প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা’র পদত্যাগ ও উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম -এর সম্পাদক ড. বদরুল হাসান কচির সঙ্গে কথা বলেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যালের প্রসিকিউটর এবং ইষ্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের চেয়ারপার্সন ব্যারিস্টার ড. তুরিন আফরোজ।
দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মত প্রধান বিচারপতি পদত্যাগের ঘটনা ঘটেছে, সেক্ষেত্রে বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে বলে মনে করেন কি?
ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ : সব কিছুরই একটি প্রথম থাকে। দেশের ২১ জন প্রধান বিচারপতির মধ্যে এস কে সিনহার মত এতো সরব প্রধান বিচারপতি আর পাওয়া যায়নি। এক্ষেত্রে তিনিই প্রথম। আবার আমরা প্রথমবারের মত একজন প্রধান বিচারপতি পেয়েছি যিনি কি-না এজলাসে বসেই বলেছেন তিনি শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন। আমাদের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি (এস কে সিনহা) বিভিন্ন সময় স্ববিরোধী এবং সাঙ্ঘর্ষিক কথা-বার্তা বলেছেন। তিনি ষোড়শ সংশোধনী রায়ে বলেছেন সংসদ অপরিপক্ক আবার তিনিই পাবলিকলি বলেছেন পৃথিবীর দশজন শক্তিশালী প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে আমাদের প্রধানমন্ত্রী একজন। রায়ে তিনি বলেছেন বাংলাদেশে দুর্নীতি অবাধ। কিন্তু বিচার বিভাগের ক্ষেত্রে সাবেক বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের দুর্নীতির অনুসন্ধানে বাধা দিয়েছেন। ফলে উনাকে নিয়ে চলমান বিতর্কে বিচার বিভাগের নষ্ট হতে যাওয়া ভাবমূর্তি বরং উনার পদত্যাগের মাধ্যমে রক্ষা পেয়েছে।
প্রধান বিচারপতির পদত্যাগে বিচার বিভাগের প্রতি জনগণের আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে বলে মনে করে কি?
ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ : প্রধান বিচারপতির পদত্যাগে বিচার বিভাগের প্রতি জনগণের আস্থাহীনতা তৈরি হয়নি, জনমনে আস্থা ফেরত এসেছে। কারণ যার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আছে তিনি কেন স্বপদে বহাল থাকবেন। জনগণ কিন্তু মাথায় রাখে না আইনে কি আছে। ইতোমধ্যে যেহেতু দেশব্যাপী প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে দুর্নীতিসহ ১১টি অভিযোগের খবর পৌঁছে গেছে তখন থেকেই জনগণের মনে এক ধরণের মনস্তাত্ত্বিক চাপ তৈরি হয়েছে। এর আগেও তিনি বলেছেন তিনি শান্তি কমিটির সদস্য যা জনমনে কষ্ট দিয়েছে। একজন শান্তি কমিটির সদস্য কেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবেন, উনিই কেন বিচারক হলেন? সুতরাং উনার পদত্যাগ এই ধরণের মনস্তাত্ত্বিক এবং কষ্ট থেকে জাতিকে মুক্তি দিয়েছে।
ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ : আমি বলবো সঙ্কট সৃষ্টি হয়নি, সঙ্কট নিরসন হয়েছে। কারণ বিচারপতি সিনহা যদি পদত্যাগ না করতেন তাহলে আরও বড় এবং চরম সংকট দেখা দিত। কেননা ইতোমধ্যে আপিল বিভাগের বাদবাকি ৫ বিচারপতি উনার সাথে একই বেঞ্চে বসবেন না মর্মে স্টেটমেন্ট দিয়েছেন। ফলে উদ্ভূত সংকটে যদি ১৫ দিনও বিচার কার্যক্রম বন্ধ থাকতো তাহলে মামলাজট আরও বৃদ্ধি পেত। সে অবস্থা থেকে উনার পদত্যাগে বরং স্বস্তি ফিরে এসেছে।
ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ : স্বপদে থাকা অবস্থায় প্রধান বিচারপতি অনেক ক্ষমতাবান ছিলেন। গণমাধ্যমে তার দুর্নীতি কিংবা অন্যকোন সমস্যা নিয়ে লিখলে তিনি তাঁদের ডেকে পাঠিয়ে ব্যাখ্যা চেয়েছেন। যেকোন অভিযোগ কোন একটা মাধ্যমে নজরে আসতে হয়। সেটা দুর্নীতি দমন কমিশন হোক কিংবা গণমাধ্যমের বরাতেই হোক। এখন উনার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপতির কাছে ১১ টি অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। চলমান প্রক্রিয়ায় এসবের তদন্তও নিশ্চয়ই হবে। মনে রাখতে হবে প্রধান বিচারপতি একটি সাংবিধানিক পদ। তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগও তদন্ত করা হবে। জাতি অবশ্যই জানতে চায় প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ ১১ টি নাকি ২১টি নাকি শূন্য? সংবিধানের মতে প্রধান বিচারপতিও আইনের উর্ধ্বে নন। ফলে তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে সেগুলোর তদন্ত অবশ্যই করা প্রয়োজন কারণ অভিযোগগুলো সত্য না মিথ্যা তা জানার অধিকার জনগণের রয়েছে।
ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ : মূল প্রশ্ন হচ্ছে একজন দুষ্ট বিচারককে কিভাবে ডিসিপ্লিনড করবো? দেখুন, এ ব্যাপারে আমরা এমন একটি সাংবিধানিক সংকটে দিন কাটাচ্ছি যেখানে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল হয়েছে, রিভিউ হবে কি হবে না তা নিয়ে আলোচনা চলছে। ফলে একজন দুষ্ট জাজকে ডিসিপ্লিনড করার ক্ষেত্রে সংসদেও যাওয়া যাচ্ছে না আবার সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলও অপারেটিভ না। এই পরিস্থিতিতে তাহলে আপনি কোথায় যাবেন, উপায় কি? এই মুহুর্তে তাই এ বিষয়ে সমাধান দেবার দায়িত্ব রাষ্ট্রের অভিভাবক মহামান্য রাষ্ট্রপতির নিকট বর্তায়। কারণ হি ইজ দ্যা অ্যাপয়েন্টেড অথোরিটি। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৮ (৩) এবং ৯৫ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতিকে নিয়োগ দেন। ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সংকটের সমাধানে তিনি যদি মনে করেন আপিল বিভাগের অন্যান্য বিচারপতিদের সাথে আলোচনা করবেন সেই অধিকার রাষ্ট্রপতির আছে। ফলে যতক্ষণ না বিচারপতি অপসারণে আইন হচ্ছে বা কোন সিস্টেম ডেভেলপ হচ্ছে ততক্ষণ রাষ্ট্রপতি চাইলে সংকট সমাধানে এ ধরণের পদক্ষেপ নিতে পারেন। এখন আমরা তো আর রাষ্ট্রপতির প্রজ্ঞাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারি না।
রাষ্ট্রপতি যখন বিচারপতিদের বঙ্গভবনে ডেকে পাঠান তখন একটা চাপ থাকে। এখানে তিনি অন্য বিচারপতিদের ওপর কোন চাপ সৃষ্টি করেছেন বলে মনে হয় কি?
ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ : চাপ দিচ্ছেন কি দিচ্ছেন না সেটা এখান থেকে বলা মুশকিল। তবে সমস্ত বিচারপতি রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেন। সেক্ষেত্রে অ্যাপয়েন্টেড অথোরিটি হিসেবে তিনি যদি জবাবদিহিতার জায়গা তৈরি করেন সেখানে চাপ অনুভূত হবার কি আছে? এখন যিনি আমাকে চাকরী দিলেন তিনি কি আমাকে উদ্ভূত সমস্যায় জিজ্ঞাসা করতে পারেন না যে এই ঘটনা কেন ঘটছে?
প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠতার ক্রম আবলম্বনের প্রথা রয়েছে এক্ষেত্রে আইন কি বলে?
ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ : অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে সংবিধানের ৯৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জ্যেষ্ঠতার কথা বলা আছে। কিন্তু রাষ্ট্রপতি বিচারপতি নিয়োগ দেন সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৮ (৩) এবং ৯৫ অনুযায়ী। সেখানে জ্যেষ্ঠ বা কনিষ্ঠ বিষয়ে কিছু বলা নাই। এই ব্যাপারে কোন আইন কিংবা অর্ডার নেই। ফলে রাষ্ট্রপতি যাকে যোগ্য মনে করবেন তাকেই নিয়োগ দিতে পারেন। এক্ষেত্রে প্রথা মানা না মানার প্রশ্ন অবান্তর। প্রধান বিচারপতি নিয়োগ পদোন্নতি না যে জ্যেষ্ঠতার ক্রম মানতেই হবে। তিনি যদি সর্ব কনিষ্ঠজনকেও যোগ্য মনে করেন তাকেই প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দিতে পারেবেন। প্রবীণতা দিয়ে প্রাজ্ঞতা বিচার করা যায় না।