ষাটের দশকে সবুজ বিপ্লবের পর বাংলাদেশের মুসলমানদের বিয়েতে দেনা-পাওনার শর্তও পরিবর্তন হয়েছে। ধীরে ধীরে দেনমোহর বেড়েছে, যা বিয়েবিচ্ছেদ রোধে এক ধরনের প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। অন্যদিকে যৌতুকের পরিমাণ কমেছে। দেশের স্বাধীনতার পর এসব ক্ষেত্রে আরও ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে।
অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী দুই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও ভারতের পরিসংখ্যান ইনস্টিটিউটের এক কর্মকর্তার প্রতিনিধির যৌথ গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সম্মেলন কক্ষে গতকাল বুধবার (৩ জানুয়ারি) এ গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন গবেষক দলের প্রধান অস্ট্রেলিয়ার সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক শ্যামল চৌধুরী।
শ্যামল চৌধুরী বলেন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের মানুষের মানসিক কিছু পরিবর্তন আসে। এর একটি হলো বিয়েতে যৌতুক না নেওয়া। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের পর এতে আরও বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। মূলত এই দুই কারণেই বাংলাদেশে যৌতুকের হার কমে আসে। সেইসঙ্গে কৃষিতে সবুজ বিপ্লব ও নারীদের অর্থনৈতিক উন্নয়নও যৌতুক হ্রাস এবং দেনমোহর বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ।
গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৫০ থেকে ১৯৬০ সালে গ্রামাঞ্চলে গড় যৌতুকের হার ছিল এখনকার টাকার মূল্যে ৫৪ হাজার টাকা। ১৯৬০ থেকে ১৯৭০ সালে ওই হার ছিল ৫৮ হাজার টাকা। বর্তমানে তা ২৫ হাজার টাকায় নেমে এসেছে। অপরদিকে ষাটের দশক থেকে ধীরে ধীরে দেনমোহরের পরিমাণ বেড়েছে। ১৯৫০ থেকে ১৯৬০ সাল ওই দশ বছরে গ্রামাঞ্চলে যেসব নারীর বিয়ে হয়েছিল, তাদের গড় দেনমোহর এখনকার টাকার মূল্যে ছিল ১৮ হাজার টাকা। ১৯৬১ থেকে ১৯৭০ সময়ে গড় দেনমোহর বেড়ে ৫৭ হাজার টাকায় উন্নীত হয়েছে। ১৯৭৫ থেকে ২০১০ সময়কালে প্রতি নারীর গড় দেনমোহর বেড়ে ৬০ হাজার টাকা হয়েছে।
গবেষণায় বলা হয়, ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনের কারণে বিয়েতে নারীদের দেনমোহর বেড়েছে বলা হয়। কিন্তু এই যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়। বরং ষাটের দশক থেকে শুরু হওয়া কৃষিতে সবুজ বিপ্লবের কারণে নারীদের ক্ষমতায়ন হতে শুরু করে। তখন থেকে মেয়েরা কর্মক্ষেত্রে যেতে শুরু করে। তাদের চাহিদা বাড়তে থাকে কর্মক্ষেত্রে। মজুরিও বাড়তে থেকে। আর এর প্রভাব পড়ে বিয়ের বাজারে। মুসলিম পারিবারিক আইনের কারণে যে দেনমোহরের পরিমাণ বাড়েনি; তার প্রমাণ মিলেছে পশ্চিমবঙ্গেও। সেখানে এক হাজার পরিবারের সাক্ষাৎকার নিয়ে দেখা গেছে, কৃষিতে সবুজ বিপ্লবের কারণে নারীদের ক্ষমতায়ন ও কর্মক্ষেত্রে যুক্ত হওয়ার কারণে দেনমোহরের হার বেড়েছে।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বিআইডিএসের মহাপরিচালক কে এ এস মুরশিদ বলেন, এ ধরনের গবেষণার প্রয়োজন আছে। এর মধ্যদিয়ে সামাজিক পরিবর্তনের চিত্র পাওয়া যায়। অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক পরিবর্তন এসেছে। নারীরা বিভিন্ন আয়বর্ধক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ায় যৌতুকের হার কমে গেছে। সেইসঙ্গে বেড়েছে দেনমোহর। ১৯৮০ সালে করা যৌতুকবিরোধী আইনও কিছুটা প্রভাব ফেলেছে।
অস্ট্রেলিয়ার ডেকিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক দেবদুলাল মল্লিক এবং ভারতের পরিসংখ্যান ইনস্টিটিউটের প্রতিনিধি প্রবাল রায় চৌধুরী গবেষণায় শ্যামল চৌধুরীকে সহযোগিতা করেন।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত বিআইডিএসের অন্যান্য গবেষক এ গবেষণার তথ্য-উপাত্ত ও পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। বিয়েবিচ্ছেদ নিয়ে প্রতিবেদনে আলোচনা করা হলেও এটি বাংলাদেশে কী হারে হচ্ছে বা হয়েছে তার কোনো তথ্য নেই।
নিজস্ব প্রতিনিধি/ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম