বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের কড়া সমালোচনার মুখে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারা বিলুপ্ত করতে যাচ্ছে সরকার। তবে ওই ধারার বিষয়বস্তুগুলো ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে প্রস্তাবিত ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে’ রাখা হচ্ছে। ৫৭ ধারায় অপরাধের ধরনগুলো একসঙ্গে লেখা ছিল, নতুন আইনে সেগুলো বিভিন্ন ধারায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা হচ্ছে। তবে অপরাধের ধরন অনুযায়ী শাস্তির মাত্রা কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
সচিবালয়ে গতকাল বুধবার আন্তমন্ত্রণালয় সভায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়। এখন এটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হবে। মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর খসড়াটি জাতীয় সংসদে যাবে। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন, সংসদের শীতকালীন অধিবেশেনে এটি পাস করার চিন্তাভাবনা নিয়ে কাজ চলছে।
প্রস্তাবিত আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, এই আইন কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আইসিটি আইনের ৫৪, ৫৫, ৫৬, ৫৭ ও ৬৬ ধারা বিলুপ্ত হবে। আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেউ পড়লে, দেখলে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ হতে পারেন অথবা যার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি প্রদান করা হয়, তাহলে এ কাজ অপরাধ বলে গণ্য হবে। এই অপরাধে সর্বোচ্চ ১৪ বছর ও সর্বনিম্ন ৭ বছর কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ ১ কোটি টাকা অর্থদণ্ড দেওয়ার বিধান আছে।
অপরাধের এই সংজ্ঞা, আইনের অজামিনযোগ্য ধারা ও শাস্তির বিষয়গুলো আইনটিকে বিতর্কিত করে তোলে। এর অপব্যবহার এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা নেওয়ার আগে পুলিশ সদর দপ্তরের অনুমতি নিতে দেশের থানাগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়। এ ছাড়া আসামি সাংবাদিক হলে এ ধরনের মামলার বিষয়ে দলের সঙ্গে পরামর্শ করতে সরকারি দল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও কর্মীদের নির্দেশ দেওয়া হয়।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়ায় অপরাধের ধরনগুলো বিভিন্ন ধারায় অন্তর্ভুক্ত করে শাস্তির মাত্রা কমানো হয়েছে। খসড়ার ২৭ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করার ইচ্ছায় ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন বা করান, যা ধর্মীয় অনুভূতি বা ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর আঘাত করে, তাহলে ওই ব্যক্তির সেই কাজ হবে অপরাধ। এই অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ ৫ বছর কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড ভোগ করতে হবে। একই অপরাধ দ্বিতীয় বা তার বেশিবার করলে সর্বোচ্চ ৭ বছর কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হবে। এই ধারার অপরাধ আমলযোগ্য ও অ-জামিনযোগ্য হবে।
জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, যে আইন অনুভূতিতে আঘাত দেওয়াকে অপরাধ বলে, অবশ্যই সেই আইনের সব সময় অপব্যবহার হবে। কোন কথা কার অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছে, তা ব্যক্তিনির্ভর এবং তা সব সময় অপপ্রয়োগ হতে বাধ্য। এই ধরনের অপরাধ যদি রাখতেই হয়, তাহলে থানায় না গিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে অভিযোগ করার বিধান রাখতে হবে। প্রাথমিকভাবে ম্যাজিস্ট্রেট সন্তুষ্ট হলে অভিযোগটি থানায় পাঠাবেন তদন্তের জন্য।
এ আইন সম্পর্কে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা যেভাবে আছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তা সেভাবে থাকছে না। বাক্স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য যেসব ‘চেক অ্যান্ড ব্যালান্স’ দরকার, সেগুলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ছাড়াও সম্প্রচার আইনেও থাকবে।
আইনের খসড়ার ২৮ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে মানহানি-সংক্রান্ত দণ্ডবিধির (১৮৬০) সেকশন ৪৯৯-এ বর্ণিত অপরাধ সংঘটন করেন, তাহলে তাঁকে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড ভোগ করতে হবে। আর ওই অপরাধ দ্বিতীয় বা তার বেশিবার করলে অনধিক পাঁচ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হবে। এই ধারার অপরাধ অ-আমলযোগ্য, জামিনযোগ্য ও আদালতের সম্মতি সাপেক্ষে আপসযোগ্য হবে।
প্রস্তাবিত আইনের ৩০ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন বা করান, যা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে, অস্থিরতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটায় বা ঘটানোর উপক্রম হয়, তাহলে ওই ব্যক্তির সেই কাজ হবে একটি অপরাধ। এ জন্য তিনি সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। আর একই অপরাধ যদি দ্বিতীয় বা তার বেশিবার করেন, তাহলে সর্বোচ্চ ৭ বছর কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এই ধারার অপরাধ আমলযোগ্য ও অ-জামিনযোগ্য হবে।
আইনে আরও যা থাকছে
আইনের একটি ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা জাতির পিতার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রোপাগান্ডা ও প্রচারণা চালান বা তাতে মদদ দেন, তাহলে ওই ব্যক্তির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হবে।
আরেকটি ধারায় বলা আছে, কোনো ব্যক্তি বেআইনি প্রবেশের মাধ্যমে কোনো সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা বিধিবদ্ধ সংস্থার গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত কম্পিউটার, ডিজিটাল যন্ত্র, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারণ, প্রেরণ বা সংরক্ষণ করেন বা করতে সহায়তা করেন, তাহলে সেই কাজ হবে কম্পিউটার বা ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ। এই অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হবে। কেউ যদি এই অপরাধ দ্বিতীয় বা তার বেশিবার করেন, তাহলে তাঁর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হবে।
এ ছাড়া কোনো ব্যক্তি যদি বাংলাদেশের বাইরে এই আইন অনুযায়ী কোনো অপরাধ করেন, যা দেশে করলে দণ্ডযোগ্য হতো, তাহলে সেটি দেশের ভেতরে হয়েছে বলে বিবেচনা করা হবে।
যদি কোনো ব্যক্তি ব্যাংক, বিমা বা অন্য কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা মোবাইল আর্থিক সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো ইলেকট্রনিক বা ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে অবৈধভাবে বা আইনানুগ কর্তৃত্ব ছাড়া ‘ই-ট্রানজেকশন’ করেন, তাহলে ওই ব্যক্তির সেই কাজ অপরাধ হবে। এ ছাড়া সরকার বা বাংলাদেশ ব্যাংকের সময়ে সময়ে জারি করা কোনো ই-ট্রানজেকশনকে অবৈধ ঘোষণা করা সত্ত্বেও যদি কোনো ব্যক্তি ই-ট্রানজেকশন করেন, তাহলে তা অপরাধ হবে। এ জন্য ওই ব্যক্তি সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এ অপরাধ দ্বিতীয় বা তার বেশিবার করলে সর্বোচ্চ সাত বছর কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এ রকম আরও কয়েকটি নতুন প্রস্তাব করা হয়েছে প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে।
খসড়া চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে বৈঠকে উপস্থিত তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু সাংবাদিকদের বলেন, আইনে বিভিন্ন অপরাধের ধরন দেখে বিভিন্ন স্তরের সাজার প্রস্তাব করা হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ১৬ কোটি নাগরিকের নিরাপত্তার জন্য ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ করা হচ্ছে। সুতরাং, এখানে সাংবাদিক বলে আলাদা কিছু নেই। সম্প্রচার আইন যখন আসবে, তখন সাংবাদিক তথা গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা রাখা হবে।
বিতর্ক ও হয়রানি চলছেই
আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই বিতর্ক চলছে। এতে মানুষ হয়রানির শিকার হয়েছেন। গত ২ আগস্ট প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে পুলিশ সদর দপ্তরের এক পরিসংখ্যান দিয়ে বলা হয়, এ বছরের জানুয়ারি মাসে আইসিটি আইনে ৪২টি মামলা হয়। জুনে তা বেড়ে হয়েছে ৭৯টি। এই ছয় মাসে মোট মামলা হয়েছে ৩৯১টি। ওইসব মামলার বেশির ভাগই হয় ৫৭ ধারায়। এসব মামলায় আসামি ৭৮৫ জন, যাঁদের ৩১৩ জন গ্রেপ্তার হন। এই সময়ে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ১৯টি মামলা হয় ৫৭ ধারায়।
সর্বশেষ এ সপ্তাহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুলের নামে আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা হয়। মাদারীপুর সদর থানায় করা এই মামলার বাদী নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের ভাগনে সৈয়দ আসাদউজ্জামান মিনার।
অধ্যাপক আসিফ নজরুল নতুন আইন সম্পর্কে বলেন, আইসিটি আইনে অপরাধের সংজ্ঞা অস্পষ্ট থাকায় সরকারি দলের নেতা-কর্মীরা যেকোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে তা ব্যবহার করতে পেরেছেন। এ আইনের অপব্যবহার এড়াতে চাইলে নতুন আইনে খারাপ বিধান একটাও রাখা যাবে না। তিনি বলেন, সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি ছাড়া অন্য কেউ মামলা করতে পারবেন না—আইনে এমন বিধান রাখা উচিত। অথবা সরকারের নির্দিষ্ট সেল (কোষ) থাকতে পারে, যারা অভিযোগটি প্রাথমিক তদন্তের পর মামলা করতে পারে।
আইসিটি আইনটি প্রথমে প্রণয়ন করা হয় ২০০৬ সালে। পরে ২০১৩ সালে সংশোধন করে শাস্তি বাড়িয়ে সেটিকে আরও কঠোর করা হয়। সাইবার নিরাপত্তা, ডিজিটাল নিরাপত্তা এবং এ-সংক্রান্ত অপরাধের শাস্তির বিষয়ে নতুন আইন প্রণয়নের কাজ শুরু হয় ২০১৫ সালে। প্রথমে ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০১৫’ নাম দেওয়া হলেও পরে সেটি ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন, ২০১৬’ নাম দেওয়া হয়। এটি মন্ত্রিসভায় উত্থাপন হলে তা নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়। আইনটি পর্যালোচনার জন্য আইনমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত কমিটির কাছে পাঠানো হয়। কমিটি গতকাল খসড়াটি চূড়ান্ত করল।
জানতে চাইলে আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘আইসিটি আইনের ৫৭ ধারাটি মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। ওনারা ছেলে ভোলানোর মতো বলেছিলেন ৫৭ ধারা থাকবে না। এখন যদি ওই ধারার অপরাধগুলো ভিন্ন ভিন্ন ধারায় রাখা হয়, তাহলে ৫৭ ধারা বিলুপ্ত হলো কোথায়?’
সূত্র : মোশতাক আহমেদ/প্রথম আলো