শায়লা জাহান
শিশুর তত্ত্বাবধানের জন্য একজন মায়ের প্রধানতম অধিকারই হচ্ছে হিজানত যা শিশুর পিতার বিরুদ্ধে প্রয়োগযোগ্য। এই অধিকার থেকে শিশুর মা’কে কখনও বঞ্চিত করা যাবে না যদি না তার বিরুদ্ধে অসদাচরনের অভিযোগ প্রমানিত হয়। শিশুর সার্বিক কল্যাণ সাধনের জন্য হেফাজতের এই অধিকারটি প্রয়োগের ক্ষমতা শুধুমাত্র মায়ের জন্য স্বীকৃত। হিজানত প্রয়োগে মায়ের আর্থিক অসচ্ছলতা মামলা চালানোর ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্থ হবেনা।
আমাদের দেশে পারিবারিক আদালতে মামলাজট ও জটিলতা অত্যধিকভাবে বেড়ে চলছে। এসব মামলা নিস্পত্তিতে লাগছে প্রচুর সময়, অর্থ ও পরিশ্রম। তাছাড়া নাবালক তত্ত্বাবধানের মামলা বিশেষ কিছু ক্ষেত্র ছাড়া অহেতুকভাবে করা হয়ে থাকে। মুসলিম আইনে শিশুর সার্বিক কল্যাণের বিষয়কে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। অভিভাবক ও প্রতিপাল্য আইন, ১৮৯০ অনুযায়ী নাবালকের হিজানত অর্থাৎ তত্ত্বাবধানের অধিকার মায়ের উপর অর্পিত যেখানে বাবা হচ্ছেন নাবালকের প্রাথমিক ও স্বাভাবিক অভিভাবক। ছেলে সন্তান হলে সাত বছর আর মেয়ে সন্তান হলে বয়ঃসন্ধি না হওয়া পর্যন্ত সেই সন্তান মায়ের কাছে থাকবে। কিন্তু দেখা যায় যে, স্বামী স্ত্রীর মধ্যে তালাক হয়ে গেলে তাদের সন্তান নিয়ে প্রতিযোগিতামূলক দ্বন্দ্ব শুরু হয় যে শিশুটি কার কাছে থাকবে? যেকোনো কারনে হয়ত শিশুটিকে মায়ের কাছ থেকে জোরপূর্বক নিয়ে নেয়া হয় অথবা মা বাধ্য হয় সন্তানকে তার বাবার কাছে ছেড়ে আসতে। পরবর্তীতে মা শিশুটিকে পাবার জন্য পারিবারিক আদালতের দ্বারস্থ হন। সম্প্রতি ইয়াসিন আব্দুল্লাহ নামের সাত মাস বয়সী শিশুকে ফিরে পাবার জন্য শিশুটির মা মহামান্য হাইকোর্ট ডিভিশনে রিট পিটিশন দায়ের করেন। হাইকোর্ট ডিভিশন প্রাথমিক শুনানির পর শিশুটিকে মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিতে রুল জারি করেন। পরবর্তীতে শিশুটির মা আরও একটি সম্পূরক আবেদন করলে তা খারিজ হবার পর আপিল বিভাগে আবেদন করলে সেক্ষেত্রে আপিল বিভাগ নির্দেশ করেন যে, হাইকোর্টে রুল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত শিশুটি তার মায়ের কাছেই থাকবে। সন্তানের লালন পালন সম্পর্কিত এই আইনটি প্রয়োগের জন্য মাকে ঠিকই আদালতের শরনাপন্ন হতে হল।
আদালত এসব মামলা বিচারের ক্ষেত্রে শিশুর মঙ্গল ও তার নিরাপদ ভবিষ্যৎ এর জন্য শিশুটির কল্যাণের সাথে জড়িত এরকম প্রত্যেকটি বিষয়কে গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় রাখেন। হেফাজতের দায়িত্ব পালনে মায়ের অপারগতা থাকলে সেটাও আদালতের দৃষ্টিগোচর হয়। বিশেষ কিছু ক্ষেত্র যেমন মা নৈতিকতা বিহীন জীবন যাপন করলে বা শিশুকে অবহেলা করলে অথবা নিষিদ্ধ কাউকে বিয়ে করলে যার সাথে শিশুর সম্পর্ক নেই এরকম হলে তিনি হিজানত হারাবেন। সুতরাং বলা যেতে পারে যে, বাবা মার বিচ্ছেদ হবার পর নিদিষ্ট সময় পর্যন্ত মা তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পালন করবেন যদি না মায়ের অধীনে থাকলে শিশুর সার্বিক কল্যাণ ব্যাহত হবার সম্ভাবনা থাকে।
এই ধরনের মামলার ফলাফল নাবালকের জন্য সুখকর কি?
স্বামী স্ত্রীর মধ্যে মতের অমিল থাকতে পারে যার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হিসেবে বিচ্ছেদ ও হতে পারে। বিচ্ছেদ পরবর্তী সময়ে উভয়ের মানসিকতায় পরিবর্তন আসে যার ফল ভোগ করে তাদের সন্তানরা। তাছাড়া, স্ত্রী নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে দেনমোহর আদায় ও ভরণপোষণের মামলা করতে পারে আবার স্ত্রীকে শিক্ষা দিতে গিয়ে স্বামীও সন্তান তত্ত্বাবধানের জন্য মামলা করতে পারে অথবা সন্তানকে নিজের কাছে রাখতে চায়। উভয়ের রেষারেষি সন্তানকে স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দেয় যে তাকে কোন একজনের সাথে থাকতে হবে । এই পরিস্থিতিতে নাবালক শিশুটি তার মা বাবার বিভাজনে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এমনকি সে বোধসম্পন্ন হলে তার উপর গুরুদায়িত্ব পড়ে যে সে কাকে বেছে নিবে? পারিবারিক আদালত থেকে এই ধরনের মামলার কার্যধারা শুরু হয় যা পরবর্তীতে আপিলের ক্ষেত্রে জেলা জজ বা তার উপরস্থ হাইকোর্টের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সমাপ্তি ঘটে। এই মামলা চলাকালীন দীর্ঘ সময়ে নাবালকের মনের উপর বিরুপ প্রভাব পরে যা সত্যিকার অর্থে এই আইনের মূল উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করে। যেখানে এই আইনে নাবালকের মানসিক, শারীরিক মঙ্গল উভয়ই হচ্ছে মুখ্য বিষয়। তবে হ্যাঁ, নাবালকের মা মারা গেলে বা হিজানতের অযোগ্য হলে শিশুটি কার তত্ত্বাবধানে থাকবে তা নির্ধারণের জন্য মামলা দায়েরের গুরুত্ব অপরিসীম। সুতরাং রেষারেষি মনোভাব পরিহার করে নাবালকের মঙ্গল নিশ্চিত করতে এবং নাবালকের মাতা হিজানতের যোগ্য হলে শিশুকে তার মায়ের অধীনে থাকতে দেওয়া সমীচীন মনে করি।
নাবালক তত্ত্বাবধানের বিষয়টি নিয়ে মামলা করলে আদালত নাবালক শিশুর কল্যাণকেই গুরুত্ব দিবেন। তাহলে নাবালকের কল্যাণের জন্য সেই প্রচেষ্টা পরিবার থেকেই শুরু হোক। শুরুতেই আদালতের দ্বারস্থ না হয়ে বিকল্প পদ্ধতি অনুসরণ করে যেমন দুপক্ষের উপস্থিতিতে নিরপেক্ষ ব্যক্তি প্রয়োজন পড়লে পারিবারিক সমঝোতার মাধ্যমে সুরাহা করা যেতে পারে যেখানে শিশুটির সাথে তার বাবা এবং বাবার পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা কিভাবে দেখা করবে, সপ্তাহে কবে, কখন এবং তাদের জন্য সুবিধাজনক স্থান যা উভয় পক্ষের জন্য সহজতর হবে এরূপ শর্তসহ সম্মতিপত্র থাকবে। এতে করে সুবিধা যা হবে যেমন বাবা মায়ের বিচ্ছেদ সন্তানের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলার সম্ভাবনাকে হ্রাস করবে অথবা বাবা মায়ের বিচ্ছেদ পরবর্তী সমঝোতামূলক আচরণ সন্তানকে দ্বিধায় ফেলবে না । সন্তানের স্বার্থে বাবা মায়ের একই মনোভাব সম্পন্ন আচরণ সন্তানের জন্য সবচাইতে মঙ্গলজনক হবে বলে বিশ্বাস করি।
লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট