জাহিদ হোসেন :
সাম্প্রতিক সময়ে যে কোনো ব্যক্তির মনে হঠাৎ গুম বা অজ্ঞাত পরিচয়ে গ্রেফতার হওয়ার আশঙ্কা থাকাটা স্বাভাবিক।
এরই মধ্যে অনেকে গুম কিংবা বা গ্রেফতারের নামে নিরুদ্দেশ হয়েছেন। পরে তাদের ব্যাপারে আর কিছুই জানা যায়নি। এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানানোর পরও তারা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কোনো খোঁজ দিতে পারেনি।
বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম থেকে জানা যায়, মূলত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নামেই কোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতার বা আটক করে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর সেই ব্যক্তির আর কোনো খোঁজ-খবর পাওয়া যায় না। সংশ্লিষ্ট থানা বা নিকটস্থ প্রশাসনের সাহায্য নিতে গেলে তারাও এর কোনো দায়ভার স্বীকার করে না। কখনো হয়তো নিরুদ্দেশ ব্যক্তির মৃত দেহ পাওয়া যায় কখনো বা তাও মেলে না। বছর দুই এক আগেও ঢাকা থেকে গুম হওয়া তিনজনের হাত-পা বাঁধা লাশ উদ্ধার করা হয়। যাদের প্রথমে গ্রেফতারের নামে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বলে জানা যায়।
আমদের দেশে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো পুলিশ অফিসার ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ বা ওয়ারেন্ট ছাড়াই কোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতার করতে পারবে। অর্থাৎ পুলিশ কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সন্দেহ হলেই যে কোন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে আটকে রাখতে পারবে। এই ধারা পুলিশকে স্বেচ্ছাচারিতা করার সুযোগ দিয়েছে। ইচ্ছা মতো যাকে তাকে যখন তখন পুলিশ সন্দেহ করতে পারে। এর জন্য পুলিশকে কোনো জবাবদিহিও করতে হয় না। আমরা সাধারণ নাগরিক যেন এই ক্ষেত্রে তাদের কাছে অসহায়। যেন স্বাধীন দেশে থেকেও পরাধীনতার শৃঙ্খলে বন্দী আমরা। এই ধারায় পুলিশের ক্ষমতার অপব্যবহারকে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন বহু আগে থেকেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রধান উৎস হিসেবে চিহ্নিত করে আসছে।
উল্লেখ্য, বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে ম্যাজিস্ট্রেটের ওয়ারেন্ট ছাড়া কোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতার করার নিয়ম নেই। তাছাড়া ওয়ারেন্ট ছাড়া গ্রেফতার ক্রিমিনাল জুরিস্প্রুড্যান্সও সমর্থন করে না।
৫৪ ধারায় আটক ব্যক্তি প্রায়ই মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকেন। যার প্রমাণ আমরা কম বেশি দেখে আসছি। এমন কি পুলিশ হেফাজতে অনেক বন্ধীর মৃত্যুর কারণও এই ধারায় প্রদত্ত অসীম ক্ষমতা। এই ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতার অপব্যবহার জনগণের জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতাকে ব্যাহত করে যা সরাসরি আমাদের সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। তাছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রে ৫৪ ধারায় গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ ছাড়াই মামলায় জড়িয়ে দেওয়া হয় যা অধিকাংশ ক্ষেত্রে অমানবিক ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে থাকে।
সন্দেহের বশবর্তী হয়ে গ্রেফতারের এই নিয়ম নিয়ে এরই মধ্যে আমাদের দেশে অনেকবার সমালোচনার ঝড় উঠেছে। অনেক আগে থেকেই এই ধারা বাতিলের দাবীতে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন, আইনজীবী, শিক্ষক ও সচেতন নাগরিকরা জোর দাবি জানিয়ে এলেও কোনো সরকার এই ধারা বাতিল কিংবা সংশোধন করার উদ্যোগ নেয়নি। মাঝে মধ্যে মন্ত্রীরা নানা আশার কথা শোনালেও তারা বাস্তবে বিরোধী দলকে দমন ও অপছন্দের ব্যক্তিদের শায়েস্তা করতে এই ধারা ব্যবহার করেছেন।
১৯৯৮ সালে ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী এলাকা থেকে বেসরকারি ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্র শামীম রেজা রুবেলকে এই ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ওই বছরের ২৩ জুলাই মিন্টো রোডের গোয়েন্দা পুলিশ কার্যালয়ে রুবেল মারা যান। ওই ঘটনায় মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ও ১৬৭ ধারা সংশোধন চেয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদন করে। ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল ওই রিট আবেদনের রায়ে হাইকোর্ট কয়েকটি সুপারিশসহ সিআরপিসির ৫৪ ও ১৬৭ ধারা সংশোধনের নির্দেশ দেন। আর যতদিন আইন সংশোধন না হচ্ছে, ততদিন পুলিশকে তা মেনে চলার জন্য কয়েকটি অন্তবর্তী নির্দেশনাও দেন।
যাহোক, ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারার অধীনে পুলিশের আটক সংক্রান্ত এই ব্যাপারে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগ BALST Vs. BANGLADESH (55 DLR 363) মামলায় সরকারকে যে আটটি নির্দেশনা মেনে চলার সুপারিশ করে তা হলো-
১.বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪ সালের তিন ধারার অধীনে কোনো ব্যক্তিকে আটক করার জন্য পুলিশ কর্মকর্তা ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করতে পারবে না। ২. গ্রেফতারের সময় একজন পুলিশ কর্মকর্তা পরিচয় প্রদান করবে এবং যদি প্রয়োজন হয়, তবে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে ও উপস্থিত সবাইকে তার পরিচয়পত্র (ID Card) প্রদর্শন করবে। ৩. গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে থানায় আনার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ কর্মকর্তা তাকে গ্রেফতারের কারণ নথিভুক্ত করবে এবং আনুষঙ্গিক তথ্য যেমন, আমলযোগ্য অপরাধে ওই ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে তার নিজের জ্ঞান, অপরাধের প্রকৃতি, যে পরিস্থিতিতে তাকে গ্রেফতার করা হলো, তথ্যের উৎস, ওই তথ্য বিশ্বাস করার কারণ, যেখান থেকে গ্রেফতার করা হয় সে জায়গার বর্ণনা, গ্রেফতারের তারিখ ও সময় সংক্রান্ত তথ্য সংরক্ষণ, ওই ব্যক্তির নাম ও ঠিকানা এবং এই উদ্দেশের জন্য থানায় রক্ষিত সাধারণ ডায়েরিতে (GD) তা উপস্থাপন করতে হবে। ৪. গ্রেফতারের সময় গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেলে পুলিশ কর্মকর্তা তা রেকর্ড করে রাখবেন এবং ওই ব্যক্তিকে নিকটস্থ হাসপাতালে বা সরকারি চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাবেন এবং ওই আঘাতের কারণে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার সার্টিফিকেটও সংগ্রহ করবেন। ৫. গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে থানায় চালানের তিন ঘণ্টার মধ্যে তাকে গ্রফতারের কারণ জানাতে হবে। ৬. যদি কোনো ব্যক্তিকে তার বাড়ি বা অফিস থেকে গ্রেফতার করা না হয়, তাহলে তাকে গ্রেফতারের এক ঘণ্টার মধ্যে তার কোনো আত্মীয়কে টেলিফোনে বা বার্তাবাহকের মাধ্যমে জানাতে হবে। ৭. গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে তার পছন্দের আইনজীবী বা তার ইচ্ছানুযায়ী কোনো আত্মীয়ের সঙ্গে দেখা করতে দিতে হবে। ৮. গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে নিকটবর্তী ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হাজির করতে হবে এবং তখন পুলিশ কর্মকর্তাকে নির্দিষ্ট আবেদন পত্রে উল্লেখ করতে হবে, কেন তদন্ত ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সম্পন্ন হয়নি, কেন তিনি মনে করেন যে তার অভিযোগের বা তথ্যের সুস্পষ্ট ভিত্তিমূল রয়েছে-যদি এমন অবস্থার প্রয়োজন পড়ে। এই মামলার প্রাসঙ্গিক তথ্যের অন্তর্ভূক্তির কপি মামালার ডায়েরির BP from No.38 একই ম্যাজিস্ট্রেটকে হস্তান্তর করতে হবে।
গত বছর ২৪ মে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের ৪ বিচারপতির বেঞ্চ ২০০৩ সালে হাইকোর্ট বিভাগের দেয়া ঐ রায় বহাল রেখে সরকারের আবেদন খারিজ করে দেয়। এর ফলে ধারা দুটি নিয়ে হাইকোর্টের দেয়া নির্দেশনা মানতে সরকার এখন বাধ্য।
এছাড়া ভুয়া পরোয়ানা দেখিয়ে আটক বন্ধে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না জানতে চেয়ে ২০১৩ সালের ৩০ জানুয়ারিতে সরকারের প্রতি হাইকোর্টের তিন সপ্তাহের একটা রুলও জারি হয়।
কিন্তু হাইকোর্টের এই সব নির্দেশনা যদি পুলিশ সঠিকভাবে মেনে চলতো তাহলে গ্রেফতারের সময় সাধারণ নাগরিকদের এতো দুর্ভোগ পোহাতে হতোনা। মানুষেরও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর অনেক আস্থা থাকতো। অন্য কেউ পুলিশ, গোয়েন্দা (ডিবি) বা র্যাব পরিচয় দিয়ে সহজে কোনো সাধারণ নাগরিককে গুম বা গ্রেফতার করার সুযোগ পেতো না। আর এই ব্যাপারে আমাদেরও সচেতন হতে হবে। আশেপাশের পরিচিত কেউ অজ্ঞাত কারণে গ্রেফতার হলে দেখতে হবে, কে বা কারা গ্রেফতার করছে বা তাকে গ্রেফতারের নামে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আশা করি, হাইকোর্টের দেওয়া গ্রেফতার সম্পর্কিত এই সব নির্দেশনা পুলিশ সঠিকভাবে পালন করলে দেশে গুম বা গুপ্ত হত্যা কিংবা অবৈধ গ্রেফতারের মতো ঘটনা অনেকাংশে হ্রাস পাবে।
লেখক: আইন বিষয়ক লেখক ও অধিকার কর্মী।
zahidhossainlaw@gmail.com