নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা অসাংবিধানিক ঘোষণার রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল সর্বোচ্চ আদালতে বিচারাধীন থাকাবস্থায় আইনটির প্রয়োগ নিয়ে আবারও প্রশ্ন তুলেছেন হাইকোর্ট।
লক্ষ্মীপুরের সাবেক সিভিল সার্জনের সঙ্গে এডিসির ‘হাতাহাতির’ ঘটনার পর সাজা দেওয়া ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ক্ষমতার অপব্যবহারের প্রকৃষ্ট উদাহরণ উল্লেখ করে হাইকোর্ট তার পর্যবেক্ষণে বলেছেন, ‘একটি সভ্য সমাজে সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এমন কর্মকাণ্ড সম্পূর্ণ অনভিপ্রেত। ইতিপূর্বেও দেখা গেছে, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটগণ ভ্রাম্যমাণ আদালতের (মোবাইল কোর্ট) জন্য প্রণীত আইন অমান্য করে নিজ ইচ্ছেমতো ক্ষমতার অপব্যবহার করে ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। এমনকি নিজেদের স্বার্থ ও ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য এ আইনটির অপব্যবহার হচ্ছে।’
আদালত তার আদেশে বলেন, লক্ষ্মীপুরের এডিসি (সার্বিক) শেখ মুর্শিদুল ইসলাম এবং মোবাইল কোর্ট পরিচালনাকারী সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ নুরুজ্জামানকে ভবিষ্যতে এমন কোনো পর্যায়ে যেন নিয়োগ না দেওয়া হয়, যেখানে ক্ষমতার অপব্যবহারের সুযোগ থাকে। জনপ্রশাসন, আইন ও স্বরাষ্ট্র সচিবকে উদ্দেশ করে এ আদেশ প্রদানসহ ওই পর্যবেক্ষণ দিয়ে এ বিষয়ে ইতিপূর্বে জারি করা রুলটি নিষ্পত্তি করা হয়। বিচারপতি কাজী রেজাউল হক ও বিচারপতি মোহাম্মদ উল্লাহর বেঞ্চ গতকাল বুধবার এ আদেশ দেন।
হাইকোর্ট তার পর্যবেক্ষণে আরও বলেন, ‘ভ্রাম্যমাণ আদালত রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে অতীব প্রয়োজন। কিন্তু এর অপব্যবহার কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এ আদালত আশা করে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার দায়িত্বে থাকা সরকারি কর্মকর্তাদের স্বীয় দায়িত্ব ভ্রাম্যমাণ আদালত আইন অনুযায়ী পালন করবেন।’ ঘটনাস্থলে না গিয়ে অফিসে বসেই ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করলে হবে না বলেও এ সময় আদালত মন্তব্য করেন।
সাবেক সিভিল সার্জনের ব্যাপারে আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ‘সিভিল সার্জন একজন অবসরপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। তার আচরণ অনেক বেশি সহনশীল, প্রহণযোগ্য পর্যায়ে থাকবে বলে আশা করি।’ এ বিষয়ে শুনানিকালে আদালত সিভিল সার্জন ও এডিসিকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আপনারা উচ্চশিক্ষিত লোক। সমাজ কী বলে, যখন দেখে ডাক্তার এবং এডিসি হাতাহাতি করে? এ লজ্জা কার? এটা আমাদের হতাশ করেছে। আশা করি ভবিষ্যতে এমনটি হবে না।’
গত ৪ ডিসেম্বর লক্ষ্মীপুর ডিসি কলোনির ভেতরে জেলা প্রশাসকের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত কাকলি শিশু অঙ্গন বিদ্যালয়ে প্রবেশকে কেন্দ্র করে সাবেক সিভিল সার্জন ডা. সালাহউদ্দিন শরীফ ও এডিসি শেখ মুর্শিদুল ইসলামের মধ্যে কথাকাটাকাটি এবং এক পর্যায়ে হাতাহাতি হয়। এ ঘটনায় ইউএনও ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে সালাহউদ্দিন শরীফকে ‘অসদাচরণের দায়ে’ তিন মাসের বিনাশ্রম কারাদ- দেন। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে লক্ষ্মীপুরের ঘটনার ওপর প্রকাশিত প্রতিবেদন যুক্ত করে ৫ ডিসেম্বর সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী কামাল হোসেন মিয়াজী এবং আশফাকুর রহমান একটি রিট দায়ের করেন। ওই রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট এডিসি ও ইউএনওকে তলবের পাশাপাশি গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের জেরে নির্বাহী কর্মকর্তার (নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের) ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রমের অপব্যবহার কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল দেন আদালত। একই সঙ্গে ডা. সালাউদ্দিনকেও আদালতে হাজির থাকতে বলা হয়।
ওই আদেশ অনুযায়ী গতকাল সকালে এডিসি এবং ইউএনও হাইকোর্টে হাজির হয়ে আইনজীবীর মাধ্যমে ঘটনার ব্যাখ্যা দিয়ে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেন। আদালতে এডিসির পক্ষে শুনানি করেন আবদুল বাসেত মজুমদার। আর ইউএনওর পক্ষে শুনানি করেন ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন। এ ছাড়া রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তাপস কুমার বিশ্বাস এবং রিটকারী আইনজীবী হাসান এম এস আজিম।
শুনানির এক পর্যায়ে আদালতে দেওয়া ঘটনার ব্যাখ্যায় এডিসি দাবি করেন, ডিসি কলোনির ভেতরে জেলা প্রশাসকের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত কাকলি শিশু অঙ্গন বিদ্যালয়ে পরীক্ষায় তিনি দায়িত্ব পালন করছিলেন। স্কুল কর্তৃপক্ষের আবেদনেই জেলা প্রশাসক সেদিন তাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। আদালত এ ব্যাখ্যা গ্রহণ না করে বলেন, প্রাথমিক একটি বেসরকারি বিদ্যালয়ে পরীক্ষা তদারকির জন্য একজন এডিসিকে নিযোগ করেন, যা আদালতের কাছে সম্পূর্ণরূপে মিথ্যা-বানোয়াটরূপে প্রতীয়মান হয়েছে। কোথাও কোনো বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নকল তদারকির জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলে কখনই দেখা যায়নি। তা ছাড়া কাকলি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি জেলা প্রশাসকের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত। পরীক্ষা তত্ত্বাবধানের জন্য বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষই যথেষ্ট। হাতাহাতির ঘটনায় সাবেক ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জনকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে সাজা দেওয়ার ঘটনাটি অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক নিজ স্বার্থে ব্যবহার করেছেন বলে উল্লেখ করেন আদালত।
আদালত বলেন, স্বীয় স্বার্থের কারণে ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক টেলিফোনে তাকে (সদর উপজেলার ইউএনওকে) তলব করেন। পরে তিনি ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে দণ্ডবিধি ১৮৬ ধারায় ডা. সালাহউদ্দিনকে অযৌক্তিক শাস্তি দেন। ফলে স্পষ্ট হয় যে, ঘটনা চলাকালে তিনি (ওই ম্যাজিস্ট্রেট) ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন না। তার সামনে ঘটনা ঘটেনি। এতে স্পষ্ট টেলিফোনের পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ঘটনাস্থলে উপস্থিত না থেকেই এবং তার (এডিসির) নির্দেশমতো ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে সালাহউদ্দিনকে শাস্তি দেন। ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনে ম্যাজিস্ট্রেটকে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে শাস্তি প্রদানের বিধান রয়েছে।
এর আগে শুনানির এক পর্যায়ে এডিসির ব্যাখ্যায় বিস্ময় প্রকাশ করে আদালত বলেন, ‘এটা প্রাইমারি স্কুল। যে স্কুলে প্রথম শ্রেণি থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা হবে। আর সেই পরীক্ষায় নকল ধরতে একজন এডিসিকে পাঠানো হয়েছে, কী চমৎকার! আগে বলেননি কেন? আগে বললে আপনাদের জন্য কামানসহ সেনাবাহিনী পাঠিয়ে দিতাম।’ এ ছাড়া এমন দায়িত্বে থেকে হাতাহাতির ঘটনাতেও বিস্ময় প্রকাশ করেন আদালত। পরে আদালত রুল নিষ্পত্তি করে দুই কর্মকর্তার ক্ষমার আবেদন মঞ্জুর করে আদেশ দেন।
এর আগে গত ১১ মে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার ধারাসহ ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনের ১১টি ধারা ও উপধারাকে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের অপর একটি বেঞ্চ রায় দেন। এ রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আপিল বিভাগ রায়টির কার্যকারিতা স্থগিত করে রেখেছেন। যার কারণে এখনো নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে মোবাইল কোর্ট চলছে। বর্তমানে রাষ্ট্রপক্ষের আপিলটি আপিল বিভাগে বিচারাধীন।
সুপ্রিমকোর্ট প্রতিনিধি/ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম