দেশের উচ্চ আদালত ও অধস্তন আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৩৩ লাখ ৯ হাজার ৭৮৯টি। এর মধ্যে পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিচারাধীন মামলা ৮ লাখ ৯৩ হাজার ২৮৬টি। এটি গত ৩১ ডিসেম্বরের হালনাগাদ হিসাব। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই বিপুলসংখ্যক মামলা ঝুলে থাকায় পরিষ্কার যে, চরম দুর্ভোগের মুখে পড়তে হচ্ছে বিচারপ্রার্থীদের। বেড়ে যাচ্ছে মামলা পরিচালনার ব্যয়। অনেক ক্ষেত্রে বিচার চাইতে গিয়ে বিচারপ্রার্থীকে হয়রানির শিকারও হতে হচ্ছে। ন্যায়বিচার বঞ্চিত হচ্ছেন অনেক বিচারপ্রার্থী। কারণ জ্ঞানীজনেরা বলেন, ‘জাসটিস ডিলেইড, জাস্টিজ ডিনায়েড’। অর্থাৎ বিলম্বিত বিচার মানে বিচারবঞ্চিত হওয়া। পাশাপাশি মামলার এই পাহাড়সম বোঝা টানতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে বিচারকদেরও।
আজ সোমবার (১৬ জানুয়ারি) জাতীয় সংসদে এক লিখিত প্রশ্নের জবাবে মামলার পরিসংখ্যান সংক্রান্ত তথ্যাদি উপস্থাপন করার কথা রয়েছে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের। গত ৮ জানুয়ারি দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার পরিসংখ্যান জানতে চেয়ে সব জেলা জজের কাছে চিঠি পাঠায় সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন। সে অনুযায়ী সারা দেশের অধস্তন আদালত থেকে তথ্য পাঠানো হয়। পাশাপাশি উচ্চ আদালতের তথ্যও সংগ্রহ করে সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন। এর পর গত সপ্তাহেই তা আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।
জানা গেছে, দশ বছরের ব্যবধানে মামলার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। ২০০৭ সালে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের সময় সারা দেশে বিচারাধীন মামলা ছিল ১৫ লাখ ৭০ হাজার।
এ থেকে উত্তরণের বিষয়ে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু এমপি বলেন, এত মামলা বিচারাধীন থাকার যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। একটি সুদূরপ্রসারী (দীর্ঘ, স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি) পরিকল্পনা হাতে নিলে দু-এক বছরের মধ্যেই মামলার জট কমিয়ে আনা সম্ভব।
তিনি বলেন, বর্তমানে যে পরিমাণ বিচারক আছেন, তাদের সংখ্যা দ্বিগুণ করতে হবে। ১৬ কোটি মানুষের দেশে অধস্তন আদালতে বিচারক কেন ১২শ হবে? এই সংখ্যা দ্রুতই ২ হাজার করতে হবে। হাইকোর্টে জজ ১০০ থেকে কমে এখন ৮০ জনে নেমেছে। এখানে অন্তত দেড়শ বিচারক নিয়োগ করতে হবে। আপিল বিভাগে অন্তত ২০ বিচারক নিয়োগ করতে হবে। আমাদের সাধ্যের মধ্যে এটা করা সম্ভব। ন্যায়বিচারের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য, আইনের শাসনের জন্য এর কোনো বিকল্প নেই। প্রধান বিচারপতির পদ দীর্ঘদিন শূন্য থাকায় ক্ষোভও প্রকাশ করেন তিনি।
সূত্র জানিয়েছে, মামলার যে পরিসংখ্যান সংগ্রহ করেছে সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন, এগুলোর মধ্যে উচ্চ আদালতে বিচারাধীন ৪ লাখ ৯৩ হাজার ৩১৫টি। এর মধ্যে আপিল বিভাগে বিচারাধীন ১৬ হাজার ৫৬৫টি। আর হাইকোর্ট বিভাগে বিচারাধীন ৪ লাখ ৭৬ হাজার ৭৫০টি। আপিল বিভাগে বিচারাধীন মামলার মধ্যে ১১ হাজার ৩০৭টি দেওয়ানি আর ৫ হাজার ২৫৮টি ফৌজদারি। হাইকোর্টে বিচারাধীন মামলার মধ্যে রিট মামলা ৭৬ হাজার ৭৭০টি, দেওয়ানি মামলা ৯৩ হাজার ১৭৪টি এবং ফৌজদারি মামলা ২ লাখ ৯৭ হাজার ৬৩৫টি।
অধস্তন আদালতে বিচারাধীন মামলার মধ্যে ১২ লাখ ৭৯ হাজার ১০৭টি দেওয়ানি এবং ১৫ লাখ ৩৫ হাজার ৩৬৭টি ফৌজদারি। পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে চলমান মামলার মধ্যে ২ লাখ ৯২ হাজার ২৩টি উচ্চ আদালতে। এর মধ্যে আপিল বিভাগে এ ধরনের মামলার সংখ্যা মাত্র ১৮৯টি। আর বাকি ২ লাখ ৯১ হাজার ৮৩৪টির মধ্যে ৬৭ হাজার ৪৮৬টি দেওয়ানি, ১ লাখ ৮১ হাজার ১৫৬টি ফৌজদারি, ৩৮ হাজার ৭৮১টি রিট এবং ৪ হাজার ৪১১টি আদিম দেওয়ানি মামলা। অধস্তন আদালতে পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে বিচারাধীন ৬ লাখ ১ হাজার ২৬৩টি মামলার মধ্যে ৩ লাখ ২ হাজার ২২৩টি দেওয়ানি এবং ২ লাখ ৯৯ হাজার ৪০টি ফৌজদারি।
জানা যায়, বর্তমানে হাইকোর্টে ৮৩ জন বিচারপতি দায়িত্ব পালন করছেন। তাদের অধীনে বিচারাধীন রয়েছে ৪ লাখ ৭৬ হাজারেরও বেশি মামলা। সে হিসেবে প্রত্যেক বিচারপতির দায়িত্বে পড়ে প্রায় ৫ হাজার ৭০০-এরও বেশি মামলা। এ ছাড়া আপিল বিভাগে বর্তমানে পাঁচজন বিচারপতির নেতৃত্বে একটি বেঞ্চ কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। এর আগে দুটি বেঞ্চে কার্যক্রম চলত। এই একটি বেঞ্চে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ১৬ সহস্রাধিক।
জানা যায়, উচ্চ আদালতে সর্বশেষ বিচারপতি নিয়োগ হয়েছে ২০১৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি। সেদিন হাইকোর্ট বিভাগে ১০ জন অতিরিক্ত বিচারক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। গত বছর ১০ ফেব্রুয়ারি তাদের আটজনের নিয়োগ স্থায়ী হয়। এ সময়ে অনেক বিচারপতি মারা গেছেন আবার অনেকে অবসরে গেছেন। আপিল বিভাগেও বিচারপতি অবসরে যাওয়ায় ও প্রধান বিচারপতি পদত্যাগ করায় বর্তমানে একটি বেঞ্চ বসে বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে, উচ্চ আদালতে বিচারপতি সংকট রয়েছে।
তবে আশার কথা শুনিয়েছেন আইনমন্ত্রী। তিনি জানিয়েছেন, চলতি মাসের শেষদিকে অথবা আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগ হবে।
প্রাপ্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জনসংখ্যার অনুপাতে বাংলাদেশের বিচারকের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য। আমেরিকায় ১০ লাখ মানুষের জন্য ১০৭ জন, কানাডায় ৭৫ জন, ইংল্যান্ডে ৫১ জন, অস্ট্রেলিয়ায় ৪১ জন, ভারতে ১৮ জন বিচারক রয়েছেন। অথচ বাংলাদেশে ১০ লাখ মানুষের জন্য মাত্র ১০ জন বিচারক রয়েছেন। এত অল্পসংখ্যক বিচারক দিয়ে মামলার জট কমানো সম্ভব নয় বলে আইনজীবীরা মনে করছেন। এ কারণে ২০১৫ সালে আইন কমিশন অতিদ্রুত আরও ২৪শ বিচারক নিয়োগের সুপারিশ করেছিলেন। কিন্তু সেই সুপারিশ আজও বাস্তবায়িত হয়নি। সূত্র : আমাদের সময়
সম্পাদনা- ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম