চাকরিদাতা নিজেই মুক্তিযোদ্ধা সনদ জোগাড় করে দেন। এক জেলার বাসিন্দাকে অন্য জেলার নাগরিকত্ব সনদ দেয়ার দায়িত্বটাও তার। বিনিময়ে গুনে গুনে দিতে হয় ৩ থেকে ৮ লাখ টাকা। এর পর স্থায়ী ঠিকানা ও সনদপত্র তদন্ত পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) সদস্যদের ম্যানেজ করতে পারলেই চাকরি কনফার্ম। পরিশ্রম ও যোগ্যতা ছাড়াই সোনার হরিণ নামক চাকরি দিচ্ছে সিন্ডিকেট। কারারক্ষী নিয়োগে গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে এমন তিনটি সিন্ডিকেটের খোঁজ পাওয়া গেছে।
কারা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক কর্নেল মো. ইকবাল হাসান গণমাধ্যমকে বলেন, কারারক্ষী নিয়োগে কারাগারের লোকজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ আসতেই পারে। তবে সব কিছুই তদন্তের বিষয়। তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে শাস্তিও আছে।
জানা গেছে, কারারক্ষী পদে যত নিয়োগ হচ্ছে এর বেশকিছুর চাকরিদাতার প্রাথমিক সিন্ডিকেট কারারক্ষীরা। মূলত ঘুষ-দুর্নীতি করে এসব পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। এসব সিন্ডিকেটের অন্যতম আরিফুর রহমান সিন্ডিকেট। আরিফুর রহমান চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের একজন সাধারণ কারারক্ষী। তার বাড়ি কুমিল্লায়। ছোট পদে চাকরি করলেও চট্টগ্রাম কারা বিভাগের বাইরে গিয়ে সিলেট এবং ঢাকা বিভাগেও চাকরি দেওয়ার হাত রয়েছে তার।
কারারক্ষী পদে সর্বশেষ গত ৪ সেপ্টেম্বর সিলেট বিভাগের কারা প্যারেড মাঠে ভর্তি পরীক্ষা হয়। মুক্তিযোদ্ধা কোটায় অংশ নিয়ে ওই পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের মধ্যে পাঁচজন হলেন সায়উদ্দিনের ছেলে আল আমিন (নাসির), আবদুল জলিলের ছেলে মুমিন, গোলাম রাব্বানীর ছেলে রবিন (বাবু), বাবর আলীর ছেলে মামুনসহ আরও এক তরুণ। প্রত্যেকের স্থায়ী ঠিকানা দেওয়া হয় সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জে। এবার পুলিশি তদন্তের পালা। পুলিশের (ভেরিফাই) তদন্ত প্রতিবেদন ইতিবাচক হলে মুক্তিযোদ্ধা কোটাকে অগ্রাধিকার দিয়ে মাঠ পরীক্ষার যোগ্যতায় আগামী ১০ ডিসেম্বর সোনার হরিণ নামক নিয়োগপত্র পাবেন তারা।
তবে জামালপুরের মাদারগঞ্জ উপজেলার বালিঝুড়ি বাজারের একটি সূত্রের তথ্য, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও দৌহিত্র পরিচয়ে কারারক্ষী পদে নিয়োগ পেতে যাওয়া ওই ৫ জনের বাড়ি সিলেট নয়। ঢাকা বিভাগের জামালপুর মাদারগঞ্জের গুনারীতলা গ্রামই তাদের স্থায়ী ঠিকানা। মুক্তিযোদ্ধা সনদ ও সিলেটে দেখানো হয় ভুয়া ঠিকানা।
সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০ নভেম্বর যাওয়া হয় গুনারীতলা গ্রামে। ৩নং গুনারীতলা ইউনিয়নের এক কোনে গুণারীতলা বাজার। বাজারের মধ্য ও উত্তর পাড়ার আধা কিলোমিটারের মধ্যেই নিয়োগের অপেক্ষায় থাকা ওই পাঁচজনের বাড়ি। প্রথমে যাওয়া হয় আল আমিন ওরফে নাসিরের বাড়িতে। বাবা সায়উদ্দিনকে মুক্তিযোদ্ধা দেখিয়ে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় আবেদন করা হয়।
সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে চোখের আড়াল হয়ে যান নাসির। মুক্তিযোদ্ধা জানতে চাইলে তার বৃদ্ধ বাবা সায়উদ্দিন বলেন, আমি না। নাসিরের মামা মুক্তিযোদ্ধা। তবে মুহূর্তেই নাসিরের ভাবি সম্পর্কে একজন এ প্রতিবেদককে বলেন, উনি (সায়উদ্দিন) বুড়ো মানুষ। কিছু মনে রাখতে পারেন না। উনি নিজেই মুক্তিযোদ্ধা। নাসিরের দাদাবাড়ি সুনামগঞ্জে ছিল বলেও দাবি করেন ওই নারী। পরে নাসিরের সঙ্গে যোগাযোগ হয়।
তিনি জানান, গত বছরও ঢাকায় গিয়ে কারারক্ষী পদে আবেদন করেন। মামু-খালু আর মুক্তিযোদ্ধার সনদপত্র না থাকায় ওই সময় তার চাকরি হয়নি। তবে দ্বিতীয়বার নিয়োগে তাকে চাকরির আশ্বাস দেন ওয়াজেদ নামে একজন। তার সঙ্গে যোগাযোগ করে এবার সিলেট গিয়ে চাকরির নিশ্চয়তা পান। বিনিময়ে আরিফুর রহমানের হাতে চার লাখ টাকা তুলে দেন। নাসিরের বিশ্বাস, পত্রিকায় লেখালেখি না করলে তার চাকরিটা নিশ্চিত।
ওই বাড়ির ২০ গজ দক্ষিণে মুমিনের বাড়ি। বাড়িতে পাওয়া যায় তাকে। তিনি বলেন, আমার কেউ মুক্তিযোদ্ধা নেই। তবে এক সময় আমাদের বাড়ি সিলেট ছিল। প্রতিবেশী নাসিরসহ কারাগারে কর্মরত জামালপুরের একটি চক্রের প্রলোভনে পড়ে তিনি সিলেটে গিয়ে পরীক্ষা দেন। এ জন্য অন্য চারজনের মতো তাকেও শুধু এসএসসির সনদপত্র নিতে হয়েছে। আর মুক্তিযোদ্ধার সনদ, সিলেটের নাগরিকত্ব এসব আগেভাগেই তৈরি করে রেখেছেন আরিফুর রহমান।
ভয়ে ভয়ে মুমিন বলেন, ‘লাইনে দাঁড়িয়েছি। ক্যামনে ক্যামনে মাঠে বসে থাকতেই হাতে কাগজপত্র চলে আসে। আমাদের কোনো কষ্টই করতে হয়নি। দেখলাম চাওয়ার আগেই সবকিছু হয়ে যাচ্ছে। কারারক্ষীরা সহায়তা করছে। প্রতিবেশী নাসিরের মাধ্যমে খবর পাই মাঠ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছি। তখনই জমি বিক্রি করে তার মাধ্যমে আরিফুর রহমানকে তিন লাখ টাকা দিই।
নাসির, মুমিন ও তাদের স্বজনরা এ প্রতিবেদকের কাছে তার পূর্বসূরি সিলেটের বাসিন্দা দাবি করলেও তাদের বাড়ির সামনে থাকা ষাটোর্ধ্ব মুদি দোকানি শহিদউল্লাহ বলেন, আমার জন্ম এই এলাকায়ই। সে হিসেবে বলতে পারি, নাসির ও মুমিনের বাবা, দাদা ও দাদার বাবাও এ এলাকার বাসিন্দা। তবে তারা ভালো ছেলে।
এদিকে বাবুকে বাড়িতে পাওয়া যায়নি। কথা হয় তার মা এমেলি বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, শুনেছি ছেলে জেলখানার চাকরি করবে। তবে এ পরিবার ও বাবার বাড়িতে কেউ মুক্তিযোদ্ধা নেই। বাবুদের বাড়ি সিলেটে কিনা, জানতে চাইলে বাবুর বাবা গোলাম রাব্বানী বলেন, ‘আমার ভাই বাদল খুব ভালো বলতে পারে।’ ভাইয়ের কাপড়ের দোকানে নিয়ে যান রাব্বানী। বাদল মিয়ার জবাব, ‘সিলেট কিনা জামালপুরে, সে বিষয়ে আমি কিছু বলতে রাজি নই।’
স্থানীয়রা জানিয়েছে, কারারক্ষী পদে নিয়োগ পেতে বাবার কাছ থেকে তিন লাখ টাকা নেন বাবু। এ ছাড়া বিয়ের চুক্তিবদ্ধ হয়ে কনে পরিবার থেকে আগাম ৫ লাখ টাকা যৌতুক নিয়ে মোট ৮ লাখ টাকা পরিশোধ করেন। নিজ পরিবারে বিয়ের জানাজানি হলে ঢাকা চলে যান বাবু। মামুনের বাড়িতে কাউকে পাওয়া যায়নি।
অন্যদের মতো অন্যদিকে ৫ চাকরিপ্রত্যাশীর আরেক জন (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) এ প্রতিবেদককে জানান, একজন বলেছে সিলেটে গেলে চাকরি হবে। সে প্রলোভনে পড়ে তিনি যানও। কিন্তু জাল-জালিয়াতির বিষয়টি বুঝতে পেরে তিনি ও তার পরিবার প্রতারণার চাকরি থেকে সরে আসে।
এ ছাড়া জীবিত বাবা-মাকে মৃত দেখিয়ে এতিম কোটায় উত্তীর্ণ হন মুক্তাগাছার চান মিয়ার ছেলে মামুনুর রশিদ এবং ফজলুল হকের ছেলে আপতার হোসেন বাঁধন। ওই নিয়োগের ঘটনায় এসবিকে ম্যানেজ করে ইতিবাচক প্রতিবেদন পক্ষে নেন দুজন। কিন্তু বিপত্তি বাধে দুজনের প্রতিবেশী শত্রুদের উড়ো চিঠি। উড়ো চিঠির ভিত্তিতে এনএসআই তদন্ত করতে গিয়ে খুঁজে পায় জাল-জালিয়াতির চিত্র।
গুনারীতলা ও বালিঝুড়ির একাধিক সূত্র জানায়, গাজীপুরের কাশিমপুর-৩ মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারের সহকারী প্রধান কারারক্ষী ওয়াজেদ আলীর বাড়ি জামালপুরে। ছোট পদ হলেও প্রতিবার কারারক্ষী নিয়োগে তার হাত থাকে। সূত্রের তথ্য পেয়ে সাভারের আশুলিয়ার কাইচাবাড়িতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ৫ শতাংশ জমিতে ফ্ল্যাটবাড়ির দুই তলা নির্মাণ করেছেন ওয়াজেদ আলী।
সূত্র জানায়, জামালপুরে কারারক্ষী ও পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগ বাণিজ্য করেন মাদারগঞ্জের বালিঝুড়ির ডিগ্রিপাড়ার জাঙ্গলিয়া গ্রামের ফরহাদ হোসেন নামের এক ব্যক্তি। স্থানীয়ভাবে ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিতে যুক্ত। রয়েছে গাজীপুরে একটি বাড়ি। ৬ লাখ টাকার বিনিময়ে গত বছর যুবককে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদে কারারক্ষী পদে নিয়োগ পাইয়ে দেন। চাকরিরত অবস্থায় গোয়েন্দা প্রতিবেদনে ধরা পড়ে চাকরি চলে যায় ওই তরুণের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই তরুণ জানান, শুনেছি ঢাকার বিমানবন্দর এলাকায় বসবাসকারী মানিক নামে এক ব্যক্তি এবং ওয়াজেদ আলীর সঙ্গে সম্পর্ক ফরহাদের। তাদের মাধ্যমেই চাকরি পাইয়ে দেন তিনি। এ বিষয়ে ফরহাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেও পাওয়া যায়নি।
জানা গেছে, ঢাকার কারা অফিসার্স মেসে কর্মরত রয়েছেন ময়মনসিংহের বাসিন্দা কামরুল। চট্টগ্রাম, গাজীপুর ও ঢাকায় কর্মরত এসব কারারক্ষী মিলে সিন্ডিকেট গড়ে নিয়োগবাণিজ্য করে আসছে। তবে তাদের বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেলেও ওপরের শক্তি অদৃশ্যই থাকছে।
সূত্র জানায়, কারারক্ষী নিয়োগে তিনটি সিন্ডিকেটের বাইরে রয়েছে বিশাল চক্র। মূলত কারারক্ষী সিন্ডিকেট সদস্যরা নিয়োগপ্রত্যাশীদের জোগাড় করে দেন। তবে নিয়োগ প্রক্রিয়া করে থাকে বড় কর্তারাই। তবে বরাবরই তারা থাকেন পর্দার আড়ালে। যতবার কারারক্ষী নিয়োগ হয়, ততবারই কারাগারের দুর্বল তদন্তব্যবস্থায় তারা অধরাই থেকে যান। অন্যদিকে অভিযুক্তদের সঙ্গে যোগসাজশে বদলে যায় তদন্ত প্রতিবেদন। শাস্তি পায় কারারক্ষীরা, আড়ালে থেকে ফের একই কাজ শুরু করে ঊর্ধ্বতন চক্রটি।
কারারক্ষী পদে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ পেয়ে ২০১৬ সালের ২ মে কারা অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠিও পাঠায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক ফরিদ আহাম্মদ স্বাক্ষরিত ১৩ পৃষ্ঠার ওই চিঠিতে কারারক্ষী নিয়োগে অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরা হয়। মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সিনিয়র সচিব ড. মোজাম্মেল হক খান বরাবর পাঠানো পত্রে তালিকা দেওয়া হয় জাল-জালিয়াতি করে নিয়োগপ্রাপ্ত কয়েকজনের। এর পর কারা অধিদপ্তর ফের তদন্ত করে এ অভিযোগের সত্যতাও পায়।
কৃতজ্ঞতা- আমাদের সময়
সম্পাদনা- ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম