বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টে প্রথমবারের মতো দুজন নারী সহকারী রেজিস্ট্রার কাজ করছেন। দুই বিচারক হলেন- ফারজানা ইয়াসমিন ও মেহনাজ সিদ্দিকী। বিচার বিভাগের ইতিহাসে নতুন রেকর্ডে নাম লেখানো দুই বিচারককে ২০১৫ সালের ২৩ জুলাই প্রেষণে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তাদের দুজনই ময়মনসিংহের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তাদের সঙ্গে কথা বলে তাদের নিয়ে জানাচ্ছেন মোহাম্মদ ওমর ফারুক
ফারজানা ইয়াসমিন
ফারজানা ইয়াসমিন বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টে প্রথমবারের সহকারী রেজিস্ট্রার নিয়োগ পেয়েছেন। তিনি কথায় কথায় বলেন, নারী বিচারক হিসেবে বাংলাদেশ বিচার বিভাগে কোনো প্রতিকূল পরিবেশের সম্মুখীন হইনি।
ঝিনাইদহের মেয়ে ফারজানা ইয়াসমিন। মুক্তিযোদ্ধা বাবার তিন সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় তিনি। ১৯৯৯ সালের কথা, তখন এস.এস.সি পরীক্ষায় ঝিনাইদহ হতে যশোর বোর্ডে সম্মিলিত মেধা তালিকায় ৪র্থ স্থান করে নিজের স্বপ্নের মাত্রাটি দ্বিগুণ করে ফেলেন। তার আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে, ২০০১ সালে এইচ.এস.সি পরীক্ষায় ঝিনাইদহ সিটি কলেজ থেকে ০৭ বোর্ডে সর্বোচ্চ নম্বরসহ যশোর বোর্ডে সম্মিলিত মেধা তালিকায় ১ম স্থানটি নিজের করেন নেন ফারজানা। নিজের স্বপ্নে সঙ্গে মিল রেখে ভর্তি হন দেশের সেরা প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রতিষ্ঠানটি থেকে ২০০৫ সালে এল.এল.বি অনার্স এবং ২০০৬ সালে এলএলএম পাস করেন। পড়াশোনার পাশাপাশি মেধাবী এই নারী নিজের অর্জনের ঝুড়িতে লুফে নেন বেশ কয়েকটি অ্যাওয়ার্ড। এর মধ্যে ২০১২ সালে ইন্টারন্যাশনাল ওম্যান জুডিজ ফেলোশিপ অ্যাওয়ার্ড ২০-২০১৩ (ইন্টারন্যাশনাল ওম্যান জুডিজ অ্যাসোসিয়েশন ইন পার্টনার শিপ উইথ গোল্ডেন গেট ইউনিভার্সিটি স্কুল অব ল) প্রাপ্ত হন। এই ফেলোশিপের অংশ হিসেবে তিনি ২০১৩ সালে আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার গোল্ডেন গেট বিশ্ববিদ্যালয় হতে পরিবেশ আইন নিয়ে স্নাতকোত্তর করার সুযোগ পান। সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে দেশের ইতিহাসে তিনিই প্রথম এই পুরস্কারটি অর্জন করেন। পুরস্কারের ঝুড়িতে আছে আরো অর্জন।
পড়াশোনায় ভালো ভালো ফলাফলের জন্য নিজের বাড়িকে বানিয়েছে পুরস্কারের জাদুঘর। পড়াশোনা শেষে ২০০৮ সালের ২২ মে সহকারী জজ হিসাবে ঢাকা জজ কোর্টে যোগদান করেন। এর পর ২০১২ সালে সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে ময়মনসিংহ চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আসেন। সবশেষ তিনি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টে প্রথমবারের সহকারী রেজিস্ট্রার নিয়োগ পেয়েছেন।
নারী বিচারক হিসেবে বাংলাদেশ বিচার বিভাগে কোনো প্রতিকূল পরিবেশের সম্মুখীন হননি জানিয়ে ফারজানা বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা নারী বিচারকদের সবসময়ই যথাযথ মূল্যায়ন করেছেন এবং তারই ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টে এই প্রথম নারী সহকারী রেজিস্ট্রার নিয়োগ পেয়েছি আমরা। একই সঙ্গে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছ থেকে সর্বতো ধরনের সহযোগিতা পেয়েছি। বর্তমান সময়ে বিচার প্রার্থীদের একটি বড় অংশ হচ্ছে নারী ও শিশু। তাছাড়া তাদের কাছে নারী বিচারকের গ্রহণযোগ্যতা বেশি। বর্তমানে বাংলাদেশের জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশন মেধাবী বিচারক হিসেবে গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সাধারণ জনগণের কাছেও মেধাই প্রাধান্য পাচ্ছে।
মেধাবী মেহনাজ নিজেকে সমৃদ্ধ করেছেন নানান দিক থেকে। তিনি অস্ট্রেলিয়া লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড নিয়ে মেলবোর্ন থেকে বিশেষ স্বতন্ত্রে কমার্শিয়াল ল’তে মাস্টার্স শেষ করেন।
মা-বাবা দুজনের উত্সাহেই আজ এই পর্যন্ত আসা। নিজের ইচ্ছা বা স্বপ্ন দুইটিই ছিল আইন পেশাকে ঘিরে। বাবার চাকরির সুবাদে স্কুল ও কলেজ জীবন কেটেছে চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম গভর্নমেন্ট গার্লস হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং চট্টগ্রাম কলেজ থেকে এইচএসসি শেষ হয় তার। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এল.এল.বি অনার্স এবং এলএলএম করেন হিউম্যান রাইটস থেকে। পড়াশোনা শেষে ২০১০ সালে সহকারী জজ হিসাবে কুমিল্লা জজ কোর্টে যোগদান করেন। তারপর নারায়ণগঞ্জ ও ময়মনসিংহে চাকরি করেন।
মেহনাজ বলেন, নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে। তাদের প্রতি বৈষম্যও কমেছে অনেক। আজ তাই বলেইতো নারীরা নিজের অধিকার রক্ষায় সোচ্চার। দেশে সব জায়গায় পুরুষদের মতো নারীরাও কাজ করে যাচ্ছে। আমি যদি নিজের কাজের ক্ষেত্রের কথা বলি তখন অবশ্যই বলবো আমি আমার সহকর্মীদের কাছ থেকে কখনো বৈষম্যমূলক আচরণ পাইনি। তারা আমাকে নানা দিক থেকে সহযোগিতা করেছে। আজ নারীরা অনেক সচেতন। তবে নারীদেরকে আরো আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। মেধা ও মননের চর্চা করতে হবে। দেশের প্রতি গভীর ভালোবাসা ও দেশের জন্য আত্মত্যাগী মনোভাব থাকতে হবে। তখনই নারী উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে দেশটিকেও আমরা এক জায়গায় নিতে পারবো।
-ইত্তেফাক
সম্পাদনা- ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম