে পারবে। মধ্যস্থতার মাধ্যমে এসব আইনের বিরোধ নিষ্পত্তির চেষ্টা না করে কেউই সরাসরি মামলা দায়ের করতে পারবে না।

এমন বিধান যুক্ত করে “আইনগত সহায়তা প্রদান (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫” আইনের গেজেট গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগ হতে মঙ্গলবার (১ জুলাই) জনসাধারণের জন্য প্রকাশ করা হয়েছে।

রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সংবিধানের ৯৩(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জারিকৃত এই অধ্যাদেশের মাধ্যমে ২০০০ সালের ৬ নম্বর “আইনগত সহায়তা প্রদান আইন”-এ বিস্তৃত সংশোধন আনা হয়েছে।

এর আগে সম্প্রতি এই সংশোধনের অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এরপর মন্ত্রণালয়ের ভেটিং শেষে এ বিষয়ে গেজেট জারির সব প্রস্তুতি শেষে সংশোধিত অধ্যাদেশের গেজেট জারি হয়েছে।

গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী:

১. মধ্যস্থতা বাধ্যতামূলক: তফসিলে বর্ণিত বেশ কয়েকটি মামলার ক্ষেত্রে মামলা দায়েরের পূর্বে বাধ্যতামূলকভাবে মধ্যস্থতা প্রক্রিয়া গ্রহণ করতে হবে। এটি আইনি প্রক্রিয়াকে আরও দ্রুত, ব্যয়বহুলমুক্ত ও সহনশীল করবে। মধ্যস্থতা ব্যর্থ হলে মামলার অনুমতি দেওয়া হবে।

২. নতুন ধারা সংযোজন:

  • ধারা ২১খ: বাধ্যতামূলক প্রি-কেস মধ্যস্থতা
  • ধারা ২১গ: মধ্যস্থতা-চুক্তিকে আদালতের ডিক্রির মর্যাদা দেওয়া
  • ধারা ২১ঘ: সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার সহায়তা গ্রহণ
  • ধারা ২১ঙ: সরল বিশ্বাসে কার্য রক্ষার বিধান

৩. জাতীয় পরিচালনা বোর্ড পুনর্গঠন: আইনমন্ত্রীকে চেয়ারম্যান করে ১৯ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় পরিচালনা বোর্ড গঠনের বিধান রাখা হয়েছে। বোর্ডে সংসদ সদস্য, সচিব, আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট প্রতিনিধি এবং নারী ও মানবাধিকার সংস্থার প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়েছে।

৪. স্পেশাল মেডিয়েটর নিয়োগ: অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ এবং মধ্যস্থতা বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অভিজ্ঞ আইনজীবীদের মধ্য থেকে “স্পেশাল মেডিয়েটর” নিয়োগের বিধান যুক্ত হয়েছে। এই মেডিয়েটররা মধ্যস্থতা কার্যক্রম পরিচালনা করবেন এবং নির্ধারিত হারে সম্মানি পাবেন।

৫. সংজ্ঞা সংশোধন ও বিস্তার: “আইনগত সহায়তা” শব্দের ব্যাখ্যা আরও বিস্তৃত করা হয়েছে। এখন এটি অন্তর্ভুক্ত করছে আইনি পরামর্শ, মামলা সংক্রান্ত খরচ, মধ্যস্থতার ফি প্রদান, মামলাপূর্ব ও পরবর্তী মধ্যস্থতা এবং স্পেশাল মেডিয়েটরের সহায়তা।

চিফ লিগ্যাল এইড অফিসার ও স্পেশাল মেডিয়েটর

প্রতিটি লিগ্যাল এইড অফিসে একজন করে চিফ লিগ্যাল এইড অফিসার, লিগ্যাল এইড অফিসার ও প্রয়োজনে স্পেশাল মেডিয়েটর নিয়োগের বিধান রাখা হয়েছে। তারা আইনি পরামর্শ, মধ্যস্থতা পরিচালনা ও আদালতের প্রেরিত মামলা নিষ্পত্তি করতে পারবেন। স্পেশাল মেডিয়েটর হবেন অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ বা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আইনজীবী।

মধ্যস্থতা চুক্তির বৈধতা ও কার্যকারিতা

মধ্যস্থতার মাধ্যমে সম্পাদিত এবং চিফ লিগ্যাল এইড অফিসার কর্তৃক প্রত্যায়িত চুক্তি আদালতের ডিক্রি বা চূড়ান্ত আদেশের মর্যাদা পাবে। প্রয়োজনে এখতিয়ারসম্পন্ন আদালতের মাধ্যমে তা জারি করা যাবে। কার্যক্রম চলাকালীন বিশেষ আদেশে অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠান সহায়তা করতে বাধ্য থাকবে।

‘পরিচালক’ শব্দের পরিবর্তে ‘নির্বাহী পরিচালক’

সারা দেশে মাত্র ৬ জন কর্মকর্তা দিয়ে লিগ্যাল এইড কার্যক্রম পরিচালনা দুরূহ হয়ে পড়েছে। জনবল কাঠামো প্রসারণের সুযোগ তৈরি করতে ‘পরিচালক’ শব্দটি পরিবর্তন করে ‘নির্বাহী পরিচালক’ করা হয়েছে, যাতে প্রয়োজনমাফিক পদ সৃষ্টি সম্ভব হয়।

তফসিলে অন্তর্ভুক্ত বিষয়সমূহ:

  • পারিবারিক আদালত আইন, ২০২৩ এর ধারা ৫-তে উল্লিখিত বিষয়;
  • বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯১-তে উল্লিখিত বিরোধ;
  • সহকারী জজ আদালতের এখতিয়ারভুক্ত বন্টন সম্পর্কিত বিরোধ;
  • State Acquisition & Tenancy Act, 1950 এর section 96 এ উল্লিখিত অগ্রক্রয় সম্পর্কিত বিরোধ;
  • Non-Agricultural Tenancy Act, 1949 এর section 24 এ উল্লিখিত অগ্রক্রয় সম্পর্কিত বিরোধ;
  • পিতামাতার ভরণপোষণ আইন, ২০১৩ এর ধারা ৮ অনুসারে পিতা-মাতার ভরণপোষণ সম্পর্কিত বিরোধ;
  • Negotiable Instruments Act, 1881 এর section 138 এ বর্ণিত চেক ডিসঅনার সম্পর্কিত অভিযোগ (অনধিক পাঁচ লক্ষ টাকা মূল্যমান চেকের ক্ষেত্রে);
  • যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮ এর ধারা ৩ ও ৪ এ বর্ণিত যৌতুক সম্পর্কিত অভিযোগ;
  • নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ধারা ১১(গ)তে বর্ণিত যৌতুকের জন্য নির্যাতন সম্পর্কিত অভিযোগ।

প্রচলিত পদ্ধতি

জানা যায়, ২০০০ সালে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান আইন প্রণয়ন করা হয়। এই আইনের ২১ক ধারা অনুসারে সারা দেশে লিগ্যাল এইড অফিসার বিকল্প পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তি করেন এবং আইনি সেবাপ্রত্যাশীদের আইনি পরামর্শ প্রদান করেন। ২০০৯ সাল থেকে সরকারি খরচে সারা দেশে অসহায় বিচারপ্রার্থীদের আইনি সহায়তা প্রদান কার্যক্রম চালু হয়েছে। আইনি সহায়তা প্রদানের জন্য প্রতিটি জেলায় বর্তমানে একজন করে লিগ্যাল এইড অফিসার রয়েছেন।

লিগ্যাল এইড অফিসার একজন বিচারক এবং লিগ্যাল এইড অফিসারের কর্মকে এরই মধ্যে গেজেট দ্বারা বিচারিক কর্ম হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। আইনের অধীনে থেকে লিগ্যাল এইড অফিসার ‘মধ্যস্থতা কার্যক্রম’ পরিচালনা করেন এবং আইনি প্রক্রিয়ায় দুই পক্ষের সম্মতি ও সমঝোতায় মধ্যস্থতা চুক্তি সম্পাদন করে থাকেন। এ প্রক্রিয়ায় বিরোধ নিষ্পত্তিতে সুফলও মিলছে। অর্থ ও সময় দুটিই সাশ্রয় হচ্ছে।

সুফল

জানা গেছে, ২০০৯ সাল থেকে গত মার্চ পর্যন্ত এই সংস্থায় ১১ লাখ ৯৫ হাজার ৭৫ জন অসচ্ছল বিচারপ্রার্থী বিনামূল্যে আইনি সেবা নিয়েছেন। সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড অফিস, দেশের ৬৪ জেলা লিগ্যাল এইড অফিস, ঢাকা ও চট্টগ্রাম শ্রমিক আইনগত সহায়তা সেল, সরকারি আইনি সহায়তায় জাতীয় হেল্পলাইন কলসেন্টারে (টোল ফ্রি-‘১৬৪৩০’) মাধ্যমে এ সেবা দেওয়া হয়।

আর এ সময়ে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ২৫২ কোটি ৫১ লাখ ৬১ হাজার ৮১ টাকা আদায় করে বিচারপ্রার্থীদের দিয়েছে জেলা লিগ্যাল অফিসগুলো। শ্রমিকের পাওনা, ভরণপোষণ, খোরপোষসহ নানা খাতে এই টাকা আদায় করে বিচারপ্রার্থীদের দেন লিগ্যাল এইড কর্মকর্তারা। বর্তমানে লিগ্যাল এইডের মাধ্যমে যে পরিমাণ মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে, তা তিন গুণ বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার আইন সংশোধন করে এই অধ্যাদেশ জারির সিদ্ধান্ত নিয়েছে।