আব্দুর রশীদ :
প্রথমেই বলব, প্রচলিত প্রথায় এত বড় একটি বিচারকাজ সম্পাদন করা রাষ্ট্র এবং বিচার বিভাগের জন্য অনন্য সাফল্য ও অর্জন। কারণ এ ধরনের ঘটনার বিচারের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের তো বটেই, বিশ্বের অধিকাংশ দেশেরই নেই। অনেক দেশে বিশেষ ব্যবস্থায় এ ধরনের অপরাধের বিচার হয়েছে। কিন্তু এ দেশে বিচারটি হয়েছে প্রচলিত বিচার ব্যবস্থায়। এটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। প্রচলিত আইন ও প্রথায় বিচার হওয়ার কারণে এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো সুযোগ নেই। এ রায় নিয়ে সন্তুষ্টি বা অসন্তুষ্টির কোনো কিছু নেই।
পিলখানায় ৫৭ জন সামরিক অফিসারকে হত্যার ঘটনা ছিল অত্যন্ত মর্মান্তিক। আর এই অপরাধে জড়িত অপরাধীর সংখ্যাও অনেক। এই হত্যাকাণ্ড ও সহিংসতার পেছনে যে অনেক বড় পরিকল্পনা ছিল- সেটাও রায়ের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। এই হত্যাকাণ্ডের কারণ নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। তবে রায়ের পর্যবেক্ষণে এ হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে যে চারটি কারণের কথা বলা হয়েছে, তার সঙ্গে আমি একমত। রায়ে যথাযথভাবেই উঠে এসেছে আসলে কারণগুলো কী ছিল। এ ব্যাপারে আরও একটি কথা বলা যায়, সে সময় সবেমাত্র একটি সরকার ক্ষমতায় আসার পর এ ধরনের একটি সহিংস পরিস্থিতির সৃষ্টি করা এবং এক ধরনের গণহত্যার মতো ঘটনা সংঘটিত করার পেছনে উদ্দেশ্য ছিল শুধু সরকারকে বেকায়দায় ফেলা নয়; রাষ্ট্রকেই অস্থিতিশীল করে তোলা। এ নিয়েও দ্বিমতের কোনো সুযোগ নেই।
তবে এ ঘটনা থেকে অবশ্যই ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। যেসব তুচ্ছ কারণ- যেমন অপারেশন ডাল-ভাতের মতো ঘটনাকে পুঁজি করে এত বড় ঘটনা ঘটানো হয়েছে, সেগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। এ ঘটনার পর রাষ্ট্র অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। যেমন, বিজিবি নতুন করে সংগঠিত হয়েছে, তাদের সাংগঠনিক সংস্কার হয়েছে। এখন এসব সংস্কার আরও সুস্পষ্ট ও কার্যকর করতে হবে, যেন ভবিষ্যতে আর কখনও বাংলাদেশ এমন ঘটনা না দেখে।
এখানে দেখা যাচ্ছে, অনেক অপরাধীরই ফাঁসির আদেশ হয়েছে। বললে অত্যুক্তি হবে না- বাংলাদেশ কেন, বিশ্বের অধিকাংশ দেশেরই এত বেশিসংখ্যক অপরাধীর ফাঁসির সাজা কার্যকর করার অভিজ্ঞতা নেই। এত বেশিসংখ্যক অপরাধীর একই সঙ্গে ফাঁসির সাজা কার্যকর করার ক্ষেত্রে বিপরীত একটি মানবিক প্রতিক্রিয়াও আসতে পারে। সেটি হচ্ছে, অনেকেই এখানে না বুঝেই অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে। যদিও তারা হত্যাকাণ্ড ও সহিংসতার মতো গুরুতর অপরাধে অংশ নিয়েছে সন্দেহাতীতভাবে। যে কারণে আদালত তাদের সর্বোচ্চ সাজা দিয়েছেন। এই সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীদের পরিবারের পক্ষ থেকে একটি মানবিক প্রতিক্রিয়া আসতে পারে। এসব পরিবারের বিপুল সদস্য মানবিক বিপর্যয়ের কথা বলতে পারেন, মানবিক আবেদন তুলতে পারেন। আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকেও মানবিক প্রতিক্রিয়া আসতে পারে। কিন্তু এ ধরনের প্রতিক্রিয়ায় রাষ্ট্র কী করবে? আমার মত হচ্ছে, এ ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রকে আইনের পথেই থাকতে হবে। কারণ যারা অপরাধ করেছে, তারা অতিমাত্রার গুরুতর অপরাধ করেছে। তাদের সাজা কার্যকর না হলে এবং তারা দায়মুক্তি পেয়ে গেলে এই দৃষ্টান্ত ভবিষ্যতে অপরাধ সংঘটনের ক্ষেত্রে অনুঘটক হিসেবে কাজ করবে। ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের অপরাধ সংঘটিত না হয়, সে জন্যই রাষ্ট্রকে আইনি প্রক্রিয়ার পথেই থাকতে হবে। এটিই আমি মনে করি।
আরও একটি বিষয় ভেবে দেখা জরুরি। রায় পর্যবেক্ষণে আরও একটি কথা বলা হয়েছে- যারা এ ঘটনার পরিকল্পনায় নেপথ্যে থেকে ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে কাজ করেছে, তাদের খুঁজে বের করা উচিত। আদালত বলেছেন, এই বিচার কাজ হয়েছে যারা সহিংসতা ও হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিল, তাদের ক্ষেত্রে। কিন্তু যারা নেপথ্যে থেকে পরিকল্পনা করেছে, ষড়যন্ত্র রচনা করেছে, তারা বিচারের বাইরেই রয়ে গেছে। তাদের খুঁজে বের করা এবং সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করার ব্যাপারটিও রায়ের পর্যবেক্ষণে এসেছে। একটি বিষয় অনস্বীকার্য, যারা এ ধরনের ঘটনার আড়ালে ষড়যন্ত্র রচনাকারী থাকে, তারা নানা কৌশলে রয়ে যায় শক্ত মুখোশের আড়ালে। যে কারণে তাদের চিহ্নিত করাও কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। এটি শুধু বাংলাদেশ নয়; বিশ্বের সব দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। পিলখানার ঘটনার ক্ষেত্রেও ষড়যন্ত্রের মূল রচয়িতাদের মুখোশ উন্মোচন দুস্কর। কারণ শুধু চিহ্নিত করা নয়, সাক্ষী-সাবুদ দিয়ে প্রমাণ করতে হবে- তারা এ ঘটনার সঙ্গে যুক্ত ছিল। না হলে তাদের বিচার করা যাবে না। আমি মনে করি, নেপথ্যের ষড়যন্ত্রকারীদের খুঁজে বের করার জোর প্রচেষ্টা চালানো উচিত। কারণ তাদের চিহ্নিত করা গেলে এ ধরনের ষড়যন্ত্রের রাজনীতি, বীভৎস হত্যাযজ্ঞের রাজনীতিও প্রশমিত হবে।
লেখক : মেজর জেনারেল (অব.) ও নিরাপত্তা বিশ্নেষক