চলতি বছরের শেষ দিকে হবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচনী বছরেই বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুদকের করা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায় হতে যাচ্ছে। ৮ ফেব্রুয়ারি মামলাটির রায়ের দিন ধার্য করা হয়েছে। রায় নিয়ে দুশ্চিন্তা বিএনপির নেতাকর্মীদের মাঝে। রায়ে দণ্ডিত হলে আগামী জাতীয় নির্বাচনে আদৌ অংশ নিতে পারবেন কিনা তা নিয়ে তারা শঙ্কিত। মোটকথা রায়কে কেন্দ্র করে দেশে এক ধরনের উত্তেজনা বিরাজ করছে। এসব বিষয়ে মতামত জানতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যালের প্রসিকিউটর এবং ইষ্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের চেয়ারপার্সন ব্যারিস্টার ড. তুরিন আফরোজের মুখোমুখি হয়েছিল ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম সম্পাদক ড. বদরুল হাসান কচি।
৮ই ফেব্রুয়ারী খালেদা জিয়ার রায়কে কেন্দ্র করে দেশে এক ধরনের উত্তেজনা বিরাজ করছে । ঠিক সেই সময়ে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের প্রকাশিত একটি রিপোর্টে প্রশ্ন তোলা হয় এতিম খানার ঠিকানা নিয়ে এবং খালেদা জিয়ার পক্ষে নিযুক্ত কোন আইনজীবী ও সেই এতিম খানার ঠিকানা জানাতে পারেন নি, একজন আইনজীবী হিসেবে বিষয়টিকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন…
ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ : প্রথমত, বিএনপি এ মামলাটিকে নিয়ে এক ধরণের অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে। খোদ বিএনপির মধ্যেও এ বিষয়টি নিয়ে বিরাজমান অস্থিরতা জনগণকে চিন্তিত করে তুলছে। পাশাপাশি উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দলটি আইনের শাসনের প্রতি আস্থা বা শ্রদ্ধাশীল কিনা তা নিয়ে ভাবার অবকাশ রয়েছে। কারণ দীর্ঘদিন ধরে লম্বা আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে মামলাটির বিচার কার্যক্রম এখন প্রায় শেষের দিকে যখন এসেছে অর্থাৎ রায়ের দিন ধার্য করেছেন আদালত তখনই দলের নেতাকর্মীরা বিচারাঙ্গনের বিষয়কে রাজপথে টেনে নিয়ে যাওয়ার পাঁয়তারা শুরু করেছেন। রায় বিপক্ষে গেলে মেনে না নেওয়াসহ তীব্র আন্দোলনের হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন। তাহলে এতদিন ধরে বড় বড় আইনজীবীদের মাধ্যমে মামলাটির আইনি মোকাবেলা করার পর রায় ঘোষণার প্রাক্কালে রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে আসলে কি বুঝাতে চাচ্ছেন? তবে কি বিএনপি আইনের শাসন বা আদালতের প্রতি আস্থা-শ্রদ্ধা হারিয়েছেন? সে প্রশ্ন কিন্তু এসেই যায়।
দ্বিতীয়ত, খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা অর্থাৎ যারা কিনা এই মামলার তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছেন, মামলার বিষয়বস্তু আলোচনা-পর্যালোচনা করে আদালতে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেছেন এতিম খানার ঠিকানা তাঁদের নিশ্চয়ই জানার কথা। এখন তারা যদি এতিমখানার ঠিকানা না জেনে মামলা পরিচালনায় এসে থাকেন তবে আইনজীবী হিসেবে এটা সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা বলে আমি মনে করি।
এছাড়া সত্যিই যদি এতিমখানার অস্তিত্ব খুঁজে না পাওয়া যায় তাহলে তো এই কেলেঙ্কারি পুকুর চুরি, সাগর চুরিকে ছাপিয়ে কাজির গরুর গল্পে রূপ নিচ্ছে যেন কেতাবে আছে, গোয়ালে নাই। অস্তিত্বহীন এতিমখানার নামে অর্থ গ্রাস করে নেওয়ার এই ঐতিহাসিক দুর্নীতি দেশ-জাতি এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়েও নিদর্শন হয়ে থাকবে।
এই দলটি একাধিকবার দেশ পরিচালনা করেছেন যদি জনগণ চায় হয়তো আগামীতেও আবার সরকারের ক্ষমতায় আসবেন কিন্তু এতবড় দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পরেও জনগনের কাছে কি জবাবদিহিতা করবেন না? একইসঙ্গে এই মামলার সঠিক সুরাহা না হলে জনগণের কাছে কিভাবে মুখ দেখাবেন?
বিএনপি বরাবরই অভিযোগ করে আসছে এই মামলা সাজানো, ভিত্তিহীন, মূলত ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার এবং রায়ের ক্ষেত্রেও সরকার আদালতকে প্রভাবিত করবেন, এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কি?
ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ : তারা যে অভিযোগ করছেন এটা আওয়ামীলীগের সাজানো মামলা কথাটি পুরোপুরি ভিত্তিহীন। এ মামলা কিন্তু আওয়ামীলীগ করেনি। এ মামলা কখন হয়েছে এবং কারা করেছে এটা সারাদেশের মানুষ জানেন। কথার কথা হিসেবেও যদি ধরে নেওয়া হয় এই মামলা সাজানো তবে খালেদা জিয়ার বিজ্ঞ আইনজীবী কি করেছেন? মামলা যদি মিথ্যাই হয়ে থাকে তবে তাঁর (খালেদা জিয়া) আইনজীবীরা প্রসিকিউশনের আনা অভিযোগগুলোর প্রতিটা পয়েন্টে সন্দেহের উদ্রেক তৈরি করতে পারলেন না কেন? উল্টো এতিমখানার অস্তিত্ব, অবস্থান বা ঠিকানা যা-ই বলিনা কেন তা নিয়ে বিজ্ঞ আইনজীবীদের অজ্ঞতা নতুন সন্দেহের জন্ম দিয়েছে। এতিমখানাটি আদৌ আছে কি-না এবং থাকলে সেটা কোথায়? সুতরাং অহেতুক আওয়ামীলীগের ওপর দোষ চাপিয়ে রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে আইনের যুক্তি, তথ্য, সত্যকে ধামাচাপা দেওয়া যাবে না।
নির্বাচনের বছর বলে তড়িঘড়ি করে এ মামলার রায় দেওয়া হচ্ছে, বিএনপি’র এমন অভিযোগ নিয়ে আপনার বক্তব্য কি?
ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ : তড়িঘড়ি! ২০০৮ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত দীর্ঘ ১০ বছর সময়কে কোনভাবে কি তড়িঘড়ি বলা যায়? আসলে তারা কি বলতে চান তা বোধগম্য নয়। উনারা কি আজীবন দুর্নীতির দায় মাথায় নিয়ে থাকতে চান নাকি ভয় এই ভেবে যে রায়ে ওনাদের অপরাধ প্রকাশ্যে চলে আসবে বলে ধারণা করছেন। আর নির্বাচনের বছরের কথা তুললে তো বলতেই হয় এই তড়িঘড়ি বরং তাঁদের জন্য ভাল হচ্ছে। জানিনা আদালত কি রায় দেবেন তবে আদালতে যদি প্রমাণ হয় তিনি অপরাধী নন তাহলে নির্বাচনের বছরে দলের জন্য এরচেয়ে বড় প্লাস পয়েন্ট আর কি হতে পারে?