মাজহারুল ইসলাম :
আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সংবিধান ও বিভিন্ন আইনে অস্পষ্টতা বিদ্যমান। অধিকাংশ বিচারক ও আইনজীবীদের আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি আন্তরিকতা ও দক্ষতা যথাযথ প্রয়োগ না হওয়ার অন্যতম কারণ। আন্তর্জাতিক আইন সম্পর্কিত বাংলাদেশ সংবিধানের কেবল অনুচ্ছেদ ২৫ ও ১৪৫ক বিদ্যমান। অনুচ্ছেদ ১৪৫ক অনুযায়ী আন্তর্জাতিক চুক্তি সংসদে আলোচনা করার জন্য এক ধরনের বাধ্যবাধকতা প্রদান করে, আবার যদি চুক্তিটি নিরাপত্তা সম্পর্কিত হয় তাহলে ওই চুক্তি সংসদে গোপন অধিবেশনে আলোচনা করার কথা বলা করা হয়েছে। যদিও গোপন অধিবেশনের ব্যাখ্যা সংবিধানে উল্লেখ না থাকলেও সংসদ বিধিমালায় তা স্থান পেয়েছে। কিন্তু বিশদ আকারে আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগের ব্যাখ্যা না থাকার কারণে এটি সমস্যা সমাধানের তুলনায় সমস্যার সূত্রপাত বলে ধারণা করা হয়। শুধু ১৯৯৬ সালের গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তি, ১৯৯৭ সালে সংসদে উপস্থাপন করা হয় আলোচনার জন্য।
প্রথাগতভাবে বাংলাদেশের উচ্চ আদালত উত্থাপিত কোনো বিষয়ের ওপর যদি সুস্পষ্ট দেশীয় আইন থাকে, সে ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইনকে প্রাধান্য না দিয়ে দেশীয় আইনকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ বাংলাদেশ বনাম সোমবোন আসভান মামলায় ১৯৯৭ সালে উচ্চ আদালত আন্তর্জাতিক আইন সমূহের পরিবর্তে ১৯৭৪ সালের বাংলাদেশ টেরিটোরিয়াল ওয়াটার ও মেরিটাইম জোন আইন অনুযায়ী বিষয়টির নিষ্পত্তি করে।
সাইফুল ইসলাম দিলদার বনাম বাংলাদেশ ১৯৯৮ সালের মামলায় আবেদনকারী যুক্তি প্রদান করেন যে, আত্মনির্ধারণের অধিকার আন্তর্জাতিক আইনে ‘জাস-কোজেনস’ বা বাধ্যকরী আইন হিসেবে স্বীকৃত বা প্রথাগত আদর্শ হয়ে উঠেছে। যেহেতু এই নীতি সব জাতির ওপর বাধ্যতামূলক, অতএব বিদেশি অভিযুক্ত অনুপ চেটিয়াকে ভারতের কাছে হস্তান্তর বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৫ লঙ্ঘন করবে। আবেদনকারীর মতামত প্রত্যাখ্যান করে আদালত যুক্তি প্রদান করেন যে, ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে অনুপ চেটিয়াকে হস্তান্তর করার উদ্দেশ্যে জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও সমতা এবং অন্যান্য দেশের অভ্যন্ত্মরের বিষয়ের প্রতি সম্মান নীতিমালা অনুসরণ করে যা অনুচ্ছেদ ২৫(১) অনুযায়ী আন্তর্জাতিক সুসম্পর্কের অনন্য দৃষ্টান্ত। এ ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের উচ্চ আদালত প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক নীতি অনুসরণ না করে বাংলাদেশের সংবিধানের আন্তর্জাতিক সুসম্পর্কের নীতিমালার মাধ্যমে বিষয়টি নিষ্পত্তি করে। উপরন্তু, চৌধুরী এবং ক্যানদেরা বনাম বাংলাদেশ ২০০৯ অনুযায়ী, কোনো আন্তর্জাতিক আইন রাষ্ট্র কর্তৃক অনুমোদন হলে যদিনা দেশীয় আইনে অন্তর্ভুক্ত হয় সে ক্ষেত্রে আদালত তা আমলে নেবে না।
আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান মামলা হচ্ছে বিনলা বনাম বাংলাদেশ ২০০১ উচ্চ আদালতের ভাষ্য অনুযায়ী, দেশীয় আইনের দুর্বলতা দূর করার জন্য বা জাতীয় আইন সভা কর্তৃক সঠিক আইন প্রণয়নের আগ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক আইনের সাহায্য নেয়া যেতে পারে। একইভাবে বাংলাদেশ বনাম হাসিনা ২০০৮ অনুযায়ী, অন্যের জীবনের নিশ্চয়তা ও তার স্বাধীনতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে বা অন্যের অধিকার নির্ধারণে সংবিধানের মৌলিক বিধানগুলো ব্যাখ্যা করার সময় আদালত আন্তর্জাতিক আইন বা কনভেনশনের সাহায্য নিতে পারে। অন্যদিকে, বাংলাদেশ সংবিধানে আন্তর্জাতিক আইনের অবস্থান নির্ধারণে সম্প্রতি প্রধান প্রসিকিউটর বনাম আব্দুল কাদের মোল্লা ২০১৩ মামলায় সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা মতামত প্রদান করেন যে, সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের কোনো বাধ্যতামূলক কার্যকারিতা বাংলাদেশে নেই। সুতরাং আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে যদি তা অসঙ্গতিপূর্ণ হয় সংসদীয় আইনের সঙ্গে।
বাংলাদেশের চুক্তির অনুমোদন সম্পর্কে কোনো সাংবিধানিক বা সংবিধিবদ্ধ বিধান নেই বা আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগের কথা কোথাও স্পষ্ট আকারে উল্লেখ না থাকার কারণে, বাংলাদেশের উচ্চ আদালত বিভিন্ন সময় আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগের পক্ষে ও বিপক্ষে মতামত প্রদান করেছে। বাংলাদেশের মতো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় যা কখনো কাম্য হতে পারে না। যদিও বাংলাদেশে আইন কমিশন আন্তর্জাতিক আইনের প্রয়োজনীয়তার কথা বিবেচনা করে, বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক আইনের অবস্থান ও প্রয়োগের বিষয়টির ওপর একটি খসড়া প্রণয়নের মাধ্যমে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছে। সরকারকে, বাংলাদেশ আইন কমিশন কর্তৃক প্রণীত খসড়াটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে যেসব অস্পষ্টতা রয়েছে তা দূরীভূত করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে।
অন্যদিকে শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন, সহযোগী অধ্যাপক আইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি গবেষণাপত্রে মতামত প্রদান করেন যে, বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক স্বাক্ষরিত এবং স্বীকৃত কিছু কিছু আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলো প্রয়োগের ক্ষেত্রে আইন বা বাংলাদেশ সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন হতে পারে ১) বিদ্যমান আইনের পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ২) নির্বাহী বিভাগের নতুন ক্ষমতা প্রদানের ক্ষেত্রে ৩) নাগরিকদের আর্থিক বাধ্যবাধকতা আরোপ এর ক্ষেত্রে ৪) নাগরিকদের অধিকার প্রভাবিত করে এমন ক্ষেত্রে ৫) বাংলাদেশের ভূখণ্ডের কোনো অংশ সমর্পণ বা অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে। সুতরাং, দেশীয় আইনিব্যবস্থায় কীভাবে আন্তর্জাতিক আইনের প্রয়োগ হবে এটি একটি জাতীয় স্বার্থের প্রশ্ন। এটা বুঝতে হবে যে আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিদের আন্তর্জাতিক আইনে অধিকার এবং বাধ্যবাধকতা বিদ্যমান। এ কারণে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক আইন বাস্তবায়ন ও প্রয়োগের জন্য একটি স্পষ্ট বিধান এখন সময়ের দাবি।
লেখক : পিএইচডি গবেষণারত সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটি, নয়াদিল্লি, ভারত।