যোগ্যতাসম্পন্ন আইনজীবীদের মধ্য থেকে প্রধান বিচারপতি কিংবা আপিল বিভাগের বিচারপতি নিয়োগ না হওয়ায় রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবী। কিন্তু সেই রিট মামলা শুনতে আপত্তি জানায় হাইকোর্টের চারটি বেঞ্চ। তবে রিটকারী আইনজীবীর পঞ্চমবারের চেষ্টায় মামলাটি শুনানির জন্য হাইকোর্টের কার্যতালিকায় স্থান পায়।
রিটে প্রধান বিচারপতির পদ শূন্য থাকা ও নিয়োগ না দেওয়া কেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না এবং সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইনজীবী থেকে প্রধান বিচারপতিসহ অন্য বিচারপতি (আপিল বিভাগে) নিয়োগের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়।
গত ৩ জানুয়ারি হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. ইউনুছ আলী আকন্দ রিটটি করেন। এরপর রিটটি শুনানির জন্য হাইকোর্টে গেলে বিচারপতিরা তা শুনতে অপরাগতা প্রকাশ করেন এবং আবেদনটি ফেরত পাঠান। এভাবে হাইকোর্টের চারটি রিট বেঞ্চের বিচারপতিরা আবেদনটি না শুনেই ফেরত পাঠান।
রিট দায়েরের পর প্রথমে আবেদনটি শুনানির জন্য বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেন ও বিচারপতি মো. আতাউর রহমান খানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে শুনানির জন্যে তোলা হয়। তখন এই বেঞ্চ রিটকারী আইনজীবীকে বলেন, আপনি রিটটি অন্য কোর্টে শুনানির জন্য উপস্থাপন করুন। তবে তারা শুনানি না করতে চাইলে আবার আমাদের কাছে আসবেন।
এরপর আবেদনটি শুনানির জন্য নেওয়া হয় বিচারপতি তারিক উল হাকিম ও বিচারপতি এম. ফারুকের বেঞ্চে। এ বেঞ্চ ওই আইনজীবীকে বলেন, আপনি রিটটি নিয়ে প্রধান বিচারপতির কাছে যান। আমরা এটা শুনবো না।
এসময় আইনজীবী ইউনুছ আলী আকন্দ আদালতকে বলেন, রিট মামলা শুনানির জন্য প্রধান বিচারপতির কাছে যাওয়ার সুযোগ নেই। আপনারা (বিচারপতিরা) শুনানি নিয়ে আদেশ দিয়ে রিটটি প্রধান বিচারপতির কাছে পাঠিয়ে দিন। কিন্তু আদালত বলেন, আপনি রিটটি নিয়ে প্রধান বিচারপতির কাছে চিঠি লিখুন। তারপর তিনি নির্দেশ দিলে শুনবো।
পরে আবেদনটি তৃতীয়বারের মতো বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী ও বিচারপতি এ. কে. এম জহিরুল হকের বেঞ্চে উপস্থাপন করা হয়। তবে এখানেও আদালত মামলাটি শুনবেন না বলে জানিয়ে দেন।
রিটটি বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ ও বিচারপতি মো. সেলিমের রিট বেঞ্চে শুনানির জন্য তোলা হলেও তা শুনানি হয়নি। সেখান থেকেও মামলাটি ফেরত দেওয়া হয়।
সবশেষ গত ১৮ জানুয়ারি আবেদনটি বিচারপতি জিনাত আরা ও বিচারপতি কাজী মো. ইজারুল হক আকন্দের বেঞ্চে শুনানি করতে গেলে প্রথমে তারাও শুনতে চাননি। তবে আবেদনের বিষয়ে রিটকারী কয়েকটি যুক্তি উপস্থাপনের পর দুই বিচারপতি নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে মামলাটি শুনতে রাজি হন। একইসঙ্গে মামলাটি শুনানির জন্য ২১ জানুয়ারি হাইকোর্ট বিভাগের কার্যতালিকায় (কজ লিস্ট) রাখার নির্দেশ দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ২১ জানুয়ারি মামলাটি শুনানি শুরু হয়।
ওই শুনানিতে রিটকারী ছাড়াও রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে অংশ নেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। শুনানির শুরুতে অ্যাটর্নি জেনারেল মামলাটিতে তার যুক্তি উপস্থাপন করতে আদালতে এক সপ্তাহ সময় প্রার্থনা করেন। এই সময় আবেদনের বিরুদ্ধে রিটকারী কোনও বক্তব্য না রাখায় আদালত রিটটির শুনানি এক সপ্তাহ মুলতবি করেন। একইসঙ্গে আগামী ২৮ জানুয়ারি শুনানির দিন ধার্য করেন।
মামলাটির আইনজীবী তার আবেদনে উল্লেখ করেন, সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধান বিচারপতিসহ সব বিচারপতি নিয়োগে ন্যূনতম ১০ বছর সুপ্রিম কোর্টে ওকালতি (আইনজীবী হিসেবে) করলে তাকেই নিয়োগ দেওয়া যায়। কিন্তু এ পর্যন্ত কাউকেই এভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়নি বলে তিনি অভিযোগ করেন। এক্ষেত্রে এই আইনজীবীর যুক্তি, সংবিধানের ৯৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী শুধু অতিরিক্ত বিচারপতি (নির্দিষ্ট মেয়াদে হাইকোর্ট বিভাগে নিয়োগ দেওয়া হয়) ছাড়া সরাসরি বিচারপতি নিয়োগ কখনও করা হয়নি।
তাই রিটকারী তার আবেদনে সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের বিচারপতি পদে আইনজীবীদের মধ্যে থেকে নিয়োগের আবেদন করেন।
এ প্রসঙ্গে রিটকারী আইনজীবী ইউনুছ আলী আকন্দ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বর্তমানে একজন প্রধান বিচারপতিকে চারবার শপথ বাক্য পাঠ করতে হচ্ছে। অর্থাৎ, আইনজীবী থেকে যখন অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে হাইকোর্টে নিয়োগপ্রাপ্ত হচ্ছেন তখন একবার, হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে কর্মরত থাকার দুই বছর পর স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হলে দ্বিতীয়বার, এরপর হাইকোর্ট থেকে আপিল বিভাগে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পেলে তৃতীয়বার এবং সবশেষ আপিল বিভাগ থেকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পেলে চতুর্থবারের মতো তাকে শপথবাক্য পাঠ করতে হচ্ছে। এর ফলে অন্যদের বঞ্চিত করে একজন বিচারপতিকে চারবার শপথ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে।’
তিনি জানান, ভারতের হাইকোর্টে ন্যূনতম ১০ বছর আইনজীবী হিসেবে কাজ করলে তাদের মধ্য থেকেই সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ও বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রে যে কোনও নাগরিককে সিনেটের সম্মতি নিয়ে প্রধান বিচারপতিসহ অন্য বিচারপতিদের নিয়োগ দেন দেশটির প্রেসিডেন্ট। প্রধান বিচারপতিকে আপিল বিভাগের বিচারপতিদের মধ্য থেকেই নিয়োগ দিতে হবে–এমন কোনও বিধান ওইসব দেশে এমনকি বাংলাদেশেও নেই।
তাই সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইনজীবীদের মধ্য থেকে বিচারপতি (প্রধান বিচারপতি বা আপিল বিভাগের বিচারপতি) নিয়োগ না হওয়ায় সংবিধানের প্রস্তাবনা এবং সংবিধানের ২৭, ২৮ ও ৪০ অনুচ্ছেদ লঙ্ঘিত হচ্ছে এবং আইনজীবীদের প্রতি বৈষম্য করা হচ্ছে বলে মনে করেন রিটকারী আইনজীবী। বাংলা ট্রিবিউন
সম্পাদনা- ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম