দ্বিতীয় বিয়ে গোপন করতে নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করে স্ত্রী মরিয়ম আক্তারকে গ্রেপ্তার করানোর অভিযোগ উঠেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে। তিন সপ্তাহ কারাভোগের পর সপ্তাহখানেক আগে মরিয়ম জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। নতুন করে তাঁকে মামলায় জড়ানোর চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছে মরিয়মের পরিবার।
জানা গেছে, ব্যাংক কর্মকর্তা মরিয়ম আক্তারকে গত বছরের জুলাই মাসে বিয়ে করেন মিজানুর রহমান। ২০১৯ সাল পর্যন্ত সেই কথাটি গোপন রাখার শর্ত দিয়েছিলেন স্ত্রীকে। মরিয়ম রাজি হননি। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি গত ১২ ডিসেম্বর পুলিশ পাঠিয়ে মরিয়মকে গ্রেপ্তার করান। মিজানুর রহমান ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার ছিলেন, সিলেট মহানগর পুলিশের কমিশনার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
মরিয়মের মা কুইন তালুকদার গণমাধ্যমকে বলেন, মিজানুর রহমান একাধারে বগুড়া, রমনা ও মোহাম্মদপুর থানা-পুলিশকে ব্যবহার করেছেন তাঁদের শায়েস্তা করার কাজে। তা ছাড়া লালমাটিয়ার যে বাসায় মরিয়ম, তাঁর মা ও ভাইকে নিয়ে গত সেপ্টেম্বরে উঠেছিলেন, সেখানে পুলিশ অভিযান চালিয়েছে। সবার মুঠোফোন, ল্যাপটপ, মরিয়মের লেখাপড়া ও চাকরিসংক্রান্ত সব কাগজপত্র নিয়ে চলে গেছে। এখনো পুলিশ সাদাপোশাকে টহল দিচ্ছে। কুইন তাঁর দাবির পক্ষে বিয়ের সময় কাজিকে দেওয়া ফির রসিদ, মহাপরিদর্শক, নিকাহনামার সার্টিফায়েড কপি চেয়ে পাঠানো দরখাস্ত, বিয়ের পর দোয়া প্রার্থনা করে মরিয়ম আক্তারের ফেসবুকে দেওয়া একটি ছবিসহ আরও বেশ কিছু ছবি, মেসেঞ্জারে তাঁর মেয়ের সঙ্গে মিজানুর রহমানের কথোপকথনের কিছু ছবি (স্ক্রিনশট), মিজানুর রহমানের স্বাক্ষর করা ঢাকা মহানগর পুলিশের মনোগ্রামযুক্ত একটি কাগজে ‘তোমার কোনো ক্ষতি হলে আমি সকল দায়িত্ব নেব’ চিরকুট এই প্রতিবেদককে দিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশের মহাপরিদর্শকের কাছে সবকিছু জানিয়ে বিস্তারিত চিঠি দিয়েছেন কুইন তালুকদার। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পুলিশ সদর দপ্তর ও ঢাকা মহানগর পুলিশে (ডিএমপি) কর্মরত ব্যক্তিদের অনেকেই বিষয়টি সম্পর্কে জানেন। তবে ব্যক্তিগত প্রয়োজনে পুলিশকে কাজে লাগানোর ব্যাপারে ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া কিছু জানেন না বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আইনের হাত অনেক লম্বা। কেউ অপরাধ করলে পার পাবে না।’ তিনি এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে রাজি হননি।
মিজানুর রহমান এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, মরিয়ম আক্তার একজন প্রতারক। তাঁর মা, নানিও একই রকম। তাঁর সঙ্গে মরিয়মের মাত্র দুবার দেখা হয়েছে। তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মরিয়মের আপলোড করা ছবির জন্য তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ঢাকা মহানগর পুলিশের মনোগ্রামযুক্ত কাগজে দায়দায়িত্ব নেওয়ার অঙ্গীকার তিনি করেছেন কি না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ। একবার আমার কাছে বলেছিল, কারা ওকে যেন থ্রেট করছে। সে কারণে…।’ ব্যক্তিগত প্রয়োজনে থানা-পুলিশকে ব্যবহারের অভিযোগও অস্বীকার করেছেন মিজানুর।
তবে মিজানুরের দাবি যে অসত্য, তার প্রমাণ রমনা থানার এজাহার। ওই মামলাটি করেন মিজানুর রহমানের ভাইয়ের বাসার তত্ত্বাবধায়ক আসিফ আরেফিন। মামলার এজাহারে তিনি বলেন, গত ১৬ জুলাই মরিয়ম আক্তার তাঁদের বাসায় ঢুকে গ্যাসের চুলায় আগুন জ্বালিয়ে বাসা জ্বালিয়ে দেওয়ার হুমকি দেন ও নিজের ওড়নায় আগুন ধরিয়ে দেন। জানা গেছে, এই মামলার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রমনা থানা থেকে বগুড়ার শাজাহানপুর থানা বরাবর পাঠানো হয়। সেখান থেকে মোহাম্মদপুর থানার সহযোগিতা চাওয়া হয়। ৫৪ ধারায় সেগুনবাগিচার সেগুন রেস্তোরাঁ থেকে পুলিশ মরিয়মকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়।
মামলার এজাহারে যে তারিখের কথা বলা হয়েছে কুইন তালুকদার বলেন, ওই তারিখেই মিজানুর রহমান তাঁর মেয়েকে
পান্থপথের বাসা থেকে তুলে নিয়ে যান বেইলি রোডের বাসায়। কীভাবে কী হলো কুইন তালুকদার সে সম্পর্কে বলেন, তাঁদের বাড়ি বগুড়ায়। মরিয়ম আক্তার ছোট ভাইকে নিয়ে পান্থপথের এনা প্রপার্টিজের একটি ভবনের দোতলায় থাকতেন। সপ্তাহে সপ্তাহে তিনি ছেলেমেয়ের কাছে আসেন। মরিয়মের বাবা বেঁচে নেই।
গত বছর ঈদুল ফিতরের আগে মরিয়ম তাঁকে ‘বিশেষ একজনের’ সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কথা বলেন। পরে কুইন তালুকদার জানতে পারেন সেই বিশেষ একজন হলেন ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মিজানুর রহমান। তাঁদের পরিচয় হয়েছিল ফেসবুকে। পবিত্র রমজানের মধ্যেই মিজানুর একদিন তাঁদের পান্থপথের বাসায় আসেন। তিনি বলেন, ‘আমি মিজানুরকে দেখে ভেবেছি উনি বোধ হয় ছেলের বাবা। পরে শুনি বর।’ তিনি তখনই মিজানুরের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। মিজানুর বলেন, তাঁর প্রথম স্ত্রী, ছেলেদের নিয়ে কানাডায় থাকেন। তিনি ঢাকায় মরিয়ম আক্তারকে নিয়ে আলাদাভাবে সংসার করবেন। কোনো সমস্যা হবে না। কুইন তালুকদার বলেন, ১৬ জুলাই রাতে মিজানুরের কর্মচারীরা তাঁকে মুঠোফোনে ঢাকায় আসতে বলেন। একপর্যায়ে মরিয়মও তাঁর মাকে ফোন করেন। মিজান তাঁকে তাঁর বেইলি রোডের বাসায় যাওয়ার আগে মগবাজার কাজি অফিস থেকে একজন কাজিকে নিয়ে যেতে বলেন। মিজানের কথামতো ৫০ লাখ টাকা দেনমোহরে মরিয়ম ও মিজানুর রহমানের বিয়ে পড়ান কাজি সেলিম রেজা। কাজি বিয়ে নিবন্ধনের রসিদ দিয়ে ১০-১৫ দিন পর কাবিনের রেজিস্ট্রি কাগজ আনার জন্য বলেন। মরিয়মও মিজানুরের বেইলি রোডের বাসায় থাকতে শুরু করেন। পরে তাঁর প্রথম স্ত্রী আসবেন এ কথা জানিয়ে তিনি মরিয়মকে লালমাটিয়ার মোস্তফা প্যালেসে ৫০ হাজার টাকা ভাড়ায় একটি ফ্ল্যাট নিয়ে দেন। পান্থপথ ও লালমাটিয়ার দুটি বাসাতেই মিজানুর রহমানের যাতায়াতের খবর নিশ্চিত করেছেন বাড়ির নিরাপত্তারক্ষী ও তত্ত্বাবধায়কেরা।
তবে কাজি সেলিম রেজা এখন দাবি করছেন তিনি ওই বিয়ে পড়াননি। কিন্তু তাঁর সহকর্মীরা বিয়ের রসিদ ঠিক ছিল বলে জানান এই প্রতিবেদককে। ১৯ ডিসেম্বর মগবাজার কাজি অফিসে তাঁরা বলেন, বিয়ের রসিদ ঠিক থাকলেও মিলিয়ে দেখানো যাচ্ছে না। কারণ, রমনা থানার পুলিশ মগবাজার কাজি অফিসের বিয়ে নিবন্ধন বই জব্দ করেছে।
কুইন তালুকদার বলেন, মিজান তালাকের প্রস্তাব দিলে কুইন তালুকদার কাজির কাছে মেয়ের কাবিনের কাগজ চান। কাজি গড়িমসি করতে শুরু করলে কুইন তালুকদার ১৯ নভেম্বর নিবন্ধন মহাপরিদর্শকের কাছে কাবিনের কপির জন্য আবেদন করেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে মিজান এত কাণ্ড ঘটিয়েছেন।
মিজানুর রহমানের সঙ্গে তাঁর কার্যালয়ে এ নিয়ে কথা বলতে গেলে তিনি একটি ব্রিফকেস বের করেন। ব্রিফকেসের ভেতর থেকে তিনি একটি দৈনিক পত্রিকায় মরিয়ম আক্তারের বিরুদ্ধে ছাপা হওয়া পেপার কাটিং, কাজির দায়ের করা মামলা এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনে মরিয়মের বিরুদ্ধে তিনি যে মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন সেই কপি রেখেছেন। খবর প্রথম আলোর
সম্পাদনা – ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম