রোকেয়া রহমান :
কাউকে জব্দ করার মোক্ষম উপায় কী বলুন তো দেখি? কী, মনে মনে নিশ্চয় উপায় খোঁজা শুরু করে দিয়েছেন। না, কষ্ট করে আর খোঁজার দরকার নেই। এই মোক্ষম উপায়টির কথা জানা আছে যশোরের মনিরামপুর উপজেলার হেলাল মোল্লা ও তাঁর সঙ্গীদের। তাঁরা শুধু জানেন তা নয়, ইতিমধ্যে এর প্রয়োগও করেছেন। তাতে কাজও হয়েছে বেশ। একেবারে জব্দ হয়েছে প্রতিপক্ষ। লজ্জায়, অপমানে তারা আর সমাজে মুখ দেখাতে পারছে না।
গত শনিবার প্রথম আলোয় হেলাল মোল্লাদের প্রতিপক্ষকে জব্দ করার খবরটি প্রকাশিত হয়। খবর অনুযায়ী, হেলাল মোল্লা ও তাঁর সঙ্গীরা ১৬ নভেম্বর সন্ধ্যায় এলাকার একটি বাড়িতে ঢুকে এক কলেজছাত্রীকে বিবস্ত্র করে শ্লীলতাহানি করে এবং এসব দৃশ্য ভিডিও করে ও ছবি তুলে ইন্টারনেট ও মুঠোফোনে ছড়িয়ে দেন। মেয়েটিকে বিবস্ত্র করে ভিডিও করার সময় তাঁর মা বাধা দিতে এগিয়ে এলে তাঁকেও ব্যাপক মারধর করা হয়। এরপর থেকে মেয়েটি লজ্জায় কলেজ যাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, সে মানসিকভাবে অসুস্থও হয়ে পড়েছে। মেয়েটির পরিবারও লজ্জায় আর কাউকে মুখ দেখাতে পারছে না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জমিজমা ও বাড়ি নিয়ে পারিবারিক বিরোধের জেরে এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে। কাউকে জব্দ করার জন্য এর চেয়ে মোক্ষম উপায় আর কিছু হতে পারে কি?
মানুষ কতটা অসভ্য ও বর্বর হলে এমন কাজ করতে পারে? এ কেমন নোংরা মানসিকতা? জমিজমা বা বাড়িঘর নিয়ে পারিবারিক বিরোধ আমাদের দেশে নতুন কিছু নয়। সেসব বিরোধ নিষ্পত্তির নানা উপায় রয়েছে। সালিস বৈঠকে বা আইনের আশ্রয় নিয়েও এসব বিরোধ মিটিয়ে ফেলা যায়। অথচ তা না করে প্রতিপক্ষকে হেনস্তা করার জন্য এ জঘন্য উপায় বেছে নেওয়া হলো।
ওই কলেজছাত্রীর মা হেলাল মোল্লাসহ ১০-১২ জনের বিরুদ্ধে পর্নোগ্রাফি আইনে মামলা করেছেন। পুলিশ ইতিমধ্যে চারজনকে গ্রেপ্তারও করেছে। কিন্তু মনে প্রশ্ন জাগে, যাঁরা এই জঘন্য অপরাধটি করেছেন, তাঁরা কি আদৌ কোনো শাস্তি পাবেন? মনে এমন প্রশ্ন জাগার কারণ হচ্ছে, অতীতে যারা এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছে, তাদের কারও শাস্তি হয়েছে, এমনটা দেখা যায়নি।
মেয়েদের নানাভাবে ফাঁদে ফেলে ভিডিও করা এবং ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা এ দেশে হরহামেশা ঘটেই চলেছে। কেউ আছে কোনো মেয়ের ধর্ষণের ঘটনা ভিডিও করে সেই ভিডিও প্রকাশ করার ভয় দেখিয়ে আবারও মেয়েটিকে ধর্ষণ করে বা মেয়েটির কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করে। আর টাকা না পেলে তা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়। এমন জঘন্য অপরাধ করার পরও কারও শাস্তি না পাওয়াটা খুবই দুঃখজনক।
অথচ পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১২ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি পর্নোগ্রাফি উৎপাদনের উদ্দেশ্যে কোনো নারী, পুরুষ বা শিশুকে প্রলোভন দিয়ে জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে স্থির, ভিডিও বা চলচ্চিত্র ধারণ করলে তার সর্বোচ্চ সাত বছরের কারাদণ্ড হবে ও দুই লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড করা হবে। এ আইনে আরও বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি পর্নোগ্রাফির মাধ্যমে কারও সম্মানহানি করে বা কাউকে ব্ল্যাকমেল করে বা করার চেষ্টা চালায়, তবে তার শাস্তি দুই থেকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও এক থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড। শিশুদের ব্যবহার করে পর্নোগ্রাফি উৎপাদন ও বিতরণকারীদের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তি ১০ বছরের কারাদণ্ড এবং পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা।
আইন আছে কিন্তু তার প্রয়োগ নেই। এর চেয়ে হতাশাজনক ব্যাপার আর কী হতে পারে? আর কত দিন এ দেশে বিচারহীনতার এ সংস্কৃতি চলবে? এভাবে অপরাধীদের পার পাওয়ার অর্থ হচ্ছে অন্যদের একই ধরনের অপরাধ করতে উৎসাহিত করা। পর্নোগ্রাফি আইনের প্রয়োগ করতে হবে। তা না হলে হেলাল মোল্লাদের এ ধরনের অপরাধ করা থেকে কেউ বিরত রাখতে পারবে না।
লেখক : সাংবাদিক