‘সহকারী জজ’ ও ‘সিনিয়র সহকারী জজ’ পদবির নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব বিচারকদের

বিচারের স্বাধীনতা ও সচিবালয়ের দাবিতে বিচারকদের জোরালো অবস্থান

বিচার বিভাগীয় বাজেট সংকট, নিয়োগে বৈষম্য ও নির্বাহী হস্তক্ষেপ নিয়ে গভীর উদ্বেগ

বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএসএ) পক্ষ থেকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, বিচারকদের পদোন্নতি ও নিয়োগে বৈষম্য, বাজেট সংকট এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ নিয়ে তীব্র উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। তাঁদের দাবি, নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণরূপে পৃথক করতে হবে এবং সুপ্রিম কোর্টের অধীনে একটি স্বাধীন বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

আজ শনিবার (২৬ জুলাই) সকাল ৯টায় ময়মনসিংহ নগরীর সিলভার ক্যাসেল রিসোর্টে ‘জুলাই বিপ্লবের অঙ্গীকার ও পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয়’ শীর্ষক এক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়নের আয়োজনে এই সভায় ময়মনসিংহ বিভাগের চারটি জেলা এবং কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল ও গাজীপুর জেলার বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তারা অংশগ্রহণ করেন।

সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ময়মনসিংহ জেলার সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মো. জাকির হোসেন। সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল খুলনার বিচারক মো. আমিরুল ইসলাম।

সভার শুরুতে বিচারকরা শ্রদ্ধার সঙ্গে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহীদ ও আহতদের স্মরণ করেন। বক্তারা তাঁদের আত্মত্যাগকে গণতন্ত্র ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় এক নতুন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের প্রতীক হিসেবে উল্লেখ করেন।

বক্তারা বলেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় অপরিহার্য হলেও এখনো বিচার বিভাগ বহুলাংশে নির্বাহী বিভাগের ওপর নির্ভরশীল। তারা অভিযোগ করেন, বিচারকদের পদোন্নতি, পদ-সৃজন, বদলি এবং আদালতের অবকাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষমতা নির্বাহী বিভাগের হাতে থাকায় বিচারপ্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে এবং সময়ক্ষেপণ হচ্ছে।

বিচারকরা জ্যেষ্ঠতা, মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে জেলা আদালত থেকে সমতা বজায় রেখে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের দাবি জানান। তাঁরা আরও বলেন, বর্তমানে এই প্রক্রিয়ায় বৈষম্য রয়ে গেছে, যা বিচার বিভাগের পেশাদারিত্বে আঘাত করছে।

আরও পড়ুন: প্রস্তাবিত ফৌজদারি কার্যবিধি কার্যকর হলে গ্রেপ্তার-আটকে হয়রানি কমবে : আইন উপদেষ্টা

সভায় বিচারকরা বিচার বিভাগের বাজেট সংকট ও ২০০৯ সালের পে-স্কেল স্থবির হয়ে থাকার সমালোচনা করেন। তাঁরা দাবি করেন, বিচারকদের মর্যাদা ও আর্থিক প্রণোদনা তাঁদের সাংবিধানিক গুরুদায়িত্বের সমতুল্য হওয়া উচিত। এজন্য একটি পৃথক ও স্বাধীন পে-কমিশন গঠনের দাবি তোলেন।

বিচারকরা উল্লেখ করেন, ১৯৯৫ সালের ঐতিহাসিক মাসদার হোসেন মামলায় বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট, যা আপিল বিভাগ ১৯৯৯ সালে বহাল রাখেন। ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর বিচার বিভাগকে পৃথক ঘোষণা করা হলেও, রায়ের ১২ দফার মধ্যে মাত্র একটি বাস্তবায়িত হয়েছে। বিচার বিভাগের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, পৃথক সচিবালয় এবং বিচারকদের শৃঙ্খলা-সংক্রান্ত বিষয় এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।

বক্তারা বলেন, সংবিধানের ১০৯ ও ১১৬(ক) অনুচ্ছেদ অধস্তন আদালতের ওপর হাইকোর্টের তত্ত্বাবধান নিশ্চিত করলেও, ১১৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রপতির হাতে রয়েছে, যা এখনো কার্যত নির্বাহী বিভাগের পরামর্শে পরিচালিত হচ্ছে। এই অনুচ্ছেদ পরিবর্তন করে ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের হাতে ন্যস্ত করার আহ্বান জানান তাঁরা।

বিচারকরা আরও বলেন, বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হলে সুপ্রিম কোর্টের অধীনে একটি পৃথক সচিবালয় গঠনের বিকল্প নেই। ২০২৪ সালের ২১ সেপ্টেম্বর অধস্তন আদালতের বিচারকদের উদ্দেশ্যে দেওয়া অভিভাষণে যে ঐতিহাসিক রোডম্যাপ উপস্থাপন করা হয়েছিল, তা বাস্তবায়নে দ্রুত পদক্ষেপ প্রয়োজন।

সভায় জানানো হয়, ‘সুপ্রিম কোর্ট বিচারক নিয়োগ অধ্যাদেশ, ২০২৫’ ইতোমধ্যে প্রণীত হয়েছে এবং প্রধান বিচারপতি নির্বাচন কমিশন সচিবালয় ও জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের মতো একটি স্বতন্ত্র বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব আইন মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করেছেন। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এ বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে।