তথ্য গোপন করে বৈধ বিয়ে—ধর্মীয়, আইনগত ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে স্বামীর প্রতিকার
আল মুস্তাসিম নবী নিকু

হেবা: ইসলাম ও প্রচলিত আইনের আলোকে একটি বিশ্লেষণ

আল মুস্তাসিম নবী নিকু : বাংলাদেশের আইনব্যবস্থায় “হেবা” একটি গুরুত্বপূর্ণ দানমূলক লেনদেন, যা মূলত ইসলামি শরিয়ত এবং পরবর্তীকালে প্রণীত দেওয়ানি আইন দ্বারা স্বীকৃত ও নিয়ন্ত্রিত। হেবা বলতে বোঝায় স্বেচ্ছায় ও নিঃশর্তভাবে কারও নিকট সম্পত্তি বা মালিকানা হস্তান্তর করা, বিনিময়ে কোনো প্রকার আর্থিক প্রতিদান বা সুবিধা গ্রহণ না করে। এটি এক প্রকার দান হলেও এর আইনি অবস্থান এবং কার্যকারিতা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে নির্ধারিত। নিচে হেবার আইনি অবস্থান, প্রযোজ্য আইন, পক্ষসমূহ এবং কার্যকর করার শর্তাবলী আলোচনা করা হলো।

হেবার সংজ্ঞা ও মূল ভিত্তি

হেবা মূলত ইসলামি শরীয়তের ভিত্তিতে স্বীকৃত একটি চুক্তি। ইসলামি আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি জীবদ্দশায় নিজের মালিকানাধীন সম্পত্তি নিঃস্বার্থভাবে অন্যের নিকট হস্তান্তর করলে তা হেবা হিসেবে গণ্য হয়।

তবে বাংলাদেশে হেবার বিষয়টি শুধু শরীয়তে সীমাবদ্ধ নয়; বরং Transfer of Property Act, 1882 (হস্তান্তর আইন, ১৮৮২), Registration Act, 1908 (রেজিস্ট্রেশন আইন, ১৯০৮) আইনের ধারাসমূহের মাধ্যমেও এর আইনগত কাঠামো ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

হেবা কী?

মুসলিম আইনে হেবা একটি বিশেষ চুক্তি, যার মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি স্বেচ্ছায়, কোনো প্রকার বিনিময় বা প্রতিদান ছাড়া, নিজের সম্পত্তি অন্য ব্যক্তিকে হস্তান্তর করে। এটি মূলত একটি দান বা উপহার, যা স্থাবর (যেমন জমি, বাড়ি) এবং অস্থাবর (যেমন টাকা, গহনা) – উভয় প্রকার সম্পত্তির ক্ষেত্রেই করা যায়।

হেবার বৈশিষ্ট্য

  • এটি সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় এবং কোনো প্রকার জবরদস্তি বা প্রতারণা ছাড়া হতে হবে।কোনো প্রকার প্রতিদান বা বিনিময় ছাড়া সম্পত্তি দান করা হয়।
  • দাতা (যিনি হেবা দেন) অবশ্যই হেবা দেওয়ার বৈধ মালিক হতে হবে।দাতা অবশ্যই প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন এবং হেবা দেওয়ার মতো বৈধ মালিক হতে হবে।
  • গ্রহীতা (যিনি হেবা পান) অবশ্যই হেবা গ্রহণ করবেন—গ্রহণ না করলে হেবা কার্যকর হবে না।গ্রহীতা জীবিত ব্যক্তি হতে হবে। নবজাতক বা অক্ষম ব্যক্তির পক্ষেও বৈধ অভিভাবক হেবা গ্রহণ করতে পারেন।
  • হেবা কোনো শর্তসাপেক্ষ হলে, সেই শর্ত ইসলামে বৈধ হতে হবে।
  • হেবা কার্যকর হওয়ার পর সাধারণত তা ফেরত নেওয়া যায় না। একবার বৈধভাবে হেবা সম্পন্ন হলে সাধারণত তা দাতা ফেরত নিতে পারেন না। তবে ইসলামী ফিকহে কিছু ব্যতিক্রম আছে (যেমন – পিতা যদি সন্তানকে বা স্বামী স্ত্রীকে হেবা দেন, কিছু মত অনুযায়ী তা ফিরিয়ে নিতে পারেন)।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে হেবা মূলত মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশে কোনো মুসলমান তার জীবদ্দশায় হেবা করে যে কোনো সম্পত্তি সন্তান, স্ত্রী বা অন্য কাউকে দিতে পারেন। এটি লিখিত দলিল (হেবা দলিল) আকারে রেজিস্ট্রেশন করে দেওয়া হলে আইনি স্বীকৃতি পায়।

উদাহরণ সরূপ বলতে পারি যদি একজন বাবা জীবিত অবস্থায় তার ছেলেকে একটি জমি দিয়ে দেন এবং সেই ছেলে জমিটি গ্রহণ করে দখলে নেয়, তবে এটি হেবা।

হেবার প্রকারভেদ

মুসলিম আইনবিদরা হেবাকে কয়েক ভাগে ভাগ করেছেন:

  • হেবা-বিল-ইওয়াজ (Hiba-bil-Iwaz): এটি এমন হেবা যেখানে দাতা বিনা শর্তে সম্পত্তি দিলেও, গ্রহীতা পরে কৃতজ্ঞতাস্বরূপ কিছু প্রতিদান দেয়। একে কার্যত উপহার-প্রতিউপহার ধরণের চুক্তি বলা যায়।
  • হেবা-বিল-শর্তুল-ইওয়াজ (Hiba-bil-Shart-ul-Iwaz): যেখানে দাতা হেবা দেওয়ার সময় শর্ত রাখেন যে গ্রহীতা প্রতিদান দেবেন।
  • সরল হেবা (Simple Hiba): যেখানে কোনো শর্ত নেই, নিঃস্বার্থভাবে সম্পত্তি দেওয়া হয়।

হেবা সংক্রান্ত প্রযোজ্য আইনসমূহ

১. সম্পত্তি হস্তান্তর আইন, ১৮৮২ (Transfer of Property Act, 1882):

এই আইনে সম্পত্তি হস্তান্তরের বিভিন্ন রূপ যেমন বিক্রয়, বিনিময়, লিজ, দান প্রভৃতি নির্ধারণ করা হয়েছে। যদিও “হেবা” শব্দটি সরাসরি ব্যবহৃত হয়নি, তবে ধারা ১২২–এ দান (Gift) সংজ্ঞায়িত হয়েছে, যা ইসলামী আইনের হেবার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

সেখানে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি স্বেচ্ছায় ও নিঃশর্তভাবে তার মালিকানাধীন সম্পত্তি অপরকে প্রদান করলে তা “Gift” বা দান হিসেবে গণ্য হবে।অর্থাৎ হেবা মূলত দানেরই এক বিশেষ রূপ, তবে এর বিশেষ বিধান ইসলামী শরীয়তে নির্ধারিত।

সম্পত্তি হস্তান্তর আইন ১৮৮২-এর ধারা ১২২-১২৯ এ হেবার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

  • ধারা ১২২:“Gift is the transfer of certain existing moveable or immoveable property made voluntarily and without consideration, by one person, called the donor, to another, called the donee, and accepted by or on behalf of the donee.” অর্থাৎ হেবা হলো বিদ্যমান সম্পত্তির স্বেচ্ছায়, বিনা মূল্যে হস্তান্তর। এখানে গ্রহীতা কে হবে, সে বিষয়ে কোনো সীমাবদ্ধতা নেই।
  • ধারা ১২৩:স্থাবর সম্পত্তি (জমি-বাড়ি) হেবা করতে হলে নিবন্ধিত দলিল (Registered Gift Deed) প্রয়োজন।

২. রেজিস্ট্রেশন আইন, ১৯০৮ (Registration Act, 1908):

এই আইনেরধারা ১৭ (১)(এ) অনুসারে, স্থাবর সম্পত্তির (immovable property) দান বা হস্তান্তর বৈধ হতে হলে তা লিখিত আকারে করতে হবে এবং রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক।

তবে ইসলামী আইনের বিশেষ বিধান অনুসারে হেবার ক্ষেত্রে মৌখিক ঘোষণার মাধ্যমে সম্পাদিত হস্তান্তর বৈধ বলে গণ্য হয়, যদি হেবার শর্তাবলি পূরণ হয়।

এর অর্থ হলো, হেবা মৌখিকভাবে কার্যকর হলেও নিরাপত্তা ও প্রমাণের স্বার্থে রেজিস্ট্রেশন করলে তা অধিক সুরক্ষিত হয়।

ধারা ৭৮এ (বি) অনুযায়ী মুসলিম ব্যক্তিগত আইন (শরিয়ত) এর অধীনে যেকোনো স্থাবর সম্পত্তিরহেবা ঘোষণার জন্য প্রদেয় নিবন্ধন ফি সম্পত্তির মূল্য নির্বিশেষে একশ টাকা হবে, তবে সেটা শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কিছু আত্মীয়তার সম্পর্কের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ। সেই সম্পর্কগুলো হলো—

  • পিতা/মাতা ↔ সন্তান
  • দাদা-দাদী/নানা-নানী ↔ নাতি-নাতনী
  • সহোদর ভাই-বোন
  • স্বামী ↔ স্ত্রী

৩. মুহাম্মদান ল’ (Islamic Law):

ইসলামী শরীয়তের আলোকে হেবা একটি পূর্ণাঙ্গ চুক্তি। এখানে তিনটি শর্ত অপরিহার্যভাবে পূরণ করতে হয়:

  • দানকারীর পক্ষ থেকে স্পষ্ট ঘোষণা (Ijab)
  • গ্রহীতার পক্ষ থেকে গ্রহণ (Qabul)
  • হস্তান্তরকৃত সম্পত্তির দখল (Delivery of possession)

অন্য ধর্মাবলম্বীগণের ক্ষেত্রে হেবা/দান সম্পর্কিত আইনগত অবস্থান

একজন মুসলমান কেবল আরেকজন মুসলমানকেই শরীয়তসম্মত হেবা করতে পারবেন।তবে, অমুসলিমদের ক্ষেত্রে ইসলামী শরীয়তের হেবা প্রযোজ্য নয়। তাদের জন্য সম্পত্তি হস্তান্তরের মাধ্যম হলো দান (Gift)

এজন্য বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী, অমুসলিমরা চাইলে রেজিস্ট্রেশন আইন, ১৯০৮ এর ধারা ৭৮এ (বিবি) অনুসারে দানের ঘোষণা দলিল (Gift Deed) এর মাধ্যমে কেবলমাত্র আইন দ্বারা অনুমোদিত সম্পর্কের মধ্যে নির্ধারিত নিবন্ধন ফি প্রদানে সম্পত্তি হস্তান্তর করতে পারবেন।

অর্থাৎ, ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রে হেবা শব্দটি প্রযোজ্য নয়, বরং কেবল দান (Gift) বৈধ।

দানপত্র দলিল” বলতে সাধারণত সেই লিখিত দলিলকে বোঝানো হয়, যার মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি স্বেচ্ছায়, বিনিময় বা প্রতিদান ছাড়া তার সম্পত্তি অন্য ব্যক্তিকে প্রদান করার প্রতিশ্রুতি বা ঘোষণা করে। এটি মূলত Gift Deed বা Hiba Deed–এর সমতুল্য।

কারা হেবা করতে পারে ও কারা পাবে

১. কে হেবা দিতে পারে (দাতা /Donor)?

হেবা বৈধভাবে দিতে হলে দাতার মধ্যে কিছু যোগ্যতা থাকতে হবে—

  • প্রাপ্তবয়স্ক হতে হবে – নাবালক (অপ্রাপ্তবয়স্ক) ব্যক্তি বৈধভাবে হেবা দিতে পারে না।
  • সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন হতে হবে – মানসিকভাবে অক্ষম বা পাগল ব্যক্তি হেবা দিতে পারবে না।
  • সম্পত্তির বৈধ মালিক হতে হবে – দাতা তার নিজস্ব মালিকানাধীন সম্পত্তিই কেবল হেবা দিতে পারবেন।
  • স্বেচ্ছায় হতে হবে – জবরদস্তি, চাপ, প্রতারণা বা হুমকি দিয়ে দেওয়া হেবা বৈধ নয়।

অর্থাৎ, একজন মুসলিম, প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন ব্যক্তি তার মালিকানাধীন সম্পত্তি জীবিত অবস্থায় হেবা দিতে পারেন।

২. কে হেবা গ্রহণ করতে পারে (গ্রহীতা/Donee)?

  • জীবিত ব্যক্তিহতে পারে।
  • শিশু বা নাবালক – নাবালকের পক্ষ থেকে তার বৈধ অভিভাবক হেবা গ্রহণ করতে পারেন।
  • অক্ষম ব্যক্তি – মানসিক বা শারীরিক অক্ষম হলেও তার বৈধ অভিভাবক হেবা গ্রহণ করতে পারবেন।
  • স্ত্রী বা স্বামী – স্বামী স্ত্রীর কাছে বা স্ত্রী স্বামীর কাছে হেবা দিতে পারেন।

৩. কাকে হেবা দেওয়া যায় না?

  • মৃত ব্যক্তিকে হেবা দেওয়া যায় না (কারণ গ্রহণ ও দখল হস্তান্তরের শর্ত পূর্ণ হয় না)।
  • অদৃশ্য বা অনিশ্চিত বস্তু (যেমন ভবিষ্যতে জন্ম নেবে এমন পশু) হেবা দেওয়া যায় না।
  • এমন সম্পত্তি যা দাতার মালিকানায় নেই (যেমন অন্যের জমি) – হেবা দেওয়া যাবে না।

বাংলাদেশে হেবা দলিলের আইনগত শর্তাবলী

বাংলাদেশে হেবা কার্যকর করার জন্য শুধুমাত্র মৌখিক ঘোষণা যথেষ্ট নয়; আইন অনুযায়ী রেজিস্ট্রেশন প্রয়োজন। হেবা দলিলে কিছু শর্ত পালন করা প্রয়োজন। যেমন:

১. লিখিত দলিল (Written Deed) –

  • Registration Act, 1908 অনুযায়ী, স্থাবর সম্পত্তি হেবা করতে হলে লিখিত দলিল করতে হয়।

২. রেজিস্ট্রেশন (Registration) –

মুসলিম আইন অনুযায়ী লিখিত বা রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক নয়। মৌখিকভাবেও বৈধ, যদি দখল হস্তান্তর সম্পন্ন হয়।

তবে বাংলাদেশে Transfer of Property Act, 1882, Section123 এবং Registration Act, 1908, Section17 অনুসারে স্থাবর সম্পত্তির হেবা রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক

৩. স্ট্যাম্প ও সাক্ষর (Stamp & Attestation) –

  • দলিলে যথাযথ স্ট্যাম্প দিতে হবে।
  • কমপক্ষে দুইজন সাক্ষীর সাক্ষর থাকতে হবে।

৪. দখল হস্তান্তরের প্রমাণ (Proof of Possession) –

  • দলিলের পর বাস্তবে দখল হস্তান্তর করতে হবে। আদালতে হেবা বৈধ প্রমাণ করতে দখল হস্তান্তর একটি প্রধান উপাদান।

হেবা বাতিলের নিয়ম

হেবা একবার সম্পূর্ণ কার্যকর হলে সাধারণত তা বাতিল করা যায় না। তবে ইসলামী শরীয়তে দাতা তার সন্তানকে দেওয়া হেবা কিছু ক্ষেত্রে প্রত্যাহার করতে পারেন।

এছাড়া প্রতারণা, জালিয়াতি বা জবরদস্তির মাধ্যমে হেবা সংঘটিত হলে তা দেওয়ানি আদালতে বাতিল ঘোষণা করা যেতে পারে। কিছু অবৈধ হেবার উদাহরণ-

১. অনাগত শিশুকে দান (Unborn child)।

২. ভবিষ্যতের জন্য দান (Future gift)।

৩. দুই বা একাধিক গ্রহীতাকে অবিভাজিত সম্পত্তি দান (যদি ভাগ না করা হয়)।

৪. দাতার বেদখলি সম্পত্তির হেবা।

৫. প্রতারণামূলক হেবা (creditor-দের বঞ্চিত করতে)।

৬. উত্তরাধিকারী মনোনয়নের ক্ষমতা প্রদান।

৭. অনিশ্চিত শর্তযুক্ত হেবা।

পরিশেষে হেবা মূলত ইসলামি শরীয়তের ভিত্তিতে স্বীকৃত একটি দানপ্রথা হলেও বাংলাদেশে এর আইনগত স্বীকৃতি দেওয়ানি ও হস্তান্তর আইন দ্বারা আরও সুস্পষ্ট করা হয়েছে। হেবা কার্যকর হওয়ার জন্য দাতার ঘোষণা, গ্রহীতার গ্রহণ এবং দখল হস্তান্তর—এই তিনটি শর্ত অপরিহার্য।

তবে বর্তমান আইন অনুযায়ী নিরাপত্তা ও ভবিষ্যতে বিরোধ এড়ানোর জন্য লিখিত দলিল ও রেজিস্ট্রেশন করাই উত্তম। হেবা অনেক সময় উত্তরাধিকার বঞ্চনার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হলেও, আইনগত কাঠামোতে এটি এখনো একটি স্বীকৃত ও বৈধ সম্পত্তি হস্তান্তরের পদ্ধতি।

লেখক : অ্যাডভোকেট, ঢাকা ও পাবনা জজ কোর্ট।