আট বছর আগে পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের কারণ হিসেবে ষড়যন্ত্রের বিষয়টি উঠে এসেছে উচ্চ আদালতের পর্যবেক্ষণে। হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, বাইরের দেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে এই বিদ্রোহ ঘটানো হয়।
আজ রবিবার (২৬ নভেম্বর) সকাল ১০টা ৫৬ মিনিটে এ মামলার রায় ঘোষণাকালে বিচারপতি মো. শওকত হোসেনসহ তিন সদস্যের বৃহত্তর হাইকোর্ট বেঞ্চের রায়ে এই মন্তব্য করা হয়। বেঞ্চের অপর দুই সদস্য হলেন- বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার।
বিচারকরা রায় পড়া শুরু করলেও আজ সাজা ঘোষণা করেননি। কেবল পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হয়েছে আজ।
১০ হাজার পৃষ্ঠার রায়ে পর্যবেক্ষণ এক হাজার পৃষ্ঠার বেশি থাকছে বলে জানিয়েছেন বিচারক। রায় পুরো পড়া হবে না জানিয়ে ‘সামারিলি জাজমেন্ট’ (সংক্ষিপ্ত রায়) দেওয়ার কথা জানান তিনি। বিচারক বলেন, সেখানে রায়ের ফাউন্ডেশন অংশে কে কোন কারণে কী সাজা পেয়েছেন তা আমরা উল্লেখ করব।
পর্যবেক্ষণে বলা হয়, একাত্তর যে বাহিনী প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, সেই বাহিনীর এই বিদ্রোহ কলঙ্কজনক।
বিদ্রোহের হত্যাযজ্ঞকে নৃশংস, বর্বরোচিত ও নজিরবিহীন আখ্যা দিয়ে বিচারকরা বলেন, এত অল্প সময়ে ৫৭ জন সেনা হত্যার ঘটনা পৃথিবীর আর কোথাও ঘটেনি। বিদ্রোহে জড়িতরা অমানবিক নির্যাতন চালিয়েছে বলেও মন্তব্য করা হয় পর্যবেক্ষণে।
বিভিন্ন দেশের সেনা কর্মকর্তা হত্যার কয়েকটি সংখ্যার উল্লেখ করে পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ‘একাত্তরে ৫৫ জন সেনা কর্মকর্তা পাকিস্তানি বাহিনীর দ্বারা নিহত হন। কিন্তু বিডিআর বিদ্রোহে ৩০ ঘণ্টার মধ্যে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তা নিহত হন। যা এর আগে আর আর ঘটেনি।’
মামলাটি পরিচালনার ক্ষেত্রে আইন বিজ্ঞান, সমাজ বিজ্ঞান, আইন বিজ্ঞানী ও সমাজ বিজ্ঞানীদের গবেষণা, অপরাধের ধরণ, কারণ, ও কোরআন শরীফের কিছু নির্দেশনাসহ বেশ কিছু ধর্মগ্রন্থের পর্যালোচনা করা হয়েছে।
রায়ের পর্যবেক্ষণে বিদ্রোহের সেই সময়কার ঘটনাগুলোর বর্ণনা করার পাশাপাশি রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের আইনজীবীদের যুক্তিতর্কের শুনানি তুলে ধরা হয়েছে।
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদরদপ্তর পিলখানায় বাহিনীটির শীর্ষ কর্মকর্তাদেরকে দরবারে আটকে রেখে বিদ্রোহ করে সৈনিকরা। দুই দিনের বিদ্রোহে বাহিনীতে কাজ করতে আসা সেনাবাহিনীর ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যা করা হয়। এদের মধ্যে বাহিনীটির সে সময়ের মহাপরিচালক শাকিল আহমেদও ছিলেন। এই বিদ্রোহ পড়ে ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বাহিনীটির ক্যাম্পে।
২৬ ফেব্রুয়ারি জাতির উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষণে বিদ্রোহী সৈনিকদের প্রতি হুঁশিয়ারি দেয়ার পর অস্ত্র সমর্পণ করে বিদ্রোহী সেনারা। তবে ততক্ষণে পিলখানা থেকে পালিয়ে যায় বেশিরভাগ বিদ্রোহী। পরে তাদের প্রায় সবাই ধরা পড়ে অথবা আত্মসমর্পণ করে।
সেনাবাহিনী পিলখানার নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর মাটি খুঁড়ে সেনা কর্মকর্তাদের মরদেহ উদ্ধার করে। পাশাপাশি তাদের পরিবারের জিম্মি সদস্যদেরকে বের করে আনা হয়।
এই ঘটনায় হত্যা ও বিদ্রোহের আলাদা মামলা হয়। পাশাপাশি বাহিনীটির সংস্কারেও ব্যাপক ব্যবস্থা নেয়া হয়। বদলে যায় বাহিনীর নাম, পোশাক। নতুন নাম হয় বর্ডার গার্ডস অব বাংলাদেশ বা বিজিবি।
হত্যা মামলায় ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর ১৫২ আসামির ফাঁসির রায় দেন ঢাকার অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. আখতারুজ্জামান। এরপর বিচারিক আদালতের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ অনুমোদন এবং আসামিদের আপিলের শুনানি শুরু হয় উচ্চ আদালতে।
৩৭০ কার্যদিবস শুনানি শেষে গত ১৩ এপ্রিল উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষ হয়। এরপর রায় ঘোষণার জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখা হয় মামলাটি।
উচ্চ আদালতে এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জাহিদ সরোয়ার কাজল। আসামিপক্ষে ছিলেন বিএনপি নেতা খন্দকার মাহবুব হোসেন, এসএম শাহজাহান ও আমিনুল ইসলাম।
এই মামলার সাড়ে আটশ আসামির মধ্যে জীবিত আছেন ৮৪৬ জন। তাদের মধ্যে ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড ছাড়াও ১৬১ জনকে দেয়া হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
আসামিদের মধ্যে বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টু ও আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড নেতা তোরাব আলীকে যাবজ্জীবন দণ্ড দিয়েছে বিচারিক আদালত।
এছাড়া অস্ত্র লুটের দায়ে আরো ১০ বছরের কারাদণ্ড, ২৫৬ জনকেতিন থেকে ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেয়া হয়েছে। কারো কারো সাজা হয়েছে একাধিক ধারায়। অপরাধে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত না হওয়ায় রায়ে ২৭৭ জনকে বেকসুর খালাস দেন বিচারক।
সুপ্রিমকোর্ট প্রতিনিধি/ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম