২৯৭ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা মামলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও জনতা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ড. আবুল বারকাতের জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেছেন আদালত।
আজ বুধবার (২৩ জুলাই) ঢাকার মেট্রোপলিটন সিনিয়র স্পেশাল জজ জাকির হোসেন গালিব জামিন নামঞ্জুরের আদেশ দেন।
শুনানির এক পর্যায়ে বিচারক বলেন, ব্যাংকের বোর্ডের সহায়তায় বিদেশে অর্থপাচার হয়েছে, যা নজিরবিহীন।
বিচারক শুনানিতে আরও বলেন, দুদকের মতো সংস্থার পক্ষে এতো এতো দুর্নীতি বিচারের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব না। এছাড়া দুদক যেসব মামলা করে সেসব মামলায় শাস্তিও হয় কম। দুর্নীতি করে পাঁচ হাজার কোটি টাকার, শাস্তি হয় পাঁচ বছরের।
এদিন সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে আবুল বারকাতকে মহানগর দায়রা জজ আদালতের হাজতখানায় নেওয়া হয় এবং ১১টা ৭ মিনিটে আদালতে তোলা হয়। কাঠগড়ায় একটি বেঞ্চে বসে থাকা অবস্থায় তাকে চিন্তিত দেখা যায়।
জামিন শুনানি: উভয়পক্ষের যুক্তি
আবুল বারকাতের পক্ষে জামিন শুনানি করেন আইনজীবী শাহিনুর ইসলাম। তিনি বলেন, “২০১৩ সালে এননটেক্স গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান সুপ্রভা স্পিনিং মিলস ঋণের আবেদন করে। যথাযথ প্রক্রিয়া মেনে বিষয়টি বোর্ডে উপস্থাপন করে বাংলাদেশ ব্যাংকের গাইডলাইন অনুযায়ী ঋণ মঞ্জুর করা হয়। ড. বারকাত কোনো নীতিমালা ভঙ্গ করেননি কিংবা দায়িত্বে অবহেলা করেননি।”
তিনি আরও বলেন, “পূর্বে দুদক একই বিষয়ে তদন্ত করে কোনো দুর্নীতি হয়নি বলে ক্লিয়ারেন্স দিয়েছিল। এখন একই বিষয়ে নতুন করে মামলা করা দ্বিচারিতা।”
অন্যদিকে দুদকের কৌঁসুলি মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর বলেন, “চেয়ারম্যান হিসেবে অধস্তন কর্মীদের অপরাধের দায় তাকেই নিতে হবে। এ মামলায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নরকেও আসামি করা হয়েছে।”
বিচারকের পর্যবেক্ষণ: অর্থ পাচার ও দুর্নীতির ধারাবাহিকতা
বিচারক বলেন, “সোনালী ব্যাংকের ৫ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির সময় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বলেছিলেন, ‘এটা কোনো টাকাই না’। এরপর থেকেই হাজার হাজার কোটি টাকা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে লোপাট হতে থাকে।”
তিনি বলেন, “ওয়ান ইলেভেন সরকারের সময় ট্রুথ কমিশন গঠন করে দুর্নীতিবাজদের সম্পদ রাষ্ট্রের কাছে জমা নিতে উদ্যাগ নেওয়া হয়েছিল। বর্তমান সরকার তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।”
তিনি আরও বলেন, এখন দুদকের মতো সংস্থার পক্ষে এতো এতো দুর্নীতি বিচারের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব না। এছাড়া দুদক যেসব মামলা করে সেসব মামলায় শাস্তিও হয় কম। দুর্নীতি করে পাঁচ হাজার কোটি টাকার, শাস্তি হয় পাঁচ বছরের।
আবুল বারকাতকে উদ্দেশ করে বিচারকের বক্তব্য
“সব অভিযোগে আপনি জড়িত— এটা আমি বলছি না,” বলেন বিচারক গালিব, “তবে বোর্ডের সহায়তায় অর্থপাচার হয়েছে— এটা নজিরবিহীন। দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছে।”
এরপর আবুল বারকাতের জামিন নামঞ্জুর করেন তিনি। একইসঙ্গে এ মামলায় আবুল বারকাতকে তিন দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদনের শুনানির জন্য মামলাটি সিএমএম আদালতে পাঠানোর আদেশ দেন। পরে আসামিকে আদালত থেকে হাজতখানায় নেয়া হয়।
মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ শাহজাহান মিরাজ গত ১১ জুলাই আসামির তিন দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন। ওইদিন তাকে কারাগারে পাঠিয়ে রিমান্ড শুনানির জন্য আজ বুধবার দিন ধার্য করেন আদালত।
দুই দিনের রিমান্ড
২৯৭ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দুদকের করা মামলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও জনতা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ডা. আবুল বারকাতের দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।
বুধবার (২৩ জুলাই) বিকেলে শুনানি শেষে ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাকির হোসাইনের আদালত এ আদেশ দেন।
মামলার পটভূমি ও আসামির তালিকা
জালিয়াতির মাধ্যমে জনতা ব্যাংক থেকে অ্যাননটেক্স গ্রুপের নামে ২৯৭ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাতের অভিযোগে গত ২০ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান, আবুল বারকাতসহ ২৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন দুদকের উপপরিচালক নাজমুল হুসাইন।
মামলার বিবরণ অনুযায়ী, অ্যাননটেক্স গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান মেসার্স সুপ্রভ স্পিনিং লিমিটেড ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন সময় জনতা ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়। তবে মূলত বড় অঙ্কের বিতরণ ঘটে ২০১৩-১৪ সময়কালে, যখন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি আবুল বারকাত জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক আবুল বারকাত প্রথম ওই দায়িত্ব পান ২০০৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর। দ্বিতীয় মেয়াদে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিনি ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ছিলেন।
এক সময় ভালো ব্যাংকের কাতারে থাকা জনতা ব্যাংক বারাকাতের অধীনে আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে বলে অভিযোগ রয়েছে।
মামলার অন্য আসামিদের মধ্যে আছেন- জনতা ব্যাংকের সাবেক পরিচালক জামাল উদ্দিন আহমেদ, মেসার্স সুপ্রভ স্পিনিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আনোয়ার হোসেন ও পরিচালক মো. আবু তালহা; জনতা ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক ও মহাব্যবস্থাপক (পরবর্তীতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও) আব্দুছ ছালাম আজাদ, সাবেক উপমহাব্যবস্থাপক আজমুল হক, সাবেক সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) অজয় কুমার ঘোষ, সাবেক ব্যবস্থাপক (শিল্প ঋণ-১) মো. গোলাম আজম, এসএমই বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শাহজাহান, এসইও মো. এমদাদুল হক, সাবেক উপমহাব্যবস্থাপক মো. আব্দুল জব্বার, সাবেক মহাব্যবস্থাপক ও সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) মো. গোলাম ফারুক, সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ওমর ফারুক, এফসিএ মো. ইমদাদুল হক, নাগিবুল ইসলাম দীপু, আর এম দেবনাথ, মো. আবু নাসের, মিসেস সঙ্গীতা আহমেদ, নিতাই চন্দ্র নাথ।
এছাড়া আসামির তালিকায় আছেন অ্যাননটেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ইউনুছ বাদল এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক সহকারী পরিচালক মোছাম্মৎ ইসমত আরা বেগম, সাবেক ডেপুটি গভর্নর-২ আবু হেনা মোহাম্মদ রাজী হাসান।