মো. রায়হানুল ওয়াজেদ চৌধুরী : বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার ইতিহাসে কিছু ঘটনা সময়ের গণ্ডি পেরিয়ে দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠার বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশের সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায় স্বীকার করে রাজসাক্ষী হওয়ার আবেদন মঞ্জুর হওয়া। বাংলাদেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে এমনই এক যুগান্তকারী ঘটনা। এটি শুধু মামলার মোড় ঘুরিয়ে দেবে না, বরং বিচারিক স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং আইনের শাসনের প্রতিফলনে একটি নতুন মাইলফলক।
বাংলাদেশে এটাই প্রথম ঘটনা, যেখানে এত উচ্চ পর্যায়ের একজন সাবেক সরকারি কর্মকর্তা মানবতাবিরোধী অপরাধে নিজেকে অভিযুক্ত করে রাজসাক্ষী হিসেবে আদালতের আশ্রয় নিলেন।
সাধারণত, কোনো মামলায় যখন একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি নিজের অপরাধ স্বীকার করে এবং মামলার সঙ্গে জড়িত অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বা প্রমাণ উন্মোচনে আদালতকে সহযোগিতা করার প্রস্তাব দেন, তখন তাকে রাজসাক্ষী হিসেবে গ্রহণ করা হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইনে সেকশন ১৫-তে রাজসাক্ষী বা এপ্রুভারের (tender of pardon) এই বিধান রয়েছে।
ট্রাইব্যুনালের আইনের আলোকে, এপ্রুভার বা রাজসাক্ষী হতে হলে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে অবশ্যই নিজের অপরাধ স্বীকার করে সংশ্লিষ্ট অপরাধে জড়িত অন্যান্য ব্যক্তিদের সম্পর্কে নিরপেক্ষ ও প্রাসঙ্গিক তথ্য প্রদান করতে হয়। এর বিনিময়ে তার বিরুদ্ধে চলমান মামলায় শাস্তি লঘু করা বা কিছু ক্ষেত্রে দণ্ড মওকুফের সুযোগ থাকতে পারে। আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩-এর ধারা ১৫-এর অধীনে এই বিধানটি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখিত।
আরও পড়ুন : জুলাই গণহত্যার দায় স্বীকার, রাজসাক্ষী হলেন সাবেক আইজিপি মামুন
আইনের দৃষ্টিতে রাজসাক্ষী হওয়া একটি স্পর্শকাতর বিষয়। একজন সহ-অভিযুক্ত ব্যক্তি যখন সাক্ষ্য দেয়, তখন তা সাধারণত বিচারকদের কাছে সন্দেহের চোখে দেখা হয়। সাক্ষীর বক্তব্য এককভাবে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পারে না, যতক্ষণ না তা অন্যান্য সাক্ষ্য ও প্রমাণের সঙ্গে মিল রেখে প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশেষত, ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ৩৩৭ এবং সাক্ষ্য আইনের ধারা ১৩৩ অনুসারে, একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি একই মামলায় অপর আসামিদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে পারেন। তবে, তার বক্তব্যে অসঙ্গতি থাকলে সেটিকে অতিরিক্ত সতর্কতার সাথে বিবেচনা করতে হয়। যদিও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য আইন ও ফৌজদারি কার্যবিধি সরাসরি প্রযোজ্য নয় এবং ট্রাইব্যুনাল নিজস্ব আইন ও বিধি অনুযায়ী পরিচালিত হয়, তবে রাজসাক্ষীসংক্রান্ত সাধারণ নীতিগুলি এখানেও প্রযোজ্য হবে।
চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের এই সিদ্ধান্ত বিচারব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে একটি বিরল সাহসিকতা। একজন সাবেক আইজিপি হিসেবে তার এই অবস্থান আদালতের নিকট কেবল সাক্ষ্য নয়—বরং এটি একটি প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি, যে ন্যায়বিচারের পথে বসে নিতে কোনো অবস্থানই বাধা হতে পারে না। এটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতীত কর্মকাণ্ডের প্রতি নতুন করে আলো ফেলছে, এবং সংশ্লিষ্ট ঘটনার গভীরে পৌঁছানোর পথ প্রশস্ত করছে।
তবে, এপ্রুভার হওয়ার অর্থ এই নয় যে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি দায়মুক্ত হয়ে গেলেন। মামলার বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাকে কারাগারে থাকতে হবে; তার জামিনযোগ্যতা নেই। পাশাপাশি, রাজসাক্ষী হিসেবে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও রাষ্ট্রের একটি দায়িত্ব। বিচারপ্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা এবং সাক্ষীর নিরাপত্তা—উভয় বিষয়েই রাষ্ট্রকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ সাক্ষীর সাক্ষ্য বিচারিক প্রক্রিয়ায় প্রধান প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হয় এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সাক্ষীর সত্যনিষ্ঠ ও নির্ভীক সাক্ষ্য বিচারকের সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করে এবং মামলার ফলাফল নির্ধারণে প্রভাব ফেলে।
আরও পড়ুন : মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় শেখ হাসিনাসহ ৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন
এই ঘটনার প্রেক্ষাপটে আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা গ্রহণ করা উচিত—যেকোনো পদমর্যাদা বা অবস্থান বিচারব্যবস্থার ঊর্ধ্বে নয়। আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান, এবং অপরাধের বিচার হতেই হবে, তা যতটা সময়ই লাগুক না কেন। বিচারের দীর্ঘসূত্রতা, সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাব এবং প্রশাসনিক প্রভাব—এসব বাধাকে অতিক্রম করে এই ঘটনা আমাদের আইনের শাসনের প্রতি নতুন করে আশাবাদী করে তুলছে। এমন এক সময়ে, যখন বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, তখন চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের রাজসাক্ষী হওয়া জনসাধারণের মাঝে বিশ্বাস পুনঃস্থাপনের একটি সুযোগ এনে দিয়েছে। জুলাই-আগস্টের ঘটনাপ্রবাহের পেছনের অনেক অজানা তথ্য উন্মোচন করতে পারে, যা বিচারকে আরও শক্তিশালী করবে। এটি আরও প্রমাণ করে যে, ট্রাইব্যুনাল এখনও তার নিরপেক্ষতা এবং আইনিক ক্ষমতা বজায় রেখেছে।
সর্বোপরি, এই ঘটনা আমাদের একটি বার্তা দেয়—বিচারহীনতার সংস্কৃতি ভাঙতে হলে সাহসিকতা ও ন্যায়বোধের সম্মিলন প্রয়োজন। রাজসাক্ষী হওয়া সহজ নয়, বিশেষ করে যিনি দীর্ঘদিন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন তার পক্ষে। কিন্তু সত্যের পক্ষে দাঁড়ানোর এই পদক্ষেপ বিচারব্যবস্থাকে আরও বিশ্বাসযোগ্য, শক্তিশালী এবং মানবাধিকারের পক্ষে প্রতিশ্রুতিশীল করে তুলবে।
লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর, চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালত।