বিচারপতি এস কে সিনহা
বিচারপতি এস কে সিনহা

পদত্যাগের পরের প্রশ্ন

বাংলাদেশের ২২তম প্রধান বিচারপতি কে হচ্ছেন? অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি কি নবনিযুক্ত বিচারকদের শপথ পাঠ করাতে পারেন? বিদায়ী প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা সংবিধানের কোন অনুচ্ছেদের আওতায় পদত্যাগ করেছেন, সেটাও একটা প্রশ্ন। এর উত্তর কখন মিলবে, সে বিষয়ে কেউ এখনো নির্দিষ্ট দিনক্ষণ উল্লেখ করেননি।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বিদায়ী প্রধান বিচারপতির ছুটি নেয়া এবং পরে বিদেশে চলে যাওয়ার ঘটনায় পরবর্তী প্রধান বিচারপতি সম্পর্কে হোমওয়ার্ক করে রাখাটাই স্বাভাবিক প্রত্যাশা ছিল। যেকোনো বিচারে দেশের পরবর্তী প্রধান বিচারপতির বিষয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হওয়ার কথা ছিল। প্রধান বিচারপতি নিয়োগে কোনো নীতিমালা নেই। এমনকি প্রধানমন্ত্রী ব্যতীত এই একটি মাত্র নিয়োগ যেখানে সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নিতে হবে না।

উল্লেখ্য যে, সরকারি প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী ১০ই নভেম্বর ২০১৭ প্রধান বিচারপতির ছুটি শেষ হওয়া এবং তাঁর স্বীয় পদে কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত মেয়াদে বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্‌হাব মিঞাকে রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ৯৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করতে বলেন।

ইতিমধ্যে ১০ই নভেম্বর পার হয়ে গেছে। এবং প্রধান বিচারপতিও পদত্যাগ করেছেন। এই অবস্থায় কখন দেশের ২২তম প্রধান বিচারপতি নিয়োগ পাবেন, সেদিকে সবারই নজর আছে।

জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা স্মরণ করছেন যে, বাংলাদেশের ৪৬ বছরের ইতিহাসে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সাধারণত আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতিকেই প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বর্তমান সরকারের আমলে জ্যেষ্ঠতার নীতি লঙ্ঘনের ঘটনায় এর আগে বিচারপতি শাহ্‌ আবু নাঈম মোমিনুর রহমান আপিল বিভাগ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। প্রধান বিচারপতি পদে বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের অভিষেকের সময় দ্বিতীয়বার পদত্যাগের পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছিল। জ্যেষ্ঠতম বিচারপতি এমএ মতিনকে সুপারসিড করা হয়েছিল। আপিল বিভাগ থেকে অবসরকালে তিনি তাঁর বিদায়ী বক্তৃতায় এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন।

প্রধান বিচারপতি নিয়োগে তিনটি অনুচ্ছেদকে একত্রে বিবেচনায় নিতে হবে। ৯৭ অনুচ্ছেদ বলেছে, প্রধান বিচারপতির পদ শূন্য হইলে কিংবা অনুপস্থিতি, অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে প্রধান বিচারপতি তাঁহার দায়িত্ব পালনে অসমর্থ বলিয়া রাষ্ট্রপতির নিকট সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হইলে ক্ষেত্রমত অন্য কোনো ব্যক্তি অনুরূপ পদে যোগদান না করা পর্যন্ত কিংবা প্রধান বিচারপতি স্বীয় কার্যভার পুনরায় গ্রহণ না করা পর্যন্ত আপিল বিভাগের অন্যান্য বিচারকের মধ্যে যিনি কর্মে প্রবীণতম, তিনি অনুরূপ কার্যভার পালন করিবেন।

এখন বিশেষজ্ঞদের অনেকে বলছেন, সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদের আওতায় একজন পূর্ণাঙ্গ প্রধান বিচারপতির পদ শূন্য হয়ে গেলে ৯৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কারো অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি হওয়ার সুযোগ থাকে না। কারো কারো মতে, সেক্ষেত্রে সংবিধানের অভিপ্রায় হলো কালবিলম্ব না করে অস্থায়ী নয়, আগে একজন স্থায়ী প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দিতে হবে।

একটি বিতর্ক: ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের পরে বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দীন চৌধুরী মানিক তৃতীয় মাত্রার অনুষ্ঠানে দর্শকদের উদ্দেশ্যে রায়ের অপরেটিভ অংশ থেকে পড়ে শুনিয়েছিলেন। সেদিন তিনি দাবি করেছিলেন, ভুলক্রমে সংবিধানের ১৬তম সংশোধনীর আগের ৯৬ অনুচ্ছেদ পুনরুজ্জীবন করতে গিয়ে মূল ৯৬ অনুচ্ছেদের ১ নম্বর এবং ৪ নম্বর উপ-দফা বাদ দিয়েছেন। বিচারপতি মানিক মত দিয়েছিলেন যে, বিচারপতি এস কে সিনহা উদ্দেশ্যেমূলকভাবে বয়স ও পদত্যাগের বিধান রদ করে ফেলেছেন। যাতে তিনি ৬৭ বছর পূর্ণ হওয়ার পরেও প্রধান বিচারপতির পদে থাকতে পারেন। আর তাকে পদত্যাগ করতেও হবে না। করলেও তা কার্যকর হবে না। তাঁর ভাষায় রায়ের এ রকম গুরুতর গলদের জন্য তিনি বিচারপতি সিনহার কঠোর সমালোচনা করেন। ষোড়শ সংশোধনীর পরের ৯৬
অনুচ্ছেদটি নিচে দেওয়া হলো:

“৯৬। (১) এই অনুচ্ছেদের অন্যান্য বিধানাবলী সাপেক্ষে কোনো বিচারক সাতষট্টি বৎসর বয়স পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত স্বীয় পদে বহাল থাকিবেন।
(২) প্রমাণিত অসদাচরণ বা অসামর্থ্যের কারণে সংসদের মোট সদস্য-সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতার দ্বারা সমর্থিত সংসদের প্রস্তাবক্রমে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ ব্যতীত কোনো বিচারককে অপসারিত করা যাইবে না।
(৩) এই অনুচ্ছেদের (২) দফার অধীন প্রস্তাব সম্পর্কিত পদ্ধতি এবং কোনো বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্য সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করিতে পারিবেন।
(৪) কোনো বিচারক রাষ্ট্রপতিকে উদ্দেশ করিয়া স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে স্বীয় পদত্যাগ করিতে পারিবেন।”

উল্লেখ্য যে, গত ১লা আগস্টে প্রকাশিত ষোড়শ সংশোধনীর পূর্ণাঙ্গ রায়ে দেখা যায়, সাত বিচারপতিই ১৬তম সংশোধনীর আগের ৯৬ অনুচ্ছেদের সবক’টি বিধানাবলী পুনরুজ্জীবিত করেছেন। কিন্তু তাতে উক্ত ১ ও ৪ উপ-দফার উল্লেখ নেই।

সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেছেন, পদত্যাগ করার অধিকার সবারই আছে। প্রধান বিচারপতির পদটি শূন্য। তাই সংবিধানের ৯৫(১) অনুচ্ছেদ অনুসারে রাষ্ট্রপতি একক সিদ্ধান্তে প্রধান বিচারপতি পদে আপিল বিভাগের যে কাউকেই নিয়োগ দিতে পারেন। তবে সংবিধান বিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিক মনে করেন, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি আপিল বিভাগের বিবেচনার জন্য এ বিষয়টি পাঠাতে পারেন।

এ বিষয়ে ড. শাহদীন মালিক বলেন, ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়ে সংবিধানে বর্ণিত ৯৬(৮) দফা অর্থাৎ পদত্যাগ করার অধিকার বাতিলের বিষয়টি বড় ভুল হয়েছে। অসাবধানতাবশত হয়েছে বলেই মনে হয়। তবে রাষ্ট্রপতি চাইলে নতুন প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দিতে পারেন। তিনি বলেন, তবে পদত্যাগের বিষয়টি নিয়ে যেহেতু প্রশ্ন উঠেছে, সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি এ বিষয়ে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে আপিল বিভাগের মতামতও চাইতে পারেন। আবার ষোড়শ সংশোধনী মামলায় আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করে তার উপর আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়েও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেয়া সম্ভব বলে মনে করেন এই আইনজ্ঞ।

নিয়োগের বিধান: ৯৫ (১) প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হইবেন এবং প্রধান বিচারপতির সহিত পরামর্শ করিয়া রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারককে নিয়োগদান করিবেন।

৪৮ (৩) দফায় আছে, এই সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদের (৩) দফা অনুসারে কেবল প্রধানমন্ত্রী ও ৯৫ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুসারে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তাঁহার অন্য সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন: তবে শর্ত থাকে যে, প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে আদৌ কোনো পরামর্শদান করিয়াছেন কি না এবং করিয়া থাকিলে কি পরামর্শ দান করিয়াছেন, কোন আদালত সেই সম্পর্কে কোনো প্রশ্নের তদন্ত করিতে পারিবেন না।

প্রধান বিচারপতি অবসরে যাওয়ার আগেই নতুন প্রধান বিচারপতি নিয়োগের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হয়। তবে এবার মেয়াদ শেষ হওয়ার ৮২ দিন আগে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বিদেশে বসে পদত্যাগ করায় সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় বহাল থাকা অবস্থায় প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করে নতুন একজনকে প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগে সময় লাগতে পারে।

নতুন বিচারক নিয়োগ প্রশ্ন: হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগে নতুন বিচারক নিয়োগের প্রয়োজনীয়তা বহুদিন ধরে অনুভূত হচ্ছে। আপিল বিভাগে ১১ জন বিচারক থাকার কথা। কিন্তু বর্তমানে ৫ জন আছেন।

অনেকের মতে প্রধান বিচারপতির পদ শূন্য থাকলে ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি নবনিযুক্ত বিচারকদের শপথ পড়াতে পারবেন না। কারণ অস্থায়ী প্রধান বিচারপতির নিজেরই শপথ নেই। এজন্য হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগে বিচারক নিয়োগ দিতে হলে আগে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের বিষয়টি সুরাহা হওয়া প্রয়োজন। অবশ্য বিপরীত মত দিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়সহ বিভিন্ন ইস্যুতে আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে ২রা অক্টোবর ছুটিতে যান প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। পরে তিনি অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশে ১৩ই অক্টোবর ঢাকা ছাড়েন। যাওয়ার আগে প্রধান বিচারপতি বলেন, তিনি অসুস্থ নন। পরদিন এ ঘটনায় সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন এক বিবৃতিতে জানায়, প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে ১১টি দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। বিচারপতি সিনহা এ বিষয়ে কোনো উত্তর দেননি। গত ১০ই নভেম্বর সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশ হাইকমিশনে পদত্যাগপত্র জমা দেন প্রধান বিচারপতি।

উল্লেখ্য, প্রধান বিচারপতির পদ শূন্য ঘোষণা করে এখনও পর্যন্ত সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়নি।

-মানবজমিন

 

সম্পাদনা ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম