আইমান রহমান খান
প্রতিবছর ৫-৬ হাজার শিক্ষানবিশ আইনজীবী বার কাউন্সিলের সনদ পেলেও আদালত প্রাঙ্গণে তাদের অনুপস্থিতি চোখে পড়ার মত। কারন তাদের মধ্যে অধিকাংশই বিভিন্ন প্রাইভেট ল’ ফার্ম বা চেম্বারে ফিক্সড স্যালারির চাকরি করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। তবে কি কারনে এমন রীতির উপক্রম? কোর্ট প্রাকটিস বাদ দিয়ে একজন আইনজীবীর এমন ডেস্ক জব করাটা কতটুকু যুক্তিসম্মত? এই প্রশ্নের জবাব পেতে সমস্যার উৎপত্তি খোঁজা জরুরি।
আইন পড়া ও তারপর
একজন আইনের ছাত্র তার এল এল বি ডিগ্রীর চার বছরে প্রতি দেড় মাস পর পর মিড আর ফাইনাল দিয়েই শেষমেষ একটি সার্টিফিকেট অর্জন করে। শত পরিস্রম আর অর্থ ব্যয় করে তার স্নাতক সম্পন্ন হলেও আইনপেশায় তা মাত্র প্রথম ধাপ বলে ধরা হয়। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে না ফেলতেই আরো একটি বড় পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয় তাকে। পরিক্ষার নাম বার কাউন্সিল এর এডভোকেট তালিকাভুক্তকরণ পরিক্ষা। তিন ধাপের এই পরিক্ষায় পাশ করলেই একজন নিম্ন আদালতে তার আইনপেশা আরম্ভ করতে পারে।
তবে এই পেশার শুরুটা লিখিত বর্ণনায় যতটুক সহজ, বাস্তবে তা ততটাই জটিল। বার কাউন্সিলের সনদ তার আদালতে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করলেও তার উপার্জনের উৎস দ্বিধান্বিত থেকে যায়। ফলে তাকে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হয়।
সমাজে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করতেই সে নেমে পড়ে সিনিয়র এডভোকেটের খোঁজে। একজন সিনিয়রের হাত ধরেই আইনপেশার যাত্রা শুরু করে একজন নবীন আইনজীবী। শুরু হয় কঠোর অনুশীলন। সিনিয়রের প্রতিনিধি হয়ে এই কোর্ট থেকে ওই কোর্ট ছোটাছুটি, কেস নাম্বার জানা আর মামলা ফাইলিং এ সারাদিন চলে যায়। কপাল খুব ভাল হলে সিনিয়র এডভোকেট সম্মানী সরুপ হাত খরচ প্রদান করে। সেটাও তার মামলা জিতার উপর নির্ভরশীল। যা একটু হাত খরচ পাওয়া যায়, কোর্টে যাতায়াতে খরচ হয়ে যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দুপুরের খাবারের টাকা টাও নিজেকেই ভরতে হয়।
বাস্তুব পরিস্থিতি
একজন সদ্য সনদপ্রাপ্ত আইনজীবী আক্ষরিক অর্থে স্বাবলম্বী হলেও প্রথম কয়েকবছর তার অভিভাবকের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয়। এদের মধ্যে যদিও একটি সংখ্যাধিক অংশ বিভিন্ন জেলার অধিবাসী, তবে প্রাকটিসের জন্য ঢাকাস্থ জজ কোর্টকেই বেছে নেয়। ফলে ঢাকায় বসবাসের জন্য যাবতীয় খরচ বহন করতে হয় তাদের বাবা মা কে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমেস্টার ফি, ঢাকায় চার বছরে প্রতি মাসের হাত খরচ দেওয়ার পরও, একজন আইনজীবীর বাবা মাকে আরো কিছু দূর আর্থিক সহায়তা চালিয়ে যেতে হয়।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, কোর্টে ‘ফিক্সড স্যালারি’ বলে কিছু নেই। বলা বাহুল্য, একজন আইনজীবীর রোজগার তার অভিজ্ঞতা দ্বারা বৃদ্ধি পায়। তবে এই অভিজ্ঞতা অর্জনে এক-দুই বছরে না, লেগে যেতে পারে ১০ থেকে ১৫টি বছর। এই লম্বা অপেক্ষা কাউকে করে ফেলে হতাশাগ্রস্ত এবং অনুপ্রেরণার অভাবে উপার্জনের অন্যান্য পথ বেছে নেয়।
এই সমস্যার সমাধান?
সম্প্রতি ভারতীয় বার কাউন্সিল একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেয়। প্রত্যেক নবীন আইনজীবীদের মাসে ৫০০০ টাকা বেতন হিসেবে প্রদান করা হবে। ৫ বছর মেয়াদী এই ভাতা দেওয়া হবে সদ্য সনদপ্রাপ্ত আইনজীবীদের যা তাদের কে এই পেশায় আরো অনুপ্রেরিত করবে। এমন উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়।
বাংলাদেশে এমন কিছু শুরু করাটা সময়ের দাবি। কেনো না, অনেকেই এমন অনিশ্চিত উপার্জনের পরিস্থিতি দেখে সামনে পা বাড়াতে সাহস পাচ্ছেনা। ল’ চেম্বার যোগ দেয়ার পিছনে এটাই হয়তো তাদের প্রধান কারন।
নতুনদের কোর্টে আসতে উৎসাহিত করার জন্য বার কাউন্সিল বিভিন্ন ক্যাম্পেইন করতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় গুলো তে ছাত্রদের নিয়মিত ‘কোর্ট-ভিজিট’ করার বিধান চালু করতে হবে। এবং একমাত্র বার কাউন্সিলই পারে এমন বিধান বাধ্যতামূলক করতে।
উল্লেখ্য, কয়েক মাস আগে বার এসোসিয়েশন গুলো একটি সুবিবেচক সিদ্ধান্ত নেয়। সকল শিক্ষানবিশদের কে প্রদান করা হয় আইডি কার্ড এবং টাই। মূলত কোর্ট প্রাঙ্গণে টাউট প্রতিরোধ এবং শিক্ষানবিশদের হেনস্থা হওয়া থেকে রক্ষা করাই এটার মূল উদ্দেশ্য ছিল। তবে একটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এমন সিদ্ধান্ত আসলে শিক্ষানবিশদের একটি আলাদা মর্যাদা দিয়েছে।
এটি সত্যিই একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা। পরিবর্তনশীল যুগের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশ বার কাউন্সিল এমন আরো পদক্ষেপ নিবে এমনটাই সবাই আশা করছে।
প্রাইভেট ল’ চেম্বারে কাজ করায় নিরুৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে বলছিনা, তবে যেমন হরিণ সুন্দর চোখে, তেমনি আইনজীবী সুন্দর কোর্টে। যোগ্য আইনজীবী গড়ার কারখানা একমাত্র আদালত যার প্রধান ফটক পেরুতেই এক অপার সম্ভাবনার দেখা মিলে। একটি চেম্বারের স্যালারি যেখানে কিছু হাজার টাকায় সীমাবদ্ধ, সেখানে ফুল টাইম প্রাকটিসে একজন অভিজ্ঞ আইনজীবীর আয় প্রায় সীমাহীন বলা যেতে পারে। সুতরাং বাংলাদেশ বার কাউন্সিল অভিভাবক হিসেবে নবীন আইনজীবীকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের ভাতা প্রদান করতে পারে যাতে তার আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায়।
লেখক : শিক্ষানবিশ আইনজীবী, ঢাকা জজ কোর্ট