ফৌজদারি কার্যবিধি
ফৌজদারি কার্যবিধি

ফৌজদারি কার্যবিধিতে গ্রেপ্তার, তদন্ত, জামিন ও বিচার প্রক্রিয়ায় যুগান্তকারী সংশোধনী

বাংলাদেশের ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮–এ বড় ধরনের সংশোধন এনেছে অন্তর্বর্তী সরকার। ডিজিটাল মাধ্যমে অর্থাৎ মোবাইল ফোন কল ও খুদেবার্তায় (এসএমএস) সমন জারি, মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা রোধে আবশ্যিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা, এবং বিচারপ্রার্থী ও আসামিদের সুরক্ষায় নতুন ধারা যুক্ত করা হয়েছে। রোববার (১০ আগস্ট) আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগ ‘ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ অধিকতর সংশোধনকল্পে প্রণীত অধ্যাদেশ’–এর গেজেট প্রকাশ করে।

সংশোধিত বিধানগুলোতে গ্রেপ্তার, তদন্ত, জামিন, বিচারসহ পুরো প্রক্রিয়ায় বেশকিছু মৌলিক পরিবর্তন আনা হয়েছে। বিচারপ্রার্থী ও আসামিদের সুরক্ষায় নতুন ধারা যুক্ত করা হয়েছে। পরিবর্তন এসেছে ম্যাজিস্ট্রেটদের ক্ষমতা, পুলিশের রিমান্ডে নেওয়া, অন্য মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো, মামলার হাজিরা ও সাক্ষীর নিরাপত্তার ব্যবস্থাতেও। এ ছাড়া যেকোনো স্থানে সংক্ষিপ্ত বিচার আদালত পরিচালনার বিধানও রাখা হয়েছে।

গ্রেপ্তার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও বাধ্যতামূলক নিয়ম

  • গ্রেপ্তারকারী কর্মকর্তাকে নিজের পরিচয় জানাতে হবে এবং চাইলে পরিচয়পত্র দেখাতে হবে।

  • গ্রেপ্তারকারীর নাম স্পষ্টভাবে দেখা যায়—এভাবে ধারণ করতে হবে।

  • গ্রেপ্তারের সময় উপস্থিত ব্যক্তিদের পরিচয় জানাতে হবে।

  • বাসার বাইরে থেকে কাউকে গ্রেপ্তার করলে ১২ ঘণ্টার মধ্যে পরিবারের সদস্য/আত্মীয়/মনোনীত বন্ধুকে সময়, স্থান ও কোথায় রাখা হয়েছে—তা জানাতে হবে।

  • গ্রেপ্তারের কারণ লিখিতভাবে নথিবদ্ধ করতে হবে।

  • সংশ্লিষ্ট থানায় জেনারেল ডায়েরি (জিডি)-তে সঙ্গে সঙ্গে রেকর্ড করতে হবে।

  • থানার বাইরে থেকে গ্রেপ্তার হলে মেমোরেন্ডামের কপি স্থানীয় থানার ওসিকে দিতে হবে।

  • প্রতিটি থানায় ও জেলা/মহানগর সদর দপ্তরে গ্রেপ্তারকৃতদের নাম, ঠিকানা, অপরাধের ধরণ দৃশ্যমানভাবে (সর্বোত্তম হলে ডিজিটাল মাধ্যমে) প্রদর্শন করতে হবে।

  • জব্দ তালিকার কপি গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির পরিবারের কাছে দিতে হবে।

পরোয়ানা ছাড়া গ্রেপ্তারের শর্ত কঠোর

  • আমলযোগ্য অপরাধে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করতে হলে পুলিশকে প্রমাণ দেখাতে হবে যে ব্যক্তি পুলিশের সামনেই অপরাধ করেছেন।

  • যদি মামলা তদন্তাধীন থাকে, তাহলে যুক্তিসঙ্গত সন্দেহের কারণ থাকতে হবে।

  • ৫৪ ধারা শুধুমাত্র প্রতিরোধমূলক আটক হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না।

  • বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে কারণ জানানো বাধ্যতামূলক।

হেফাজত ও রিমান্ডে সময়সীমা

  • ম্যাজিস্ট্রেট সর্বোচ্চ ১৫ দিনের হেফাজতের অনুমতি দিতে পারবেন।

  • এর বেশি সময় কেবল বিচারিক হেফাজত দেওয়া যাবে।

  • হেফাজতের মেয়াদ শেষ হলে দ্রুত ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করতে হবে।

  • নির্যাতনের অভিযোগ পেলে সরকারি হাসপাতালে মেডিকেল পরীক্ষা বাধ্যতামূলক।

  • প্রমাণ পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

অন্য মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর নতুন শর্ত

  • ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করা।

  • মামলার ডায়েরির কপি প্রদান।

  • বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ।

  • আবেদন যথাযথ হতে হবে।

  • বেআইনি আটকের প্রমাণ পেলে কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তদন্ত প্রক্রিয়ায় সময়সীমা ও জবাবদিহি

  • অপরাধের তথ্য পাওয়ার ৬০ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে হবে।

  • সময়মতো শেষ না হলে কারণ লিখে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে সময় বাড়ানোর আবেদন করতে হবে।

  • বিলম্বের জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হবে।

  • অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে প্রমাণের অভাব থাকলে আসামিকে অব্যাহতি দেওয়া যেতে পারে।

  • নতুন প্রমাণ পেলে পূর্বে অব্যাহতি পাওয়া আসামিকে পুনরায় অভিযুক্ত করা যাবে।

নালিশি সিআর মামলার খারিজের নিয়ম

  • এখন থেকে বাদীর অনুপস্থিতির কারণে সব সিআর মামলা খারিজ হবে (আগে শুধু সমন দেওয়া মামলাগুলো খারিজ করা যেত)।

মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা রোধে বাধ্যতামূলক শাস্তি

  • আগে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা বিচারকের ইচ্ছাধীন ছিল, এখন তা বাধ্যতামূলক।

স্যামারি ট্রায়ালে পরিবর্তন

  • চুরি, আত্মসাৎ ইত্যাদি অপরাধের আর্থিক সীমা ১০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫ লাখ টাকা করা হয়েছে।

  • এক বৈঠকে চার্জ গঠন থেকে রায় পর্যন্ত কার্যক্রম সম্পন্ন করা যাবে।

  • যেকোনো স্থানে সংক্ষিপ্ত বিচার আদালত পরিচালনা সম্ভব।

  • ম্যাজিস্ট্রেটরা মোবাইল কোর্টের বিকল্প হিসেবে ভ্রাম্যমাণ স্যামারি ট্রায়াল করতে পারবেন।

পলাতক আসামির বিচার দ্রুততর

  • ক্রোকি ও হুলিয়া পরোয়ানার আবশ্যকতা থাকবে না।

  • বিজ্ঞপ্তি বহুল প্রচলিত একটি বাংলা পত্রিকা ও ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে (আগে দুই পত্রিকা লাগত)।

বেআইনি সমাবেশের মামলা এখন আপসযোগ্য

  • ধারা ১৪৩ আপসযোগ্য করা হয়েছে।

  • আদালত বা জেলা লিগ্যাল এইড অফিসে আপস প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা যাবে।

  • আপস চুক্তি আদালত নথিভুক্ত ও বাস্তবায়ন করবে।

বেত্রাঘাত শাস্তির বিলোপ

  • ধারা ৩৯৬ সংশোধনের মাধ্যমে বেত্রাঘাতের শাস্তি বাতিল করা হয়েছে।

ব্যক্তিগত হাজিরা শিথিল ও সাক্ষ্যগ্রহণের নতুন বিধান

  • জামিনপ্রাপ্ত আসামি তদন্ত প্রতিবেদন শুনানি পর্যন্ত ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে অব্যাহতি পেতে পারেন।

  • আসামি অনুপস্থিত থাকলেও আইনজীবী সাক্ষীকে জেরা করতে পারবেন।

সাক্ষী সুরক্ষা ও খরচ প্রদান

  • আদালত সাক্ষী ও ভুক্তভোগীর সুরক্ষায় প্রয়োজনীয় আদেশ দিতে পারবে।

  • সরকারি আদেশ দিয়েই সাক্ষীর খরচ প্রদান সম্ভব হবে।

গুরুতর আঘাতের মামলায় জামিন অযোগ্যতা

  • ধারা ৩২৫ এখন জামিন–অযোগ্য।

  • গুরুতর জখমের ক্ষেত্রে অস্ত্রের ধরন বিবেচনা করা হবে না।

বিশেষজ্ঞ মতামত

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আগে সাক্ষীর খরচ প্রদানের বিধান থাকলেও তা কার্যকর করতে পৃথক বিধি প্রণয়ন বাধ্যতামূলক ছিল। এখন থেকে সরকারি আদেশ দিয়েই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।

বিচারব্যবস্থা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আগে বিশেষ কিছু আইনে সাক্ষী সুরক্ষার বিধান থাকলেও ফৌজদারি কার্যবিধিতে এমন কোনো ব্যবস্থা ছিল না। নতুন সংশোধনীতে আদালতকে সাক্ষী ও ভুক্তভোগীর সুরক্ষায় যেকোনো প্রয়োজনীয় আদেশ দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।

আইনজীবীরা বলছেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ৩২৫ আগে জামিনযোগ্য ছিল। ভোতা অস্ত্রে হাত-পা ভাঙা বা চোখ-কান হারানোর মতো গুরুতর আঘাতের ক্ষেত্রেও আসামি সহজেই জামিন পেত। প্রাথমিকভাবে ৩২৬ ধারায় মামলা হলে জামিন পাওয়া কঠিন হতো, কিন্তু পরে অস্ত্রের প্রমাণ না পাওয়া গেলে আসামি সুবিধা পেত। নতুন সংশোধনীতে ধারা ৩২৫-কে জামিন–অযোগ্য করা হয়েছে। ফলে গুরুতর জখমের ক্ষেত্রে কী অস্ত্র ব্যবহার হয়েছিল, জামিনের ক্ষেত্রে আর তা বিবেচ্য হবে না।

সংশোধনীগুলোর বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, ফৌজদারি আইনের যে সংশোধনগুলো আনা হয়েছে, তাতে মনে হয়েছে উদ্দেশ্য ভালো। তবে কিছু ক্ষেত্রে এগুলো প্রশাসনিক জটিলতা তৈরি করতে পারে। এ জন্য সবচেয়ে বেশি দরকার সদিচ্ছা। এটি না থাকলে আইন সংশোধনের প্রকৃত উদ্দেশ্য ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।