বর্তমানে পুলিশ বাহিনীর মোট জনবলের মাত্র ১০ ভাগ নারী। এ সংখ্যা ৫০ ভাগ করার দাবি জানিয়েছেন পুলিশ সদর দফতরে কর্মরত ডিআইজি মিলি বিশ্বাস। পুলিশে কর্মরত নারীদের মধ্যে তিনিই সর্বোচ্চ পদে আসীন এখন। এর আগে তিনি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
বাংলাদেশ পুলিশ উইমেন নেটওয়ার্কের সভাপতিও তিনি। সারা বিশ্বের নারী পুলিশ নিয়ে গঠিত ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব উইমেন পুলিশের (আইএডব্লিউপি) এশিয়ান রিজন-২২ এর সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করছেন তিনি। নারী পুলিশের সমস্যা, সম্ভাবনা এবং প্রতিকূলতাসহ নানা বিষয় নিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছেন মিলি বিশ্বাস।
পুলিশ সদর দফতরে নিজ কার্যালয়ে একান্ত সাক্ষাৎকালে তিনি বলেন, ‘পুলিশে এখন চমৎকার নারীবান্ধব পরিবেশ বিরাজ করছে। নারীরা এখন নারী সদস্য হিসেবে পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেন না। তারা এখন সরাসরি ক্যাডার কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দিচ্ছেন। তবে কনস্টেবল হিসেবে যারা যোগ দেন তারা এখনও নারী পুলিশ হিসেবেই যোগ দিচ্ছেন। আগামীতে এখানেও কোনো ভেদাভেদ থাকবে না।’
তিনি বলেন, ‘আগে নারীরা পুলিশে চাকরি করতে চাইতেন না। কিন্তু এখন তারা পুলিশে চাকরি পেতে খুবই আগ্রহী। এক সময় এসআই পদে নারীদের পাওয়া যেত না। এখন কনস্টেবল পদে যোগ দিতে নারীরা তীব্র প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হচ্ছেন। নারীরা এখন পুলিশ বাহিনীতে কোনো সমস্যাই মোকাবেলা করেন না। পুরুষদের পাশপাশি তারা সমান তালে এগিয়ে যাচ্ছেন।’
ডিআইজি মিলি বিশ্বাস বলেন, ‘পুলিশের নারী সদস্যরা নিজে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি পরিবারেও স্বাচ্ছন্দ্য ফিরিয়ে আনছেন। নারীদের পুলিশে যোগদান নিয়ে এক সময় নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। অনেকেই মনে করতেন নারীরা নার্স, শিক্ষক কিংবা ব্যাংকার হবেন। তারা কেন পুলিশ অফিসার হবেন? আমার স্বামী একই বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে যোগ দিয়েছিলেন। এ নিয়ে তখন অনেকেই হাসি-ঠাট্টা, রসিকতা করেছেন। বলেছেন, দু’জনের চাকরি তো উল্টো হয়ে গেল। আমরা চারজন নারী একসঙ্গে পুলিশ ক্যাডারে যোগ দেয়ার পর মানুষের মনোভাব পরিবর্তিত হতে থাকে। চাকরি ক্ষেত্রেও অনুকূল পরিবেশ তৈরি হতে থাকে। পুলিশের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা আমাদের সাপোর্ট দিতে থাকেন।’
তিনি বলেন, ‘আমরা পুলিশে যোগ দেয়ার পর প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল পোশাক। তখন পুলিশের পোশাক পরে ডিউটি করার সময় অনেকে নানা ধরনের অপমানজনক কথাবার্তা বলেছেন। কিছু অফিসার ইতিবাচক থাকলেও অনেক সহকর্মীর মনোভাব ছিল হতাশাজনক। প্রতিটি পদক্ষেপেই আমাদের প্রমাণ করতে হয়েছে যে, আমরা পুলিশে চাকরি করতে পারি।’
ডিআইজি মিলি বিশ্বাস বলেন, ‘২০০০ সালে আমি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে প্রথম নারী পুলিশের নেতৃত্ব দেই। এটা করতে গিয়ে আমাকে ৫-৬টি পরীক্ষা দিতে হয়েছে। আমার ডিআইজি হওয়ার পেছনে পরিবারের সর্বোচ্চ সাপোর্ট ছিল। এ কারণে আজ এ পর্যায়ে আসতে পেরেছি।’
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘পুলিশে নারীর সংখ্যা আরও বাড়ানো উচিত। নারীর সংখ্যা যত বাড়বে গোটা বাহিনীর মর্যদাও তত উঁচুতে উঠবে। এখন ক্যাডার সার্ভিসে নারীদের জন্যে ১০ ভাগ কোটা আছে। কোটার বাইরেও পুরুষদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নারীদের পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেয়ার সুযোগ আছে। দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী হওয়ায় পুলিশ বাহিনীতে নারীদের সংখ্যাও অর্ধেক হওয়া উচিত। ইউরোপ-আমেরিকায় কর্মরত পুলিশ সদস্যদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক নারী। বাংলাদেশ পুলিশে যোগ দিতে নারীরা যেভাবে আগ্রহী হচ্ছেন তাতে অচিরেই তাদের সংখ্যা মোট জনবলের প্রায় অর্ধেকে দাঁড়াবে বলে আশা করছি।’
তিনি বলেন, ‘নারীকে বাদ দিয়ে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, দেশের নারীরা এখনও অনেক ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে অনগ্রসর ও সুবিধাবঞ্চিত। একজন নারী পুলিশের কাছে একজন নির্যাতিত নারী তার সমস্যার কথা পুরোপুরিভাবে খুলে বলতে পারেন। কিন্তু পুরুষ পুলিশের কাছে সেভাবে বলতে পারেন না। এমনকি একজন নারী অপরাধীকে আইনের আওতায় আনতে একজন নারী পুলিশ জরুরি।’
পুলিশে নারী সদস্যদের ব্যর্থতার চিত্র নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তারা কমিটমেন্ট ও ডেডিকেশন নিয়ে কাজ করেন। পুলিশের মতো চ্যালেঞ্জিং পেশায় নারীদের অংশগ্রহণ যেভাবে বাড়ছে তা আশাব্যঞ্জক।’
১৯৮৮ সালে ক্যাডার কর্মকর্তা হিসেবে পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেন মিলি বিশ্বাস। তার সঙ্গে আরও চার নারী পুলিশ ওই সময় এএসপি হিসেবে কাজ শুরু করেন। এ প্রসঙ্গে মিলি বিশ্বাস বলেন, ‘আমরা চারজন পুলিশে ক্যাডার কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেয়ার আগে শুধু ফাতেমা বেগমই ছিলেন পুলিশের নারী বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তা। ফাতেমা বেগম অতিরিক্ত আইজিপি হিসেবে এরই মধ্যে পিআরএলে (অবসরোত্তর ছুটি) গেছেন।’
অগ্রজ ফাতেমা বেগমের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তিনি (ফাতেমা বেগম) ইতিহাস তৈরি করে গেছেন। আমাদের জন্যে বিসিএস (পুলিশ) তিনিই উন্মুক্ত করে গেছেন। ওনাকে দেখেই আমি পুলিশ বাহিনীতে যোগদানের ইচ্ছা পোষণ করি। কিন্তু আমরা পুলিশে যোগ দেয়ার পর উদাহরণ হিসেবে কোনো নারী কর্মকর্তাকে পাইনি। কারণ, ওই সময় ফাতেমা বেগম একটি প্রশিক্ষণে অংশ নিতে অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থান করছিলেন। তাই আমাদের চারজনকে পৃথক এবং যৌথভাবে নানা সমস্যা মোকাবেলা করতে হয়েছে।’
ফাতেমা বেগমের বিষয়ে মিলি বিশ্বাস আরও বলেন, হাজার হাজার পুরুষ কর্মকর্তার সঙ্গে একমাত্র নারী কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করতে হয়েছে তাকে (ফাতেমা বেগম)। ট্রেনিংয়ে থাকাকালীন সব পুরুষ প্রশিক্ষণার্থীদের সঙ্গে একমাত্র নারী হিসেবে তাকে প্রশিক্ষণ নিতে হয়েছে। সব প্রতিকূলতা তাকে একা একাই মোকাবিলা করতে হয়েছে। অত্যন্ত সাহসী ছিলেন বলে ফাতেমা বেগম পুলিশ বাহিনীতে সফলতার সঙ্গে কাজ করতে পেরেছেন। কৃতজ্ঞতা – যুগান্তর