বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া - ফাইল ছবি

দণ্ডিত হলে নির্বাচনে অংশগ্রহণ অনিশ্চিত

চলতি বছরের শেষ দিকে হবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচনী বছরেই বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও তার বড় ছেলে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দুদকের করা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায় হতে যাচ্ছে। ৮ ফেব্রুয়ারি মামলাটির রায়ের দিন ধার্য করা হয়েছে। এ ছাড়া জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় যুক্তিতর্ক শুনানির জন্য ৩০ ও ৩১ জানুয়ারি এবং ১ ফেব্রুয়ারি দিন ধার্য রয়েছে। চ্যারিটেবল মামলার যুক্তিতর্ক ৮ ফেব্রুয়ারির আগেই শেষ হলে সেক্ষেত্রে এ মামলার রায়ও একই দিনে হতে পারে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের।

এ দুই মামলার রায় নিয়ে দুশ্চিন্তা বিএনপির নেতাকর্মীদের মাঝে। রায়ে দণ্ডিত হলে আগামী জাতীয় নির্বাচনে আদৌ অংশ নিতে পারবেন কিনা তা নিয়ে তারা শঙ্কিত। দণ্ডিত ব্যক্তির নির্বাচনে অংশ নেওয়ার যোগ্যতা-অযোগ্যতার বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদের (২)(ঘ) উপ-অনুচ্ছেদে। এ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হইয়া অন্যূন দুই বৎসরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তাহার মুক্তিলাভের পর পাঁচ বৎসরকাল অতিবাহিত না হইয়া থাকে’ তা হলে তিনি নির্বাচিত হওয়ার অযোগ্য হবেন। আবার গণপ্রনিতিধিত্ব অধ্যাদেশেও (আরপিওতেও) একই কথা বলা হয়েছে।

এ অবস্থায় আইন বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়া হলে সংবিধান ও আরপিওর এই বিধান নিয়ে ভিন্ন-ভিন্ন ব্যাখ্যা এসেছে। খালেদা জিয়ার আইনজীবী আবদুর রেজাক খান বলেছেন, ‘কোন দণ্ড চূড়ান্ত হয়, যখন আপিল বিভাগে সেই দণ্ড বহাল থাকে। চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছানোর আগে দণ্ড সাসপেন্ড করার একটি বিধান আছে। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪২৬ ধারা অনুযায়ী তার কনভিকশন অ্যান্ড সেনটেন্স (দণ্ড ও সাজা) সাসপেন্ড হলে তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন।’

তিনি আরও বলেন, সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদে দণ্ড চূড়ান্ত হওয়ার কথা বলা নেই; কিন্তু দণ্ড হলে তা সাসপেন্ড করে দিলে, সংবিধানের বিধানটা সাসপেন্ড থাকে। তার মতে, দণ্ড সাসপেন্ড ও দণ্ড স্থগিত আলাদা বিষয়।

মহীউদ্দীন খান আলমগীরের মনোনয়নপত্র গ্রহণ ও পরবর্তী সময়ে তা বাতিল করে দেওয়া রায়ের বিষয়টি সামনে আনা হলে জ্যেষ্ঠ এই আইনজীবী বলেন, সাসপেন্ড করার বিধান তার ক্ষেত্রে প্রয়োগ হয়েছে কিনা জানি না। তার সেটি ছিল মনোনয়নপত্রের বিষয়; কিন্তু হাইকোর্ট কোনো কারণে তার সাজা সাসপেন্ড করলে, সেক্ষেত্রে তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন।

সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, ‘ফৌজদারি মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত হলে, সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে একটি সাংবিধানিক বার (বাধা) রয়েছে। ন্যূনতম ২ বছর দণ্ডপ্রাপ্ত হলে এবং তার পর ৫ বছর অতিবাহিত না হলে সে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না।’

হাইকোর্ট যদি সাজা স্থগিত করে এবং আসামিকে জামিন দেয়, সেক্ষেত্রে পারবে কিনা জানতে চাইলে সাবেক এই আইনমন্ত্রী বলেন, ‘সাজা স্থগিত করলে তো সাজা বাতিল হলো না। সাজা খাটা হলো না। সেক্ষেত্রেও পারবে না।’

তবে ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ আরও বলেন, দণ্ডিত যদি উচ্চ আদালতে আবেদন করে এবং আবেদনের যুক্তি দেখে আদালত সন্তুষ্টি সাপেক্ষে মনোনয়নপত্র দাখিলের অনুমতি দেন, সেক্ষেত্রে নির্বাচনে অংশ নিতে পারে।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, বিচারিক আদালতে দুবছরের দণ্ডপ্রাপ্ত হলে, নির্বাচনের সময় ওই দণ্ড বহাল থাকলে যে কেউই আর জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। তিনি আরও বলেন, যদি উচ্চ আদালত তার সাজা স্থগিত করেন তাও পারবে না। কারণ সাজা স্থগিত হলে তো সাজাটা থেকে যাচ্ছে। তবে সাজা বাতিল হয়ে গেলে যে কেউ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে বলে আমি মনে করি।

দুর্নীতির মামলায় দুবছর দণ্ডপ্রাপ্ত হলেই জাতীয় নির্বাচনে আর অংশ নিতে পারবে না বলে মনে করেন সাবেক অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এমকে রহমান। তার মতে, দুবছর দণ্ডপ্রাপ্ত হলেই নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে অযোগ্য হবে। তার মতে, বিচারিক আদালত দণ্ড দিলে তার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করলে আসামির জামিন হতে পারে; কিন্তু সাজা কখনো স্থগিত হয় না।

২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার উদাহরণ তুলে ধরা হলে এমকে রহমান বলেন, এটি এখন সেটেল হয়ে গেছে। ২ বছরের জন্য দণ্ডিত ব্যক্তির মনোনয়নপত্র অবৈধ হবে। এ ব্যাপারে আপিল বিভাগের চেম্বার জজ আদালত প্রথমে ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরের মনোনয়নপত্র গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছিল; কিন্তু নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চ ওই মনোনয়নপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয়। সে অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন তার আসন শূন্য ঘোষণা করে গেজেট জারি করে। পরে মহীউদ্দীন খান আলমগীর ইসির গেজেটের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট করলে হাইকোর্ট অন্যায়ভাবে গেজেটের কার্যকারিতা স্থগিত করেন। তাকে অবৈধভাবে এমপি পদে থাকার সুযোগ করে দেন। পরে ইসি হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন জানালে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বাতিল করে দেয়; কিন্তু একটি রিভিউ আবেদনের মাধ্যমে ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর তার এমপি পদে দায়িত্ব পালন করে গেছেন, যা অন্যায় হয়েছে। তিনি আরও বলেন, এর আগে ১৯৯৮ সালে সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ দুর্নীতির মামলায় দ-প্রাপ্ত হলে তার সংসদ সদস্যপদও বাতিল হয়ে যায়।

এদিকে গত বৃহস্পতিবার জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় রায় ঘোষণার জন্য ৮ ফেব্রুয়ারি দিন ঠিক করেন আদালত। ঢাকার ৫ নম্বর বিশেষ জজ ড. মো. আখতারুজ্জামান রায় ঘোষণার এ দিন ঠিক করেন। মামলায় সাবেক এ প্রধানমন্ত্রীর বড় ছেলে দলটির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ৬ আসামি রয়েছেন। ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় করা এ মামলায় এতিমদের জন্য বিদেশ থেকে আসা ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ রয়েছে। একই আদালতে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলাটিরও শুনানি চলছে। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীসহ এ মামলার আসামি ৫ জন। মামলাটি দায়ের হয় বর্তমান সরকারের প্রথম মেয়াদে ২০১০ সালে। আমাদের সময়