কুমার দেবুল দে :
সিভিল কোর্টস অ্যাক্ট ১৮৮৭ এ আনা হয়েছে সংশোধনী, এরই মধ্যে প্রস্তাবিত সংশোধনী মন্ত্রী পরিষদের অনুমোদন পেয়েছে (১৪ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫) এবং বর্তমান সংসদ ২৮ জানুয়ারী, ২০১৬ সালেই তাহা নিশ্চিত আইনে পরিনত করে। আসলে এই সংশোধনীতে কি কি আছে? এই সংশোধনীতে সংশোধনীর পক্ষে একটা কারন ও ব্যাখ্যাও রয়েছে যা অন্য আইনে নাই।
এই অংশটার মূল বক্তব্য হল মুলত দেওয়ানী আদালত গুলুর এখতিয়ার বৃদ্বি এবং এইখানে সহকারী জজের আর্থিক এখতিয়ার বাড়িয়ে ১৫ লক্ষ টাকা, সিনিয়র সহকারী জজের আর্থিক এখতিয়ার বাড়িয়ে ২৫ লক্ষ টাকা করা হয়েছে আর যুগ্ম জেলা জজের আর্থিক এখতিয়ার বাড়িয়ে ২৫ লক্ষ টাকা থেকে অসীম করা হচ্ছে ( আগেও অসীম ছিল)। এতটুকু পর্যন্ত ঠিক আছে। বিতর্কিত হল জেলা জজের আপীল এখতিয়ার বাড়িয়ে ৫ কোটি টাকা করা এবং এর পক্ষে সাফাই।
জেলা জজের এখতিয়ার ৫ কোটি টাকা করায় যে সুবিধা হয়েছে
এতে নিম্ন আদালতে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হচ্ছে। কারণ, আগে যে মামলাগুলো উচ্চ আদালতে নিষ্পত্তি হত এখন তা এ নিম্ন আদালতে বিচারের জন্য যাবে। এতে মানুষের কষ্ট অনেকখানি কমবে। হাইকোর্টে অনেককেই আসতে হবে না। দেশের দূর-দূরান্তের মানুষকে কষ্ট করে ঢাকায় আসতে হবে না। আপিল আদালতের ক্ষেত্রে আগে জেলা জজের আর্থিক এখতিয়ার ছিল পাঁচ লাখ টাকা। এখন এটি বাড়িয়ে পাঁচ কোটি টাকা করা হয়েছে। অর্থাৎ যে সম্পত্তির মূল্য পাঁচ কোটি টাকা পর্যন্ত, তার আপিল মামলার শুনানি হবে জেলা জজ আদালতে। এর উপরে হলে তা হাইকোর্ট বিভাগে যাবে। আগে সম্পত্তির মূল্য পাঁচ লাখ টাকার বেশি হলে হাইকোর্টে আসত, সংশোধিত আইন কার্যকর হওয়ার পরে পাঁচ কোটি টাকার বেশি মূল্যমানের হলে হাইকোর্টে আসবে। এই সংশোধনীর লাভও ঠিক অতটুকুই এর চেয়ে বেশী না। আপীল করার জন্য শুধুমাত্র ঢাকায় যাওয়া আসার ঝামেলাটা ছাড়া আর কোন লাভ নেই। আরও দুইটা লাভ আছে আর তা হল দুইটা বিশেষ শ্রেণীর মানুষের, ১। জজ আদালতের উকিলদের কিছু ওকালতি বাড়বে কিছু আয় রোজগার বাড়বে। ২। জেলা জজ সাহেবদের আর্থিক এখতিয়ার বাড়বে তাতে তাদের মানসিক প্রশান্তি বাড়বে। সাময়িক ভাবে হাইকোর্টে আপীল মামলার চাপ কমবে। আমি হলফ করে বলতে পারি এছাড়া আর কোন লাভ হবে না।
এই সংশোধনী কার্যকর হওয়ায় যে যে অসুবিধা হতে পারে
জেলা জজ আদালতগুলোতে যে পরিমাণ আপীল মামলা জমা আছে বা সেগুলো নিষ্পত্তির চাপ আছে তা বেড়ে আরও বেশ কয়েকগুণ হয়ে যাবে। আপীল মামলার সংখ্যাবৃদ্ধির ফলে আগে যে গতিতে আপীল নিষ্পত্তি হত বা আপীল নিষ্পত্তিতে আগে যে পরিমাণ সময় লাগতো এখন তা বেড়ে কয়েক গুণ হয়ে যাবে, আপীল নিষ্পত্তি বিলম্বিত হবে। তাতে জেলা জজ সাহেবদের আদালতে যেই মামলাগুলোর মূল বিচার হত ( original Jurisdiction) সেগুলোর নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রিতা হবে।
সবচেয়ে বড় সমস্যা যা হবে সেটা হল মূল মামলার রায় হয়ে যাবার পরে উচ্চ আদালতের সংখ্যা বৃদ্ধি পেল। আগে সহকারী ও সিনিয়র সহকারী জজের রায় এবং যুগ্ম জেলা জজের ৫ লাখ টাকার নিচে মূল্যমানের রায়গুলোর বিরুদ্ধে আপীল হত জেলা জজ আদালতে, তারপরে হাইকোর্টে আপীল বা রিভিশন হত তারপরে আপীল বিভাগে লীভ টু আকারে আপীল হত এবং এর পরে আর কোন ফোরাম নাই যেহেতু মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হত এখানেই। কিন্তু ৫ লাখ টাকার বেশী মূল্যমানের মামলা গুলোর রায়ের বিরুদ্ধে আপীল চলত হাইকোর্টে, তারপরে আপীল বিভাগ এর পরে ফোরাম নাই তাই মামলা চূড়ান্ত নিষ্পত্তি। অর্থাৎ বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে আপীল ফোরাম দুইটা আদালতঃ ১। হাইকোর্ট, ২। আপীল বিভাগ।
কিন্তু এখন সব আপীল ( খুব কম মামলা পাওয়া যার যার মুল্যমান ৫ কোটির বেশী) হবে প্রথমে জেলা জজ আদালতে তার রায়ের বিরুদ্ধে পরে হাইকোর্টে আসা যাবে তারও পরে আপীল বিভাগে আসা যাবে তারমানে এখন আপীল ফোরাম বেড়ে হয়েছে তিনটা কোর্ট যথাঃ জেলা জজ আদালত – হাইকোর্ট – আপীল বিভাগ। মামলা করে তার চূড়ান্ত ফল ঘরে আনতে সময় লাগবে আগের তুলনায় আরও অনেক বেশী । এই সংশোধনীর ফলে হঠাত করে হাইকোর্টে দেওয়ানী আপিলের সংখ্যা কমতে থাকবে তাতে হাইকোর্টে মামলার চাপ একটু কমবে যেহেতু সব আপীল একবার জেলা জজ আদালতে ফাইল হবে তবে তা সাময়িক। কিন্তু এই আপীল মামলাগুলো যখন জেলা জজ আদালতে নিষ্পত্তি শুরু হয়ে যাবে তারপরেই তো হাইকোর্টে জেলা জজের রায়ের বিরুদ্বে আসা শুরু হয়ে যাবে কারন জেলা জজের রায়ের পরের ফোরাম হল হাইকোর্ট। হাইকোর্টের মামলা জট আবার শুরু হয়ে যাবে। আগে যেখানে হাইকোর্টের আপিলের রায়ের পরেই সরাসরি আপীল বিভাগে চলে যাওয়া যেত সে জায়গায় জেলা জজে একবার আপীল, তার রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিভিশন, তার রায়ের বিরুদ্ধে আপীল বিভাগে যেতে হবে। অর্থাৎ এই সংশোধনীর ফলে ফোরামের সংখ্যা অর্থাৎ কোর্ট বৃদ্ধি পাবে এবং ন্যায় বিচার আরও বেশী দীর্ঘায়িত হবে। বিচারপ্রার্থীকে একটা কোর্ট বেড়ে যাওয়ায় কোর্ট ফি দিতে হবে আগের চেয়ে বেশী, একটা কোর্ট বেড়ে যাওয়ায় উকিলের খরচ দিতে হবে আগের চেয়ে বেশী সর্বোপরি আপীল বিভাগ পর্যন্ত যেতে সময় লাগবে আগের চেয়ে বেশী এবং মামলা চুড়ান্তভাবে নিশপত্তি হতে সময় লাগবে আগের চেয়ে বেশী। অতএব আমার জিজ্ঞাস্য এই সংশোধনী কার স্বার্থে? এইক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে বাইপাস কোন সমস্যার আসল বা চূড়ান্ত সমাধান নয়।
লেখক : সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির কার্যকরী সদস্য।