দিনাজপুরের বীরগঞ্জে এসি ল্যান্ডের কক্ষে বসা নিয়ে বাগবিতণ্ডার জের ধরে সিনিয়র এক আইনজীবীকে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে সাজা দিয়েছেন বীরগঞ্জের এসি ল্যান্ড বিরোদা রানী রায়। ভুক্তভোগী আইনজীবীর নাম অ্যাডভোকেট নিরোদ বিহারী রায়।
গত মঙ্গলবার সকালে একটি নামজারির মামলায় শুনানি করতে গেলে তাঁকে ৫০০ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে এক দিনের করাদণ্ড দেওয়া হয়।
সাজা দেওয়ার সময় এসি ল্যান্ড তাঁর বক্তব্যে ‘আমি আমার ক্ষমতা দেখালাম, পারলে আপনি আপনার ক্ষমতা দেখান’ এমন উক্তি করেছেন বলে অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী সিনিয়র আইনজীবী নিরোদ বিহারী রায়। পরে জেলা আইনজীবী সমিতি বিষয়টি জেলা প্রশাসককে জানালে তাত্ক্ষণিকভাবে এসি ল্যান্ড বিরোদা রানী রায়কে কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলায় বদলি করা হয়।
এ ঘটনায় জেলা আইনজীবী সমিতি আজ বৃহস্পতিবার ও আগামী রবিবার দুই দিনের প্রতিবাদ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।
জানা গেছে, মো. সাহেব আলী নামের এক ব্যক্তির একটি জমির খারিজ আবেদনের (পুরাতন নাম বাতিল করা বা নামজারি) শুনানি ছিল গত মঙ্গলবার এসি ল্যান্ড অফিসে। সাহেব আলীর প্রতিপক্ষ হলেন মো. খায়রুল ইসলাম গং। সাহেব আলীর আইনজীবী হচ্ছেন নিরোদ বাহারী রায়। আর প্রতিপক্ষ খায়রুল ইসলাম গংয়ের আইনজীবী হলেন অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলাম ও শিক্ষানবিশ আইনজীবী মোহাম্মদ ওয়ারিস উল ইসলাম অলি।
আইনজীবী নিরোদ বিহারী রায়ের প্রতিপক্ষ আইনজীবী ওয়ারিস উল ইসলাম জানান, বীরগঞ্জ উপজেলার ভোগনগর ইউনিয়নের গোপালপুর মৌজার একটি জমির খারিজ বাতিলের মামলা চলমান রয়েছে।
সেই মামলার শুনানি ছিল মঙ্গলবার। সেদিন সকালে মামলার প্রার্থী মো. সাহেব আলীর পক্ষে শুনানিতে অংশগ্রহণের জন্য উপস্থিত হন নিরোদ বিহারী। শুনানির জন্য আগেই কক্ষে বসা ছিলেন ওয়ারিস উল ইসলাম ও তাঁর সিনিয়র। পরে আইনজীবী নিরোদ বিহারী যখন আসেন, তখন এসি ল্যান্ডের কক্ষে আরেকটি মামলার শুনানি চলছিল। ওই সময় নিরোদ বিহারী নিজের পরিচয় দিয়ে এসি ল্যান্ডের অনুমতিক্রমে ভেতরে প্রবেশ করে বসতে চান। তখন বিরোদা রানী রায় তাঁকে বাইরে যেতে বলেন। কিন্তু নিরোদ বিহারী নিজের পরিচয় দিয়ে বসার অনুমতি চান। তখন প্রতিপক্ষের আইনজীবী ওয়ারিস উল ইসলাম এসি ল্যান্ডকে বলেন, ‘ম্যাডাম, আমরা আইনজীবীরা তো এভাবেই বসে থাকি।’ এ কথা শুনে এসি ল্যান্ড বলেন, ‘আপনি চুপ থাকুন।’ তাতে চুপ হয়ে যান ওয়ারিস উল ইসলাম। তখন সিনিয়র আইনজীবী নিরোদ বিহারী এসি ল্যান্ডকে এমন ব্যবহার করছেন কেন জানতে চান। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে তর্ক বেধে যায়। তখন এসি ল্যান্ড নিজের ক্ষমতাবলে নিজ কক্ষে ভ্রাম্যমাণ আদালত ঘোষণা করেন এবং ভ্রাম্যমাণ আদালতের ১৮৬ ধারা অনুযায়ী আইনজীবীকে ৫০০ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে এক দিনের কারাদণ্ডের রায় দেন। এসব কারণে জমির ওই খারিজ আবেদনটির ওপর শুনানি হয়নি।
পরে ওয়ারিস উল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমি প্রতিপক্ষের অ্যাডভোকেট। কিন্তু এর পরও এসি ল্যান্ডের আচরণে রীতিমতো হতভম্ব হয়ে গেছি।’
আইনজীবী নিরোদ বিহারী বলেন, ‘আমি আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে জরিমানা দিয়ে মুক্ত হয়ে বিষয়টি দিনাজপুর জেলা আইনজীবী সমিতির নেতাদের জানাই। নেতারা তাত্ক্ষণিকভাবে বিষয়টি জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিম এমপি এবং জেলা প্রশাসক মো. মীর খায়রুল আলমকে মৌখিকভাবে অবহিত করেন।’
এ আইনজীবী আরো বলেন, ‘আমার প্রতি অন্যায় করা হয়েছে। আমি বিচার চেয়ে সমিতিতে আবেদন করেছি। এখন তারাই সিদ্ধান্ত নেবে পরবর্তী সময়ে কী হবে। ’
পরে জেলা আইনজীবী সমিতি পক্ষ থেকে দিনাজপুর জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে বিভাগীয় কমিশনারের কাছে অভিযোগ করা হয়। বিভাগীয় কমিশনার তাত্ক্ষণিকভাবে সহকারী কমিশনার (ভূমি) বিরোদা রানী রায়কে ভূরুঙ্গামারী উপজেলায় বদলি করে যোগদানের নির্দেশ দিয়েছেন।
এ ঘটনায় গতকাল বুধবার দুপুরে জরুরি বৈঠকে বসেন জেলা আইনজীবী সমিতির নেতারা। বৈঠক শেষে বিকেলে ঘটনার প্রতিবাদে আজ বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকে ১১টা পর্যন্ত প্রতীকী কর্মবিরতি এবং আগামী রবিবার ১১টায় মানববন্ধন কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে বলে জানান জেলা আইনজীবী সমিতির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মো. আনোয়ারুল আজীম খোকন।
এ ব্যাপারে বক্তব্য জানার জন্য একাধিকবার ফোন করা হয় এসি ল্যান্ড বিরোদা রানী রায়কে। তিনি ফোন রিসিভ করেননি। এ ব্যাপারে গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসক মীর খায়রুল আলমের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে প্রথমে তাঁর স্ত্রী ফোন ধরে ‘ব্যস্ত আছেন, আধাঘণ্টা পর ফোন করুন’ বলে রেখে দেন। পরে একাধিকার ফোন করা হলেও ডিসি ফোন রিসিভ করেননি। তবে তিনি জেলায় কর্মরত অন্য সাংবাদিকদের বলেন, ‘ভ্রাম্যমাণ আদালতের এই সাজায় যদি কেউ সংক্ষুব্ধ হয়ে থাকেন, তাহলে উনি উচ্চ আদালতে যেতে পারেন।’
এসি ল্যান্ডের বদলির ব্যাপারে তিনি বলেন, এটা নিয়মিত বদলি। আইনজীবীদের দাবির বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না।
প্রসঙ্গত, এর আগে লক্ষ্মীপুর জেলায় স্কুল গেটে বাগিবতণ্ডার জের ধরে সাবেক সিভিল সার্জনকে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে কারাদণ্ড দেন এক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক এডিসি। এ ঘটনায় চিকিত্সকদের মধ্যে তোলপাড় সৃষ্টি হলে ওই এডিসিকে ওএসডি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয়। পরে দুপক্ষের মধ্যে সমঝোতা হয়। এ ছাড়া হাইকোর্টে এ নিয়ে একটি রিট দায়ের করা হয়।
কালের কণ্ঠ