ঢাকার একটি বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের স্টেশনারি দোকানের নাম ‘অনেস্টি শপ’। যেখানে খাতা কলম, পেন্সিলসহ প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ আছে। কিন্তু কোনো বিক্রেতা নেই। শিক্ষার্থীরা তাদের দরকারি জিনিসটি নিয়ে নেয়। দাম পরিশোধ করে নির্ধারিত বাক্সে। শিশুকাল থেকেই সৎ এবং নীতিবান মানুষ হওয়ার শিক্ষা দিতেই স্কুল কর্তৃপক্ষের এই উদ্যোগ।
স্কুলের শিক্ষার্থীদের নীতিজ্ঞানের এই শিক্ষা দেয়া হচ্ছে কারণ বাংলাদেশে দুর্নীতি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে বলেই অনেকে মনে করেন।
স্কুল কর্তৃপক্ষ জানায় তারা পরীক্ষামূলক এই প্রকল্প চালু করে বেশ আশাবাদী হয়েছেন। কারণ প্রায় সবাই যে পণ্যটি নিচ্ছে তার যথাযথ মূল্য পরিশোধ করছে।
স্কুলটির সততা শিক্ষা প্রকল্প শুরুর পেছনে কাজ করেছে বাংলাদেশ এথিকস ফাউন্ডেশন। এথিকস ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক এ এম এম খায়রুল বাশার ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ এবং পরিচালক।
“দেশের নৈতিক অধঃপতন দেখে আমরা শঙ্কিত। সততা শিক্ষার শুরুটা শিশু বয়স থেকেই হতে হয়। নৈতিকতার শিক্ষার সূচনা হওয়া দরকার পরিবার এবং স্কুল থেকে। এই দুটো হলো হলো মূল উৎস যেখান থেকে শিশু মৌলিক জিনিসগুলো গ্রহণ করছে,” বলেন মি: বাশার।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে পরিবার থেকেই শিশুরা ছোটখাট অন্যায় শিখে বড় হয়। মি. বাশার বলেন, “উঠতি ছেলে মেয়ে- তাদের সামনে তো কোনো আদর্শ নেই। কাকে অনুসরণ করবে? যে আদর্শগুলো সামনে আছে সেগুলো নিলে বরং অনৈতিক জিনিসই বেশি শিখবে।”
বুধবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সরকারি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ-তরুণীরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে শপথ নেয়ার এক অনুষ্ঠানে যোগ দেন। শপথে অংশ নেয়া শিক্ষার্থীরা বলছিলেন পরিবার থেকেই কীভাবে দুর্নীতি আর অনিয়মের শিক্ষা তাদের ভেতরে ঢুকে যায়।
“আমরা স্কুলে দেখেছি যে কেউ সায়েন্স পেল না। দেখা যায় তাদের মায়েরা এসে স্কুল কর্তৃপক্ষকে ঘুষ দেয়ার চেষ্টা করে যে বিভাগটা যদি চেঞ্জ করা যায়। এই বাচ্চাগুলো যেটা শিখছে, ওরাও নিজেদের বাচ্চাদের ক্ষেত্রে সেটা করবে, চাকরি ক্ষেত্রেও এই চর্চ্চাই করতে থাকবে,” একজন তরুণী বলেন।
হাসিব আল মামুন নামের এক তরুণ বলেন, “অনেক বাবা-মাকে দেখা যাচ্ছে বাচ্চাদের ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র কিনে দিচ্ছেন। এর মধ্যে দিয়ে পরিবার থেকেই সে দুর্নীতি শিখছে। এবং এই চর্চ্চাটা থেকেই যাবে তার মধ্যে।”
আরেক তরুণ ফারহান বলছিলেন, ছোটখাট অপরাধ দেখতে দেখতে এখন তারা কোনটা ভুল আর কোনটা সঠিক সেটাই বুঝতে পারেন না।
“দুর্নীতির ব্যাপারটা আমরা এতটাই স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নিয়েছি যে এখন বুঝতেই পারছি না কোনটা দুর্নীতি আর কোনটা দুর্নীতি না। এটা আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের অংশ মনে হচ্ছে।”
পরিবারের সব বাবা মা চান তাদের সন্তানরা সৎ, যোগ্য ও নীতিবান হোক। কিন্তু এ শিশুরা পরিবার সমাজ থেকে প্রতিনিয়ত এ অভ্যাসগুলোর মধ্য দিয়ে বড় হচ্ছে।
ছোট-খাট অন্যায় কাজ পরিবারের বড়দের দেখেই শিখছে শিশুরা। রাস্তায় দেখা যায় স্কুলের বাচ্চাকে সঙ্গে নিয়ে পিতা-মাতারা ট্রাফিক আইন অমান্য করছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. মাহ্ফুজা খানম বলেন, “বাবা মাইতো বাচ্চাদের নিয়ে দেখা যায় চলন্তগাড়ির সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে। ফুটওভার-ব্রিজ ব্যবহার করছে না। এগুলো শিশুদের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। ছোট বাচ্চাদের সম্পর্কে বলা হয়, তারা খালি স্লেটের মতো। সেখানে আপনি যা লিখবেন সেটাই লেখা হবে। তার মানে ও যা দেখবে সেটাই শিখবে। এই অবজারভেশনাল লার্নিং-এর কিন্তু খুব বড় একটা ইমপ্যাক্ট আছে।”
মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, শৈশবে পরিবার থেকে, সমাজ থেকেই সাধুতার শিক্ষা, নীতি এবং নৈতিকতার শিক্ষা মানুষ পায়। ছোটখাট অপরাধই বড় অন্যায় ও দুর্নীতির দিকে মানুষকে নিয়ে যায়। এক্ষেত্রে পরিবারের পিতামাতার উচিত যেকোনো অন্যায়কে প্রশ্রয় না দেয়া।
পৃথিবীতে যে দেশগুলোতে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয় বাংলাদেশ তাদের মধ্যে অন্যতম বলেই পরিচিত। শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্থ দেশের তালিকায় অতীতে কয়েকবার বাংলাদেশ প্রথম স্থানেও উঠেছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের গবেষণায় ২০১৬ সালে বিশ্বে দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশ শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে ১৫ তম অবস্থানে ছিল।
এছাড়া টিআইবির গবেষণায় দেখা যাচ্ছে সরকারি সেবা নিতে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই ব্যাপক হারে বাংলাদেশের মানুষ দুর্নীতির শিকার হয়।
(
/ )