সুপ্রিম কোর্টের মতামতকে প্রাধান্য দিয়েই অধস্তন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলাবিধির বহুল আলোচিত গেজেট জারি করেছে সরকার। তবে গেজেটে বিচারকদের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ মূলত উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের (রাষ্ট্রপতি বা আইন মন্ত্রণালয়ের) হাতেই রেখে দেওয়া হয়েছে। গেজেট জারি নিয়ে সরকারের আইন মন্ত্রণালয় ও সুপ্রিমকোর্টের মধ্যে দীর্ঘ টানাপড়েনের পর গতকাল সন্ধ্যায় বিজি প্রেস থেকে এ গেজেট প্রকাশ করা হয়।
গেজেটের সংজ্ঞা অংশে ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ’ হিসেবে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট এবং সার্ভিস সদস্যের প্রশাসনিক বিষয়ে স্থানীয় নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষকে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া ‘উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ’ হিসেবে রাষ্ট্রপতি বা তৎকর্তৃক সংবিধানের ৫৫(৬) অনুচ্ছেদ অনুসারে প্রণীত রুলস অব বিজনেসের আওতায় দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রণালয় অর্থাৎ আইন মন্ত্রণালয়কে রাখা হয়েছে।
গেজেট পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বিচারকদের বিরুদ্ধে অভিযোগের অনুসন্ধান ও বিভাগীয় মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এসকে সিনহা প্রধান বিচারপতি থাকাকালীন পাঠানো খসড়া শৃঙ্খলাবিধিতে উল্লেখ করা হয়, কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হলে বা গ্রহণযোগ্য সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া গেলে পরবর্তী ৭ দিনের মধ্যে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ বিষয়টির ওপর পরামর্শ গ্রহণের জন্য সুপ্রিমকোর্টে প্রেরণ করবেন।
গেজেটে এই সাত দিনের বিষয়টি উল্লেখ নেই। এ ছাড়া বলা হয়েছে, কোনো অভিযোগ উত্থাপিত হলে বা গ্রহণযোগ্য সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া গেলে এবং উক্তরূপ অভিযোগ উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে আপাতদৃষ্টে যৌক্তিক মনে হলে বিষয়টির ওপর পরামর্শ গ্রহণের জন্য উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ বিষয়টি সুপ্রিমকোর্টের কাছে পাঠাবেন।
এ ছাড়া সুপ্রিমকোর্টের পাঠানো খসড়ায় বলা হয়, ‘সুপ্রিমকোর্ট যদি মনে করে বিষয়টি সম্পর্কে আনুষ্ঠানিক অনুসন্ধানের প্রয়োজন, তা হলে পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যে এক বা একাধিক অনুসন্ধান কর্মকর্তার নামসহ অনুসন্ধান কার্যক্রম গ্রহণের জন্য উপযুক্ত কর্তৃপক্ষকে পরামর্শ প্রদান করবেন এবং পরামর্শ প্রাপ্তির ৭ দিনের মধ্যে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ পরামর্শে উল্লিখিত কর্মকর্তাকে অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ করবেন।’ কিন্তু সুপ্রিমকোর্টের স্থলে গেজেটে বলা হয়েছে, ‘উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ যদি মনে করেন যে বিষয়টি সম্পর্কে আনুষ্ঠানিক অনুসন্ধান প্রয়োজন তা হলে সুপ্রিমকোর্টের পরামর্শক্রমে অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ করবেন কিংবা একাধিক কর্মকর্তার সমন্বয়ে অনুসন্ধান কমিটি গঠন করবেন।’
সুপ্রিমকোর্টের পাঠানো খসড়ার সপ্তম অধ্যায়ে বলা হয়েছিল, সুপ্রিমকোর্টের কোনো পরামর্শ পালনের ক্ষেত্রে বিলম্ব হলে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত সময়সীমা উত্তীর্ণ হওয়ার সাত দিনের মধ্যে বিলম্বের কারণ সুপ্রিমকোর্টকে অবহিত করবেন এবং আর কোনো বিলম্ব না করে ১৫ দিনের মধ্যে ওই পরামর্শ বাস্তবায়ন করবেন। নির্ধারিত সময়সীমা অনুসারে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণে ব্যর্থ হলে এই ব্যর্থতা তার অদক্ষতা হিসেবে গণ্য করা এবং এ কারণে ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করার বিধান রাখা হয়। কিন্তু গেজেটে এসব বিষয় উল্লেখ নেই।
এ ছাড়া সুপ্রিমকোর্টের খসড়া শৃঙ্খলাবিধিতে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ ও সুপ্রিমকোর্টের পরামর্শের মধ্যে কোনো ভিন্নতা দেখা দিলে তা অনধিক একবার পুনর্বিবেচনার জন্য সুপ্রিমকোর্টে পাঠানোর সুযোগ রাখা হয়। কিন্তু গেজেটে এ বিষয়টি বাদ দেওয়া হয়েছে। সার্ভিসের কোনো সদস্যের অবহেলা, ভুল বা গাফিলতির কারণে সরকারের কোনো আর্থিক ক্ষতি হলে এবং ওই সদস্য চাকরিরত অবস্থায় তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের না হলে শর্তসাপেক্ষে অবসর গ্রহণের পরও সংশ্লিষ্ট সদস্যের নিকট হতে অর্থ আদায়ের জন্য বিভাগীয় মামলা করা যাবে বলে গেজেটে উল্লেখ করা হয়েছে।
এর আগে শৃঙ্খলাবিধির গেজেট জারির বিষয়ে শুনানিকালে সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা একাধিকবার বিচারকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে মন্ত্রণালয়ের গড়িমসির এবং ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে ‘পিক অ্যান্ড চুজ’ নীতি গ্রহণের বিষয়টি তুলে ধরেন। সুপ্রিমকোর্টের দেওয়া পরামর্শ পুনর্বিবেচনার নামে কালক্ষেপণের বিষয়টিও সামনে আনেন। এসব কারণে সুপ্রিমকোর্টের পাঠানো খসড়ায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে সময়সীমা, একবারের বেশি পুনর্বিবেচনা না চাওয়াসহ বিভিন্ন বিষয় উল্লেখ করে দেন। কিন্তু গেজেটে এসব বিষয় পাশ কাটানো হয়েছে।
তবে গতকাল আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘মাননীয় সুপ্রিমকোর্টের পরামর্শ কিন্তু অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হচ্ছে। তাদের সঙ্গে একটা ঐক্যমতে পৌঁছে এই শৃঙ্খলাবিধির গেজেট আজ প্রকাশ করা হচ্ছে। বিচারপতি এসকে সিনহা এই বিধিমালা চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে অন্তরায় হিসেবে কাজ করেছিলেন।’ তিনি বলেন, ‘এই শৃঙ্খলাবিধি নিয়ে অনেক নাটক হয়েছিল। আমি আজ আপনাদের বলব, বিচার বিভাগের সঙ্গে নির্বাহী বিভাগের কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না। একজন ব্যক্তির রাজনীতিকরণ করার চেষ্টার কারণে এটি বিলম্বিত হয়েছিল। সেটা যখনই রিমুভড হয়ে গেছে, আমরা বিচার বিভাগ এবং নির্বাহী বিভাগের ঐক্যমতে মহামান্য রাষ্ট্রপতির সম্মতিতে আজকে গেজেট করতে পেরেছি।’
এর আগে ২০১৫ সালে আইন মন্ত্রণালয় থেকে শৃঙ্খলাবিধির একটি খসড়া গেজেট তৈরি করে পাঠালে সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগ তা গ্রহণ না করে নতুন খসড়া করে দিয়ে তার আলোকে গেজেট জারি করতে বলেছিলেন। কিন্তু এক পর্যায়ে আইন মন্ত্রণালয় থেকে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে বলা হয়েছিল, ‘অধস্তন আদালতের বিচারকগণের জন্য সুপ্রিমকোর্ট কর্তৃক প্রস্তাবিত আচরণ ও শৃঙ্খলাবিধির খসড়া বাংলাদেশ গেজেটে প্রকাশ করার প্রয়োজনীয়তা নেই। এ ব্যাপারে মহামান্য রাষ্ট্রপতি সানুগ্রহ সিদ্ধান্ত প্রদান করেছেন।’
বিচারপতি এসকে সিনহার নাটকীয় পদত্যাগের পর ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞার বাসভবনে আপিল বিভাগের বিচারপতিদের সঙ্গে বিধিমালা নিয়ে আইনমন্ত্রীর বৈঠক হয়। ওই বৈঠক শেষে মন্ত্রী জানিয়েছিলেন, বিধিমালা নিয়ে আমরা ঐক্যমতে পৌঁছেছি। রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানোর পর গেজেট জারি হবে।
জানা যায়, ১৯৯৯ সালের ২ ডিসেম্বর মাসদার হোসেন মামলায় (বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ মামলা) ১২ দফা নির্দেশনাসহ রায় দেওয়া হয়। ওই মামলার রায়ের আলোকে ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা হয়ে বিচার বিভাগের কার্যক্রম শুরু হয়। রায়ের ৫ম দফায় বিচারকদের জন্য আলাদা আচরণ ও শৃঙ্খলাবিধি প্রণয়নের নির্দেশনা ছিল। কিন্তু ওই শৃঙ্খলাবিধি না হওয়ায় সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য প্রণীত শৃঙ্খলাবিধির আলোকে বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা বিধান করা হচ্ছিল। সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা দায়িত্ব নেওয়ার পর এই আলাদা শৃঙ্খলা ও আচরণবিধি তৈরির ওপর জোর দেন।
এ অবস্থায় আপিল বিভাগের নির্দেশনা পেয়ে ২০১৫ সালের ৭ মে আইন মন্ত্রণালয় একটি খসড়া শৃঙ্খলাবিধি প্রস্তুত করে সুপ্রিমকোর্টে পাঠায়। গত বছরের ২৮ আগস্ট এ বিষয়ে শুনানিকালে আপিল বিভাগ বলেছিলেন, ‘একটি খসড়া শৃঙ্খলাবিধি তারা (সরকার) দাখিল করেছে। এটি ১৯৮৫ সালের সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালার হুবহু অনুরূপ, যা মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পরিপন্থী। সরকারের পাঠানো শৃঙ্খলাবিধিটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এখন আমরা কমিটি করে একটি শৃঙ্খলাবিধির খসড়া করে দিয়েছি।’ এর আলোকে গেজেট জারি করে গত বছরের ৬ নভেম্বর আপিল বিভাগকে জানাতে সরকারের প্রতি নির্দেশনা ছিল। এর পর সরকার এ গেজেট জারি না করে দফায় দফায় সময় নিতে থাকে। চতুর্থ দফা সময় চাইলে ২০১৬ সালের ৮ ডিসেম্বর আপিল বিভাগ আইন মন্ত্রণালয়ের দুই সচিবকে অ্যাটর্নি জেনারেলের মাধ্যমে তলব করেন। দুই সচিবকে ওই বছরের ১২ ডিসেম্বর আপিল বিভাগে হাজির করতে বলেন। হাজির হওয়ার আগেই ১১ ডিসেম্বর সুপ্রিমকোর্টের প্রস্তাবিত খসড়া বাংলাদেশ গেজেটে জারির প্রয়োজনীয়তা নেই মর্মে রাষ্ট্রপতির সানুগ্রহ সিদ্ধান্ত দিয়েছেন উল্লেখ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে আইন মন্ত্রণালয়। এর পর ১২ ডিসেম্বর শুনানিকালে আপিল বিভাগ রাষ্ট্রপতিকে ভুল বোঝানো হয়েছে উল্লেখ করে এ গেজেট জারির নির্দেশনা দেন। কিন্তু বিচারপতি এসকে সিনহা থাকাকালীন সরকারের পক্ষ থেকে দফায় দফায় শুধু সময়ই নেওয়া হয়েছে। আর শুনানিকালে বিচারপতি এসকে সিনহা বিভিন্ন মন্তব্য করে গেছেন। তবে এ গেজেট জারির বিষয়ে কোনো অগ্রগতি ছিল না।
শৃঙ্খলাবিধির খসড়া নিয়ে টানাপড়েনের মধ্যে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে ক্ষমতাসীনদের সমালোচনার মুখে বিচারপতি সিনহা হঠাৎ করেই ছুটি নিয়ে ১৩ অক্টোবর দেশ ছাড়েন। এর পর ১০ নভেম্বর সিঙ্গাপুরে বসেই পদত্যাগ করেন। গত ১৬ নভেম্বর ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞার বাসভবনে আপিল বিভাগের বিচারপতিদের সঙ্গে বৈঠক করে আইনমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ওই খসড়া নিয়ে মতপার্থক্য দূর হয়েছে। এর পর গতকাল এ বিষয়ে গেজেট জারি করে সরকার। সূত্র- আমাদের সময়
সম্পাদনা- ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম