আজ (২৮ জানুয়ারি) বিশ্ব তথ্য সুরক্ষা দিবস। ১৯৮১ সালে ইউরোপের বৃহৎ সংগঠন ‘কাউন্সিল অব ইউরোপ’-এ কনভেনশন ১০৮ স্বাক্ষরের মধ্যদিয়ে বিশ্বে প্রথম ডেটা প্রাইভেসি ডে বা তথ্য সুরক্ষা দিবস উদযাপন শুরু হয়। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য বিষয়— ‘ব্যক্তিগত গোপনীয়তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন, তথ্য সুরক্ষা ও আস্থা প্রতিষ্ঠা’।
বাংলাদেশ সংবিধানের ৪৩ (খ) নম্বর অনুচ্ছেদে প্রাইভেসি রাইটস বা ব্যক্তির তথ্য সুরক্ষা ও গোপনীয়তা মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃত। অনুমতি ছাড়া কারও ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশকে অপরাধ হিসেবে নানা আন্তর্জাতিক সনদে উল্লেখ করা হলেও দেশে তা কতটা মানা হচ্ছে, এ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
ব্যক্তি কোন তথ্যটি দেবেন, বা ব্যক্তির কাছে কতটা তথ্য চাওয়া যায়, সেই বোধ তৈরি না হওয়ায় ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা হুমকির মুখে রয়েছে বলে মনে করেন সামাজিক ও ডিজিটাল নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, ডিজিটাল যুগে বিভিন্ন জায়গায় তথ্য চাওয়া হয়। কিন্তু সেটি সুরক্ষিত থাকবে কিনা, তা নিশ্চিত করে জানানো হয় না। যে কোনও জায়গায় জাতীয় পরিচয়পত্র, মেডিক্যাল রিপোর্ট, ভাড়াটিয়া তথ্য ফরমের নামে যাবতীয় তথ্য দেওয়া এবং সেটির রক্ষণাবেক্ষণ বিষয়ে নাগরিকের কাছে কোনও তথ্য না থাকায় ব্যক্তি হুমকির মুখে পড়তে পারেন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। যদিও প্রাতিষ্ঠানিক তথ্য এখন অনেকটাই সুরক্ষিত।
২০১৫ সালের শেষ দিকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) বাড়ি বাড়ি গিয়ে ফরম পূরণের মাধ্যমে রাজধানীতে বসবাসকারী নাগরিকদের তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু করে। ২০১৬ সালে গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, ভাড়াটিয়াদের তথ্য গোপন রাখার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও ডিএমপি সেই কাজটি এখন সাধারণ ব্যবসায়ীদের দিয়ে করাচ্ছে। এমনকি নাগরিকদের তথ্য সংরক্ষণের জন্য তৈরি করা ডিএমপির সিটিজেন ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (সিআইএমএস) সার্ভারের পাসওয়ার্ডও তাদের হাতে দিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এদিকে, ফেসবুকের জীবন-যাপন পর্যবেক্ষণের মধ্যদিয়ে ‘সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং’ এর মাধ্যমে সক্রিয় হ্যাকাররা জেনে যাচ্ছে পাসওয়ার্ড। এরমধ্যে ব্যক্তির গোপনীয়তা বলে আর কিছু থাকছে কিনা, তা নিয়ে শঙ্কা জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
দ্য ইনফরমেশন সিকিউরিটি এজেন্সি লিমিটেডের চিফ সিকিউরিটি কনসালটেন্ট মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন মনে করেন, অ্যান্ড্রয়েড ফোন বা এর মতো যেসব ডিভাইজ আমরা ব্যবহার করি,তা সম্পর্কে আমরা মোটেও সচেতন না। তিনি বলেন, ‘শিক্ষিতদের মধ্যেও এই সচেতনতা নেই বললেই চলে। এটার ফল কী হতে পারে, সেটাও তারা জানেন না। আপনার গোপনীয়তা ভঙ্গ করে কোন তথ্যগুলো এবং সেগুলো আপনি কোথায় দিচ্ছেন, সেটিও আপনার ভাবার আছে।’
প্রাইভেসি নষ্ট হয় কোন তথ্যগুলোতে এমন এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি আরও বলেন, ‘জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর, মেডিক্যাল রিপোর্ট, আপনার ব্লাড গ্রুপ, ফোন নম্বর এসব কিছুই। আপনার ব্যক্তিগত তথ্য হিসেবে এগুলো সব জায়গায় দেবেন না।’
তিনি বলেন,‘যেসব তথ্য দেওয়ার কারণে আপনি কোনও ধরনের হয়রানির শিকার হতে পারেন, সেগুলোই প্রাইভেসি হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। সিকিউরিটি বলতে যেসব উপায়ে আমরা আমাদের নিজেদের ও ব্যক্তিগত তথ্যকে সুরক্ষা করি, তাকে বোঝায়। আর প্রাইভেসি বলতে আমাদের ব্যক্তিগত তথ্যে প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রণ বোঝায়।’
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘গোপনীয়তার অধিকার মৌলিক অধিকার। কিন্তু তা পদে পদে হরণ করা হচ্ছে। ভাড়াটিয়াদের তথ্য নেওয়া —এটা কতটুকু সংবিধানসম্মত হচ্ছে, আমি নিশ্চিত না। এগুলো ব্যবহার করে অধিকার হরণসহ নানা হয়রানির শিকার হতে পারেন নাগরিকরা।’
তিনি আরও বলেন,‘আমরা চাই, অবারিত তথ্যপ্রবাহ। যে কর্তৃপক্ষের হাতে তথ্য আছে, সেগুলো অবারিত হোক। কিন্তু নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষিত হোক। সেগুলো যেন কোনোভাবেই প্রকাশ না পায়।’
প্রাতিষ্ঠানিক তথ্য দেওয়া-নেওয়ার নিয়ম থাকলেও ব্যক্তিগত তথ্যের বিষয়গুলোতে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও সাবেক তথ্য কমিশনার সাদেকা হালিম। তিনি বলেন, ‘কোনও এজেন্সি যদি কারও টেলিফোন চেক করে, সেটা প্রাইভেসি অ্যাক্টের মধ্যদিয়েই যেতে হবে। যখন কেউ কিছু চেক করে সেটা নিশ্চয়ই কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে করে। এই উদ্দেশ্যের বাইরে সেটি যে ব্যবহৃত হবে না,তা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু সেটা ব্যবহার করে পরে যদি ব্ল্যাকমেইল করি, তখনই প্রাইভেসি নষ্ট করে। যারা এধরনের কাজগুলো করেন, তাদের সঠিক প্রশিক্ষণও নেই।’
সাদেকা হালিম আরও বলেন, ‘ব্যক্তিগত জীবনের তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যবহার করায়, এর সুযোগ কেউ কেউ নিতে পারে। এটা আমাদের মাথায় রাখা উচিত। আমি আমার বেডরুমের ছবি দিয়ে দিলে, দায়িত্বটা আমাকেই নিতে হবে। আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারে একেবারেই সতর্ক না। নারী ফেসবুক ব্যবহারকারীরা বিপদেও পড়ছেন। আবার ব্যক্তিকে না জানিয়ে কোনও অভিযোগ ছাড়া যদি রাষ্ট্রও এসব ব্যক্তিগত যোগাযোগে হস্তক্ষেপ করে, তাহলে সেটিও প্রাইভেসি ব্রেক করা। এতে মানুষের মধ্যে অস্বস্তি তৈরি হয়।’
সাবেক প্রধান তথ্য কমিশনার গোলাম রহমান বলেন,‘প্রাইভেসি নিয়ে আমাদের তেমন কোনও আইন নেই। প্রাইভেসির অধিকার রক্ষার দায়িত্ব ও আইনি কাঠামোর সহায়তা দেওয়ার কথা রাষ্ট্রের। আমাদের এখানে প্রায়ই পাবলিক ইন্টারেস্ট, পলিটিক ইন্টারেস্ট ক্ষুণ্ন হয়। নতুন প্রযুক্তির কারণে ব্যক্তিগত তথ্য গোপনীয়তা জরুরি। অনেক ক্ষেত্রে তথ্য চুরি হয়ে গেলেও কিছু করার থাকছে না। এটি যেন না হয়,তাই বিষয়টি আইনি কাঠামোতে আনা উচিত।’ বাংলা ট্রিবিউন
সম্পাদনা- ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম