ড. কামাল হোসেন। খ্যাতিমান এই আন্তর্জাতিক আইনজ্ঞ বাংলাদেশের রাজনীতিতেও রেখেছেন অমূল্য ভূমিকা। ছিলেন বঙ্গবন্ধু সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তার নেতৃত্বে তৈরি হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান। এই প্রধান দুই কাজের বাইরে মানবাধিকার নিয়েও উচ্চকিত ড. কামাল হোসেন। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, সংবিধান সংশোধনসহ সাম্প্রতিক নানা ইস্যুতে প্রথম আলোতে প্রকাশিত এই সংবিধান প্রণেতার সাক্ষাৎকারটি ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হল।
২০১৭ সালের ঘটনাবলির আলোকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
ড. কামাল হোসেন: প্রথমেই বলতে হয় যে সরকার ২০১১ সালে সংবিধানের ১৫তম সংশোধনী করেছিল। আর সেখানে যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাদ দেওয়া হলো, সেটা থেকে আপনার প্রশ্নকে আলাদা করা যাবে না। কারণ, ওই সংশোধনীতে পরিষ্কার ফুটে উঠল যে ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের জন্য যত রকম উপায় ছিল, সেটা তারা ব্যবহার করবে। ওই রকম আকাঙ্ক্ষা থেকেই পরবর্তী পদক্ষেপগুলো নেওয়া হলো। ওই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মনোভাব থেকেই তারা নিজেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার থেকে মুক্ত করেছিল। অথচ ওই ব্যবস্থা ছিল জনগণের দীর্ঘ সংগ্রামের অর্জন। এমনকি সেই অর্জনে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদেরই বিরাট ত্যাগ-তিতিক্ষার ইতিহাস রয়েছে। পরিহাস হলো, ২০০৬ সালে বিএনপি ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার পরেও আওয়ামী লীগ এক-এগারোতে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিল। এ বিষয়ে তাদের শয়ে শয়ে বিবৃতি পাওয়া যাবে। এরপর তারা আকস্মিকভাবে অবস্থান নিল যে এই ব্যবস্থাটাই অগণতান্ত্রিক। এ রকম একটি পদক্ষেপ নিতে গিয়ে তারা জনমত যাচাই করার দরকার মনে করেনি।
কিন্তু বিচার বিভাগ তো সহায়তা দিয়েছিল…
ড. কামাল হোসেন: আমি তো একজন সাবেক প্রধান বিচারপতির (এ বি এম খায়রুল হক) ব্যক্তিগত ভূমিকার দিকেই বিশেষভাবে নজর দিতে বলব। কারণ, তাঁর একক ভূমিকার কারণে মনে হয়েছে যে সরকার যেভাবে চেয়েছে, সেভাবে বিষয়টি হাজির করতে তিনি অভাবনীয় একটা ভূমিকা পালন করেছেন। জনগণের অসামান্য অর্জনকে জলাঞ্জলি দিতে তাঁকে আমরা কতগুলো খোঁড়া যুক্তি ব্যবহার করতে দেখেছিলাম।
এরপর এসেছে ষোড়শ সংশোধনী, যাতে…
ড. কামাল হোসেন: এর আগে যখন তারা সংবিধানে হাত দিয়েছিল, তখনো সেটা করার অধিকার তাদের ছিল না। ষোড়শ সংশোধনীতেও ছিল না। কারণ, জনগণ তাদের সেই সব পরিবর্তন আনার ম্যান্ডেট দেয়নি। যদিও ২০১১ সালে তারা নির্বাচিত-অনির্বাচিত বিষয়ে কথা তুলেছিল। এরপর একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে যখন তারা সম্পূর্ণরূপে অনির্বাচিত সরকারে পরিণত হলো, তখন তারা পাস করল সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী। আমি মনে করি, যে প্রক্রিয়ায় তারা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব করতে সংবিধানে পরিবর্তন এনেছে, তা করতে আদৌ তাদের অধিকার ছিল না।
এখন রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগের রায়ের পুনর্বিবেচনা চেয়ে আবেদন দাখিল করেছে।
ড. কামাল হোসেন: রিভিউ কী করে হতে পারে? আপিল বিভাগের সাত সদস্যের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এবং নয়জন অ্যামিকাস কিউরি সর্বসম্মতভাবে যে সিদ্ধান্তে এসেছেন, তা বদলে দেওয়াটা আশা করা সংগত বলে বিবেচ্য হতে পারে কী করে?
এ জন্য তাঁরা নির্দিষ্টভাবে ৯৬টি কারণ দেখিয়েছেন।
ড. কামাল হোসেন: এতগুলো কারণ দেখানো স্বাভাবিক নয়। এর যাঁরা মুসাবিদা করেছেন, অনেকেই কিন্তু তাঁদের বিচারবুদ্ধির সুস্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন। সাধারণত, আপিল বিভাগের রায়ে দু-একটি বড় গ্রাউন্ডস থাকতে হয়, যাতে রিভিউর জন্য শুনানির অপরিহার্যতা সহজেই প্রতীয়মান হয়। এতগুলো গ্রাউন্ডস দেখিয়ে কোনো দিন রিভিউ হয় নাকি? আমার ৫৮ বছরের পেশাগত জীবনে এমনটা কখনো শুনেছি বলেও তো মনে পড়ে না।
রাষ্ট্রপক্ষ প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার পুরো পর্যবেক্ষণ এক্সপাঞ্জসহ গোটা রায়টাই বাতিল চেয়েছে। তারা বলেছে, তারা বাহাত্তরের মূল সংবিধানের বিধানই ফিরিয়ে এনেছে, তাই তা মৌলিক কাঠামোবিরোধী হতে পারে না।
ড. কামাল হোসেন: তাহলে দেখা যাচ্ছে, দেশের সর্বোচ্চ আদালতের সাত বিচারপতির সিদ্ধান্ত নেওয়াটা ভুল। নয়জন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর দেওয়া অভিমত ভুল। শুধু রিভিউ যাঁরা লিখেছেন, তাঁরাই অভ্রান্ত। তাঁরাই যেন শুধু সংবিধানের প্রকৃত মৌলিক কাঠামো অনুধাবন করতে পেরেছেন।
অধস্তন আদালতের বিচারকদের জন্য শৃঙ্খলাবিধি অবশেষে সরকার প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশ করেছে।
ড. কামাল হোসেন: এটা আমি মনে করি সব থেকে অগ্রহণযোগ্য কাজ হয়েছে। এক শতাব্দীর বেশি সময় ধরে এই উপমহাদেশের রাজনীতিতে ঐকমত্য তৈরি হয়েছে যে নিম্ন আদালতের বিচারকদের ওপর সব ধরনের নিয়ন্ত্রণ কেবল সুপ্রিম কোর্টের কাছে ন্যস্ত থাকবে। ১৯৭২ সালের সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে সুপ্রিম কোর্টের কাছে তা ন্যস্ত থাকার বিধান আমরা তো সেই ঐতিহাসিক পরম্পরা রক্ষা করে যুক্ত করেছিলাম। এখন তাতে এত অরুচি কেন! ১৯২১-২২ সালের দিকে বেঙ্গল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলিতে আমাদেরই মৌলভি এ কে ফজলুল হক, একজন তরুণ বিধায়ক হিসেবে সরকার থেকে বিচার বিভাগ পৃথক্করণের দাবিতে সোচ্চার হয়েছিলেন। তিনি শাসকদের উদ্দেশে বলেছিলেন, তোমরা নিজেদের বেলায় বিচার বিভাগ আলাদা করো, আর আমাদের বেলায় নিয়ন্ত্রণ করো, তোমরা মোনাফেক। এরপর আমরা তা চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনকালীন একুশ দফায় যুক্ত করেছিলাম। সুতরাং, এসব ইতিহাসকে পেছনে রেখে আজ তো নতুন নতুন কথাবার্তা কানে আসছে। প্রায় ১০০ বছর পরে এসে সরকার যা বলছে, তাতে অন্যথা দেখতে পাচ্ছি।
রাষ্ট্র বিচারক অপসারণসংক্রান্ত ৯৬ অনুচ্ছেদ প্রশ্নে সামরিক ফরমান অবৈধ বিবেচনায় বাহাত্তরে ফিরছে। আবার ১১৬ অনুচ্ছেদে চতুর্থ ও পঞ্চম সংশোধনীতে আনা পরিবর্তন দুটোই আঁকড়ে ধরছে। যুক্তি উঠছে, বিদ্যমান দ্বৈত শাসনই নাকি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য?
ড. কামাল হোসেন: যাঁরা দাবি করছেন যে বিদ্যমান ১১৬ অনুচ্ছেদটিই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য, তাহলে সেটা কীভাবে যাচাই করা হলো? মানদণ্ড কী, সেটাও তো বলতে হবে।
বিচারপতি সিনহা লেখেননি, এর আগে আপিল বিভাগের আরও তিনটি রায়ে বলা আছে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সার্থক করতে বাহাত্তরের ১১৬ অনুচ্ছেদে ফিরতে হবে।
ড. কামাল হোসেন: আমি এর সঙ্গে একমত।
মামলার জট ক্রমে বাড়ছে। প্রায় তিন বছর ধরে সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগ বন্ধ রয়েছে।
ড. কামাল হোসেন: বিচারকের সংখ্যা বাড়ানো অন্যতম উপায়। কিন্তু অন্য আরও অনেক বিকল্প রয়েছে, সেগুলো খতিয়ে দেখা যেতে পারে।
প্রধান বিচারপতির পদ শূন্য রাখার বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
ড. কামাল হোসেন: এটা খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত, এভাবে তো চলতেই পারে না। অনির্দিষ্টকালের জন্য প্রধান বিচারপতির পদ শূন্য রাখা যেকোনো গণতান্ত্রিক সমাজে অভাবনীয়। একজন প্রধান বিচারপতি সংবিধানের আওতায় যত ধরনের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পাদন করতে পারেন, সেটা একজন অস্থায়ী প্রধান বিচারপতির পারার কথা নয়।
প্রধান বিচারপতির পদ খালি রেখেই ২ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্ট দিবস পালন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
ড. কামাল হোসেন: এটা তো হতে পারে না। সংবিধানে হাত দেওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু প্রথমেই সুপ্রিম কোর্ট প্রতিষ্ঠায় মনোযোগী হয়েছিলেন। আমরা দ্রুত মনস্থির করেছিলাম যে উচ্চ আদালত সব সময় ক্রিয়াশীল থাকবেন, এখানে তো কোনো শূন্যতা রাখা যাবে না। যত দূর মনে পড়ে, হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠাসংক্রান্ত আদেশটাই ছিল প্রথম বা একেবারে শুরুর দিকের আইন।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সুরক্ষায় সমাজের অন্যদের ভূমিকা ও করণীয় সম্পর্কে আপনার মত কী?
ড. কামাল হোসেন: আইনজীবী, গণমাধ্যম এবং নাগরিক সমাজ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন।
সর্বশেষ মন্তব্য?
ড. কামাল হোসেন: প্রথমত, এই সরকারের কোনো রকম ক্ষমতা নেই সংবিধানে হাত দেওয়ার। সরকার চালানোর ব্যাপারেও তাদের সীমাবদ্ধতা যেটা আছে, সেটা স্মরণ রাখতে হবে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন করার বিষয়ে তারা নিজেরাই বলেছিল, সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য আমরা এটা করছি। দ্রুত আমরা নিয়মতান্ত্রিক নির্বাচন দেব। এরপর তারা সাড়ে তিন বছর চালিয়েছে, যা সরাসরি অসাংবিধানিক। সুতরাং, তাদের বৈধতার প্রশ্ন প্রথমেই এসে যায়। তাই প্রশ্ন ওঠে, সংবিধানে হাত দেওয়ার তারা কে? জনগণ তাদের ভোট দেওয়ার সুযোগ পায়নি, তাহলে তাদের ম্যান্ডেট দিয়েছে কে?